খেলাপি ঋণ

কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা রাঘববোয়াল

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০৯:১৯ | প্রিন্ট সংস্করণ

মইনুল ইসলাম

গত ২৫ জানুয়ারি ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সংবাদের মধ্যে একজন বিশেষজ্ঞ যে মন্তব্য করেছেন, তা হচ্ছে- 'দ্য নেমস অব নটোরিয়াস হ্যাবিচুয়াল ডিফল্টারস ওয়ার অ্যাবসেন্ট ফ্রম দ্য লিস্ট'। এর অর্থ হলো, অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া কুখ্যাত ঋণখেলাপিদের নাম তালিকা অনুপস্থিত। মন্তব্যটি দেখে মনে পড়ছে আমার একটি সাম্প্রতিক গবেষণা গ্রন্থের কথা। ২০১০ সালে প্রকাশিত 'আ প্রোফাইল অব ব্যাংক লোন ডিফল্ট ইন দ্য প্রাইভেট সেক্টর ইন বাংলাদেশ' শিরোনামের গ্রন্থটি সেই সময় বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। অনেকটা যেন মৌচাকে ঢিল ছুড়েছিল।

ওই গবেষণায় 'হ্যাবিচুয়াল ডিফল্টারস'কে আমি 'উইলফুল ডিফল্টারস' আখ্যায়িত করেছি। যার বাংলা অর্থ হলো 'ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি'। এর মানে, এই রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিরা রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে এতই প্রভাবশালী যে, তাঁরা ব্যাংকের ঋণ ফেরত না দিলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, সরকার বা দেশের বিচারব্যবস্থা তাঁদের শাস্তি দিতে পারছে না। এ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বছরের পর বছর ঋণখেলাপি হয়ে বহাল তবিয়তে তাঁরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা গৃহীত ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার করে ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপাতি কিনে তাঁদের পরিবারের প্রায় সবাইকে বিদেশে অভিবাসী করে ফেলেছেন।

১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া ১৯৯৭ সালে এক কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রস্ত যে ২ হাজার ১১৭ জন ঋণখেলাপির তালিকা সংসদে পেশ করেছিলেন, ওই তালিকার বৃহত্তর এক হাজার ঋণখেলাপি থেকে ১২৫টি নমুনা বাছাই করে আমরা গবেষণাটি পরিচালনা করেছিলাম। আমি তখন ডেপুটেশনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের মহাপরিচালক। ১৯৯৯ সালের মে মাসে গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল নিয়ে আমাদের একটি জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে খেলাপি ঋণ নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমাদের গবেষণার ফলাফল নিয়ে বিরোধী দল বিএনপিকে সংসদে তুলাধুনা করেছিলেন। কিন্তু তখনকার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের অসহযোগিতায় আমাদের গবেষণা ভণ্ডুল হওয়ার উপক্রম হয়। অনেক দিন গবেষণা বন্ধ রাখার পর 'রিসার্চ মেথডলজি' পরিবর্তন করে 'কেস স্টাডি মেথড' ব্যবহার করে আমরা দীর্ঘ বিলম্বের পর গবেষণাটি সম্পন্ন করে ২০১০ সালে বই হিসেবে প্রকাশ করি। বইটি অতি দ্রুতই বিক্রি হয়ে যায়।


