বিচিত্র নির্বাচন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়

উকিল সাত্তারের জন্য সব আয়োজন

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২৩ । ০৫:১৬ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাজীব আহাম্মদ ও আনোয়ার হোসেন, আশুগঞ্জ থেকে

উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া

আশুগঞ্জ নদীবন্দরের পাশেই চর চারতলা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়। কার্যালয় চত্বরে 'উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া সমর্থক গোষ্ঠী'র ব্যানারে কর্মিসভার পর গতকাল রোববার সন্ধ্যায় উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা বসেন বৈঠকে। আলোচনার বিষয়বস্তু, ব্রাহ্মণবড়িয়া-২ আসনের আগামী ১ ফেব্রুয়ারির উপনির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার জন্য নির্বাচনী এজেন্ট জোগাড়!

আওয়ামী লীগের উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হানিফ মুন্সী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন- কে কতজন এজেন্ট জোগান দেবেন। বিএনপির মনোনয়নে চারবার এমপি নির্বাচিত হওয়া উকিল সাত্তারের জন্য আওয়ামী লীগ কেন এজেন্ট জোগাড় করে দিচ্ছে- প্রশ্নে হানিফ মুন্সী সমকালকে বললেন, 'তিনি এত দিন একটা দলে ছিলেন। সেই দলের (বিএনপি) কেউ তো এখন তাঁর সঙ্গে নেই।...তাঁর সঙ্গে আমরা (আওয়ামী লীগ) আছি।'

এ বক্তব্যই ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের বহুল আলোচিত উপনির্বাচনের সারাংশ। শুধু স্থানীয় নয়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং এমপিরাও নেমেছেন ৪৩ বছর বিএনপির রাজনীতি করা উকিল সাত্তারের পক্ষে। গতকাল বিকেলে সরাইলের অরুয়াইলে 'উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া সমর্থক গোষ্ঠী'র জনসভায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন তা খোলাখুলিই জানান। তিনি বলেন, 'বিএনপি উকিল সাত্তারকে ছুড়ে ফেলেছে। তারেক জিয়া তাঁর সঙ্গে বেয়াদবি করেছে। তাঁর সঙ্গে এখন আর বিএনপি নেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমরা তাঁর পাশে আছি।'

আচরণবিধি অনুযায়ী এমপিদের ভোটের প্রচারে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। আচরণবিধি ভেঙে উকিল সাত্তারের পক্ষে রোববার প্রচার চালান আওয়ামী লীগের দুই এমপি জেলার সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও উম্মে সালমা নাজমা বেগম শিউলী আজাদ। মোকতাদির চৌধুরী বলেন, 'গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন সাত্তার সাহেব। তাঁকে বিজয়ী করে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে হবে।'

বিএনপির এমপিরা গত ডিসেম্বরে দলের সিদ্ধান্তে পদত্যাগ করেন। উকিল সাত্তার পদত্যাগী সাত এমপির একজন। তাঁর পদত্যাগে আসন শূন্য হওয়ার ২০ দিন না পেরোতেই উপনির্বাচনে অংশ নিতে মাঠে নামেন তিনি। দল থেকে পদত্যাগ করে উকিল সাত্তার প্রার্থী হওয়ায় উপনির্বাচনের হিসাব-নিকাশ উল্টে গেছে। তাঁর ছেলে মাইনুল হাসান তুষার বলেন, 'আওয়ামী লীগের কাছে সমর্থন চাইনি। আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি, সরকারি দল তো নির্বাচন বর্জন করেনি। তাই দলটির নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের সমর্থন দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির (জাপা) একাংশও সমর্থন দিয়েছে। এই সমর্থন আমরা লুফে নিয়েছি।'

যদিও ভোটার ও স্থানীয় নেতাদের ভাষ্য, বিএনপির পদত্যাগের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ও উকিল সাত্তারের সংসদে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করতে উপনির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ; উন্মুক্ত রেখেছিল। দলটির তিন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। তাঁরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। জাপার দুইবারের এমপি জিয়াউল হক মৃধা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও সরে গেছেন ভোট থেকে। এই চার প্রার্থী সরে যাওয়ার পর উকিল সাত্তারের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপি নেতা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু আসিফ আহমেদ। তিনি তিন দিন ধরে 'নিখোঁজ'।

বাকি যে দু'জন ভোটের মাঠে রয়েছেন- জাপার আবদুল হামিদ ভাসানী ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম জুয়েল স্বল্প পরিচিত। রাজনৈতিক সূত্রের ভাষ্য, উকিল সাত্তারকে যেন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার বদনাম নিতে না হয়, সে জন্য দুর্বল দুই প্রার্থীকে ভোটে রাখা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে না হয় এবং জয়ের পথ ঝুঁকিমুক্ত করতে সবলদের ভোট থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাপা মনোনয়ন দিয়েছিল একাদশ নির্বাচনের প্রার্থী রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াকে। তাঁর ভাষ্য, উকিল সাত্তারকে জেতাতে ভোট হচ্ছে। এ ভোটে অংশ নিয়ে লাভ নেই। তাই প্রার্থী হননি। নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া এক আওয়ামী লীগ নেতাও জানান, উকিল সাত্তারই জিতবেন বা তাঁকে জেতানো হবে। তাই নির্বাচন করছি না।

