
মতামত
পাহাড়খেকোদের থামাবে কে?
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২৩ । ১৯:০৬ | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২৩ । ১৯:১৬
আবুল কাশেম উজ্জল

পরিবেশের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন ছাড়া মানব জাতি পৃথিবীতে টিকে থাকার কোনো সুযোগ নেই। সম্প্রতি দেশের কোনো কোনো জেলায় প্রচণ্ড শীত লক্ষ করা গেছে। আবার জানুয়ারি শেষ না হতেই গরমের হালকা ভাব শুরু হয়ে গেছে, যা আগে ছিল না। এটা জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের প্রভাব। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়, প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মানুষের অনিয়ন্ত্রিত অত্যাচার।
সে পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পাহাড় ও টিলা। পাহাড়-পর্বতমালা শুধু প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অংশই নয়, মানুষের জীবন সুরক্ষায় পাহাড়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পাহাড় হলো জমিনের খুঁটি। কোনো বাড়ির খুঁটি নড়বড়ে হলে যেমন বাড়িটি বসবাসের উপযোগী থাকে না, তেমনি আমাদের এ গ্রহের অবস্থা হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রকৃতির সবকিছু ধারাবাহিক, সম্পর্কিত এবং ভারসাম্যপূর্ণ। কোনোভাবে এ ভারসাম্য নষ্ট হলে তা আমাদের জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে, এর উদাহরণ সময় সময় প্রকৃতি দিয়ে থাকে। বন্যা, ভূমিকম্প, খরা, শৈত্যপ্রবাহ- এ সবই আমরা নিয়মিত দেখছি। বাংলাদেশ তো জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চ ঝুঁকির দেশ।
পাহাড় কেবল প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্যই নয়, এর মাধ্যমে সব প্রাণীর খাবারের ব্যবস্থাও হয়। আল্লাহ বন্য প্রাণীর খাবার পাহাড়-জঙ্গলে ছড়িয়ে দিয়েছেন। পাহাড় ধ্বংসের ফলে বন্য প্রাণীদের খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। খাদ্যাভাবের ফলে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বন্যহাতিরা খাবারের খোঁজে প্রায়ই সমতল ভূমিতে এসে ফসল ও মানুষের ক্ষতি করে।
আর এ কারণে আমরা সময় পেলে প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে পাহাড়-জঙ্গলে বেড়াতে যাই। এ পাহাড়-টিলাগুলো একই সঙ্গে আমাদের জন্য বিশুদ্ধ অপিজেনের উৎস। অথচ সেই মানুষই সময় পেলেই পাহাড়ের সর্বনাশ করে এবং ক্রমাগতভাবে করছে। ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সময় সময় পাহাড়-টিলা কেটে আবাসস্থল তৈরির খবর নতুন নয়। এমনকি সরকারি উন্নয়ন কাজেও এমন উদাহরণ এ দেশে আছে। তবে ব্যক্তি শ্রেণির পাহাড় কাটার ঘটনা অনেক বেশি। দেশে পরিবেশবিষয়ক আইন আছে, আছে আদালতের নির্দশনা। এরপরও থেকে নেই পাহাড় কাটা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশলে এ কাজ হচ্ছে, মাঝে মধ্যে সরকারি অভিযান হয় ঠিকই, কিন্তু বন্ধ হয় না। সিলেট ও চট্টগ্রাম হচ্ছে দেশের প্রধান দুই পাহাড়-টিলা বেষ্টিত অঞ্চল। এ দুই জায়গায় এমন জঘন্য কাজ নিয়মিতই চলছে। সিলেটের আরেফিন টিলা এখন অনেকটা টিলার কঙ্কাল হয়ে গেছে। প্রশাসনের অভিযান হলে ধরা পড়ে কিছু শ্রমিক আর খনন যন্ত্র। মামলা হয় কিন্তু সুরাহা হয় না।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বেলার অন্যান্য কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ, তাঁদের বহনকারী গাড়ি আটকে রাখার ঘটনা ঘটেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গত ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরে আকবরশাহ এলাকায় আকবরশাহ থানাধীন লেকসিটি আবাসিক এলাকায় পাহাড় কেটে ভরাট করা ছড়া পরিদর্শনের সময় তিনি ও দলের অন্যরা আক্রান্ত হন। এ ঘটনায় স্থানীয় একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ সময় তার সফরসঙ্গী বেলার কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়। ঘটনার সময় তারা ছুরি, কিরিচ, দা প্রভৃতি দেশীয় ধারালো অস্ত্র বহন করছিল। এর আগে কমিশনারের লোকজন প্রতিনিধি দলের গাড়িটি আটকে রেখেছিল। পরে পুলিশ এসে গাড়ি ছাড়িয়ে নেয়। উল্লেখ্য, উত্তর পাহাড়তলীতে অবৈধ পাহাড় কাটার অভিযোগে অভিযুক্ত ওই কাউন্সিলের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে একটি মামলাও দায়ের করেছে আকবর শাহ থানায়। এর আগেও ২০১৫ সালে তার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর।
এ ঘটনা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যারা গোটা জাতির ক্ষতি করছে, তাদের এমন সাহস দেখে সচেতন নাগরিক সমাজ হতবাক। এ ঘটনা থেকে উপলব্ধি হলো যে, 'এখন আর চোরকে চোর বলা যাবে না, তাতে তাদের সম্মানহানি হয়'। আইন থাকার পরও কেন একটি বেসরকারি সংস্থাকে এসব নিয়ে বারবার প্রশাসন ও আদালতে যেতে হচ্ছে- সে প্রশ্নের উত্তরটিও জানা দরকার। প্রশাসনের কাজ কি কেবল অভিযোগ পেলে তদন্ত করা- সে প্রশ্নটিও থেকে যাচ্ছে। যারা বারবার আইন ভঙ্গ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কি সরকার বা প্রশাসনের কিছু করার নেই? পাহাড় কাটা অন্য অপরাধের মতো নয় যে, গোপনে সেটা করা যায়। বরং এটা সহজেই দেখা যায়। পাহাড় যে কাটা হচ্ছে তা প্রমাণ করাতেও গভীর তদন্ত ও প্রমাণের খুব কি প্রয়োজন হয়? আগে সিঁদেল চোর রাতের বেলায় চুরি করত, ধরা পড়ার ভয়ে গায়ে তেল লাগিয়ে যেত। দিন বদলেছে, এখন আর অপরাধীরা ভয়ে থাকে না, ভয়ে থাকি আমরা, যারা আইন মেনে চলতে চাই। চট্টগ্রামের ঘটনা আমাদের সে বার্তাই দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী পরিবেশের বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করছেন, পাচ্ছেন আন্তর্জাতিক মহলের বাহবা। আশা করি এ ঘটনা ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কাজের বিরুদ্ধে তিনি আরও কঠিন ভূমিকা নেবেন। এর জন্য দরকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার। সে সময়ের প্রত্যাশায় জাতি।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com