যা হোক, ডেইলি স্টারের সংবাদটি ছিল গত ২৪ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ ২০ জন ঋণখেলাপির নামের তালিকা প্রকাশ করা নিয়ে। নামগুলো পরদিন দেশের অনেক পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই ২০ জন শীর্ষ ঋণখেলাপির মোট ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, যার মধ্যে ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ। সংসদে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশে মোট ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫ জন ঋণখেলাপি রয়েছেন। শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির ১ নম্বরে থাকা প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৬৪০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। আর ২০ নম্বরের খেলাপি ঋণ ৫৪১ কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ও বিস্ময়কর, তালিকাতে দেশের 'রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি' হিসেবে কুখ্যাত একজনের নামও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আমার গবেষণা গ্রন্থটির সপ্তম অধ্যায়ে বাংলাদেশের শীর্ষ ৩১ জন ঋণখেলাপির কেস স্টাডি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যাঁদেরকে আমি ১২ বছর ধরে মনিটর করে যাচ্ছি। বস্তুত খেলাপি ঋণ সমস্যাকেই আমি এক যুগ ধরে নিবিড়ভাবে স্টাডি করছি। আমার জানামতে, ওই ৩১ জন ঋণখেলাপির মধ্যে ছয়জন ছাড়া অন্যরা হয় এখনও ঋণখেলাপি রয়ে গেছেন অথবা ঋণখেলাপি থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। তাঁদের একজনের নামও অর্থমন্ত্রী উপস্থাপিত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এবার উপস্থাপিত ঋণখেলাপির মধ্যে অর্ধেকসংখ্যক চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান, যেগুলো খেলাপি ঋণের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তালিকার মধ্যে ঢাকার কয়েকশ রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের একটিকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি, যাদের প্রতিটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রকাশিত এই ২০ প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি বলে দেশের ব্যাংকিং সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা সবারই জানা আছে।

আমাদের মনে আছে, ২০১২ সাল থেকে প্রচলিত তিন ধরনের শ্রেণিকরণের নিয়ম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতের অনাদায়ী ঋণকে শ্রেণিকরণের নতুন নিয়ম চালু করেছিল। মন্দ ঋণ 'রাইট অফ' বা অবলোপনের নিয়মনীতি অনেকখানি শিথিল করেও নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। আগের নিয়মে যেখানে পাঁচ বছরের খেলাপি মন্দ ঋণ 'রাইট অফ' করার যোগ্য বিবেচিত হতো, সে ক্ষেত্রে নতুন নিয়মে দুই বা তিন বছরের মন্দ ঋণও 'রাইট অফ' করায় কোনো বাধা থাকবে না। নতুন নিয়ম চালু করে ক্লাসিফায়েড লোন কমানোর হাতিয়ার ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হলো। আরেকটা সুবিধা ঘোষিত হলো, মামলা করার বাধ্যবাধকতার কারণে আগে যে সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর) ছিল ৫০ হাজার টাকা; ওটাকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা।

২০১৯ সালের ২৫ মার্চ অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, মাত্র ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ প্রথম কিস্তিতে শোধ করলে ঋণখেলাপিকে ১০ বছর সময় দেওয়া হবে, যার মধ্যে তিন মাসের কিস্তিতে মাত্র ৭ শতাংশ সুদে বাকি ঋণ শোধ করা যাবে। পরে তিনি বলেন, সুদের হার ৯ শতাংশ হবে।

সর্বশেষ যে ১৫ জন খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে ২০১৫ সালে মন্দ ঋণ রিস্ট্রাকচারিংয়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তাঁদেরকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল- ওই সুবিধা গ্রহণ করলে আর কখনও ঋণ রিশিডিউলিংয়ের সুযোগ পাওয়া যাবে না। কিন্তু ১৫ জনের মধ্যে মাত্র চারজন ওই শর্ত মেনে সুযোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। বাকি ১১ জনকে আর রিশিডিউলিংয়ের সুযোগ দেওয়া হবে না বলা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁদেরকে আবারও ঋণ রিশিডিউল করার অনুমতি দিয়েছিল।

বস্তুত ২০১৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লাসিফায়েড লোনের যে হিসাব প্রকাশ করল, তাতে মাত্র ৯৫ হাজার কোটি টাকায় নেমে গেল ক্লাসিফায়েড লোন। কিন্তু আইএমএফ এই দাবির প্রতিবাদে ব্যাখ্যাসহ জানাল, ওই পর্যায়ে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। আইএমএফের উল্লিখিত পরিমাণে যেহেতু রাইট অফ করা মন্দ ঋণ অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তাই প্রকৃত খেলাপি ঋণ তখনই ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের হিসাব প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ক্লাসিফায়েড লোন ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।

আমার আশঙ্কা, এখন দেশে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। রাঘববোয়ালদের খেলাপি ঋণ কার্পেটের নিচে লুকিয়ে ফেলা সত্ত্বেও দেশের ব্যাংকগুলোতে হুহু করে তা বেড়ে চলেছে। এটিই হলো দুঃখজনক বাস্তবতা।

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com