আশুগঞ্জ বন্দর থেকে সরাইল হয়ে আখাউড়া পর্যন্ত চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণ চলছে। আশুগঞ্জ-সরাইল সড়ক ঘুরে কয়েকটি পোস্টার ছাড়া নির্বাচনের আর কোনো আলামত চোখে পড়ে না। নেই বিরক্তিকর মাইকিং। যে যৎসামান্য পোস্টার আছে, তার বেশির ভাগই উকিল সাত্তারের 'কলার ছড়ি'র। নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাঁর মতোই দল থেকে বহিস্কার হওয়া আরেক বিএনপি নেতা আবু আসিফের অল্প কয়েকটি পোস্টার চোখে পড়ে তাঁর বাড়ি আশুগঞ্জ ফেরিঘাট এলাকায়। কয়েকটি পোস্টার থাকলেও জাপার ভাসানীর প্রচার চোখে পড়েনি। আশুগঞ্জে জাকের পার্টির গোলাপ ফুলের প্রার্থী কোথাও নেই।

রোববার দুপুরে আবু আসিফের বাড়ির ফটক ভেতর থেকে তালাবদ্ধ পাওয়া গেল। তাঁর স্ত্রী মেহেরুন্নেসা এর আগে সকালে সমকালকে বলেন, 'শুক্রবার বিকেল থেকে ফোনে পাচ্ছেন না আবু আসিফকে। তিনি কোথায় আছেন, জানি না। নেতাকর্মী ও কর্মচারীরাও কিছু বলতে পারছেন না। সাদা পোশাকে পুলিশ না কে জানি না, ছবি তুলছে, ভিডিও করছে। আমি নিজেও আতঙ্কিত। ছবি তুলে রাখায় কর্মীরা ভয়ে আসছে না। কর্মীরা আতঙ্কিত। আমিও আতঙ্কিত। আমাকে ২৪ ঘণ্টা নজরবন্দি করে রেখেছে। কীভাবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করতে পারি?' মেহেরুন্নেসা জানান, তাঁর ভাই শাফায়েত হোসেন সুমনও শুক্রবার থেকে নিখোঁজ। আবু আসিফের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আবু মুসাকে বুধবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আশুগঞ্জের বেড়তলা এলাকায় চায়ের দোকানের আড্ডায় কথা হয় স্থানীয় ছয়জনের সঙ্গে। উপনির্বাচন নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। সবাই বললেন, ভোট দিতে যাবেন না। তাঁদের সবার ভাষ্য, উকিল সাত্তারকে জেতাতেই এত আয়োজন। তাঁকে জেতাতে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক বয়োবৃদ্ধ ভোটার জানালেন, সাত্তার ভূঁইয়াকে ভোট দেব না- এ কথা বললে কেন্দ্রেই যেতে পারবেন না। আরেকজন বললেন, 'ভোট অইলেও সাত্তার সাব এমপি, না অইলেও এমপি। হেইলা (তিনি) ছাড়া আর কেউ নাই।'

আশুগঞ্জ ও সরাইল- দুই উপজেলা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন। ১৯৭৩ সালের পর গত ৫০ বছরে এই আসনে কখনও জিততে পারেনি আওয়ামী লীগ। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে উকিল সাত্তার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এমপি হন। এরপর আরও চারবার জয়ী হয়েছেন ধানের শীষের মনোনয়নে। ২০০১ সালে জোটের কারণে তাঁর বদলে মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে প্রার্থী করেছিল বিএনপি। 'ক্ষতিপূরণ' বাবদ নির্বাচনে জয়ী বিএনপি উকিল সাত্তারকে প্রতিমন্ত্রী করে।

১৯৮৬, ১৯৮৮, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয় জাপা। শেষের দুই নির্বাচনে জাপার প্রার্থী পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সমর্থন। ২২ বছর নৌকার প্রার্থী নেই এই আসনে। একাদশ নির্বাচনেও জাপাকে আসনটি ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। দলটির নেতা মঈন উদ্দিন মঈন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে ত্রিমুখী লড়াইয়ে জয়ী হন উকিল সাত্তার।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঈন উদ্দিনের প্রতীক ছিল 'কলার ছড়া'। তাঁর পক্ষে ছিল আওয়ামী লীগের বড় অংশ। এবার উকিল সাত্তারের 'কলার ছড়া'র পক্ষে তাঁরা। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের ১৩২টি কেন্দ্রের তিনটির ভোট বন্ধ হয়েছিল গোলযোগে। ১০ হাজার ১৫৯ ভোটে এগিয়ে থাকা উকিল সাত্তার ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি নির্বাচনে অভিযোগ করেছিলেন, তিন কেন্দ্রের পুনর্ভোটে কারচুপি করে তাঁকে হারানোর পাঁয়তারা চলছে। যাঁদের বিরুদ্ধে তিনি চার বছর আগে অভিযোগ করেছিলেন, তাঁরাই এবার তাঁর পক্ষে নির্বাচনে।

মঈন উদ্দিন মঈনও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে রয়েছেন উকিল সাত্তারের ভোটের প্রচারে। গতকালের জনসভায়ও ছিলেন। ১০ মাস পরেই পরবর্তী নির্বাচনের তপশিল। এত অল্প সময়ে প্রতিশ্রুতি পূরণ সম্ভব নয় কারণ দেখিয়ে তিনি ভোট থেকে সরে গেছেন। তবে উকিল সাত্তারের ছেলে বলছেন, অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে তাঁর বাবা নির্বাচন করছেন। বিএনপি রয়েছে ভুল পথে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com