
প্রচ্ছদ
নো ম্যানস ল্যান্ড
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইরাজ আহমেদ

মহাভারতের কাহিনিতে দ্রৌপদীর দাম্পত্য জীবন কেমন ছিল তার খুব একটা বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। পাঁচ স্বামীর একমাত্র ভার্যা হয়ে দ্রৌপদীর জীবন কেমন ছিল রাজপ্রাসাদে? গভীর অরণ্যে অজ্ঞাত নিবাসে তার দাম্পত্য জীবনের দৈনন্দিন বিবরণ অথবা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলার সময়ে যুদ্ধশিবিরে দ্রৌপদী দৈনন্দিন জীবনের স্পষ্ট কোনো ছবি এই মহাকাব্যের পাঠকদের কাছে পৌঁছায়নি। বলা যেতে পারে, লেখা হয়নি।
মহাভারতের আদিপর্বের এক জায়গায় উল্লেখ আছে, পাঁচ স্বামীর কুটিরে রাতে দ্রৌপদীর ঘুমানোর জন্য স্থান নির্ধারিত হয়েছিল তাদের পায়ের দিকে আর পঞ্চপাণ্ডবের মাতা কুন্তী শুয়েছিলেন মাথার দিকে। সেখানে লেখা হয়েছে- 'কুশশয্যায় এইরূপে পায়ের বালিশের মতন শুয়েও দ্রৌপদীর মনে দুঃখ বা পাণ্ডবদের প্রতি অবজ্ঞার ভাব হলো না।' একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে অথবা বিগত শতাব্দীতেও দাম্পত্য সম্পর্কে এমন দৃশ্য খুঁজে পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমার আত্মজাকে দ্রৌপদীর দাম্পত্য জীবনে প্রবেশের প্রথম দিনের খণ্ড দৃশ্যটির বিবরণ দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, সে কবে বিয়ে করবে বলে ভাবছে অথবা দাম্পত্য সম্পর্কে তার ভাবনা কী? কন্যার সোজাসাপটা উত্তর, 'খবরে পড়েছি এই ঢাকা শহরে বছরে গড়ে তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বিয়ে করার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।'
দুটো ছবিই যার যার প্রেক্ষাপটে এক ধরনের চরম অবস্থার কথাই বলে। একাধিক স্বামীর পায়ের বালিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া আর অন্যদিকে নতুন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে উপলব্ধ সত্য। তাহলে ঠিক কোথায় এসে আজকে দাঁড়াল দাম্পত্য নামে নারী ও পুরুষের সুপ্রাচীন এই সম্পর্ক? কোথাও দাঁড়াল তো নিশ্চয়ই। সমাজে এখনও সংসার নামের প্রতিষ্ঠানটি টিকে আছে। এই কাঠামোকে প্রতিষ্ঠান বলাই ভালো। কারণ, দাম্পত্য সম্পর্কের ভিত্তিতে যা গড়ে ওঠে সেটার একটা নিয়ম আছে, রীতি আছে, সংস্কৃতিও আছে। বহু বছর ধরে একটু একটু করে এই নিয়ম, রীতি আর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এবং আবার তা ভাঙনের মুখেও চলে গেছে।
আমার দাদুর বিয়ে হয়েছিল এগারো বছর বয়সে। বর এসেছিল হাতিতে চড়ে। নাবালিকা পাত্রী সেই হাতি দেখতে ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে গিয়েছিল। তারপর চৌদ্দ বছর বয়সে বৈধব্যের সাদা শাড়ি ঘেরাও করে ফেলে তাঁর জীবনের বাকি অধ্যায়গুলোকে। পঁচাশি বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে সেই ভদ্রমহিলা দুই সন্তান নিয়ে জীবন কাটিয়ে গেছেন। নিজের দাম্পত্য জীবনের সীমানা ফুরিয়ে কখনও পুত্রের, কখনও কন্যার দাম্পত্য জীবনের ভিতরে একবচন হয়ে জীবন কাটিয়ে গেছেন। দ্রৌপদীর মতোই স্বামীর স্মৃতির পায়ের কাছে বালিশ হয়ে কেমন ছিল তাঁর সেই জীবন?
দাম্পত্য জীবন দু'জন মানুষের যৌথ সময়ের গল্প। ঘুম থেকে জেগে ওঠার মুহূর্তে অথবা ঘুমিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত একই ঘর, একই শয্যার মানচিত্রে বেঁচে থাকা একজন পুরুষ ও একজন নারী দুটি পৃথক নৌকা পাশাপাশি বেঁধে অনেকটা পথ অতিক্রম করতে চায়। দাম্পত্য সীমান্তে এই একসঙ্গে পথ অতিক্রম করতে চাওয়াটাই হয়তো বিয়ের মূলমন্ত্র; একসঙ্গে থাকাটা নয়। দাদুর প্রসঙ্গে ফিরে আসি আবার। অনেকগুলো বছর তিনি একা একা কাটিয়ে দিলেন ছোট্ট একটু সময়ের দাম্পত্য জীবনের স্মৃতি নিয়ে। মনে মনে হয়তো একটা সংসারই করে গেলেন; একজন মানুষের রোজ খবরের কাগজ পড়ার স্মৃতি, দরজায় দাঁড়ানোর ভঙ্গি, ছোটখাটো দু-একটি কথা, উপহার দেওয়া বইতে শুকনো গোলাপের কয়েকটা পাপড়ির স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই পথটা অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন হয়তো। এভাবে অবয়বহীন, শরীরহীন মানুষের স্মৃতির সঙ্গে দাম্পত্য জীবন কাটানো যায়! জীবনের স্টেজে দাম্পত্যের দ্বিতীয় পর্দা ওঠার সুযোগ তৈরি করতে তাঁর মন ছুটে যায়নি কখনও? নাকি নিঃসঙ্গ জীবনে শরীর আর মনের আবেগের গতিমুখ ঘুরিয়ে দেয় স্নেহ, ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ? মনের সেই গহিন গল্প জানা হয়নি কোনোদিনই।
এখনকার পৃথিবীতে দ্রৌপদীর কাহিনি বেঁচে নেই, বেঁচে নেই দাদু মোসাম্মৎ হাসিনা বানুর গল্পও। একদা ভিন্ন একটি সংসারে বিয়ে হয়ে আসা নারীটিকেই বলা হতো নতুন ধারাপাতে নিজেকেই মানিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু এখন সেই পর্বের অনেকদূর অবসান ঘটেছে। এখন এই সম্পর্কের উভয় যাত্রীকেই মানিয়ে নিতে হয়, মেনেও নিতে হয়। তারা মানিয়েও নেন। কিন্তু এর পরেও একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে একজন তরুণী দাম্পত্য সীমান্তের পথটা পার হতে ভয় পাচ্ছে, শঙ্কিত হয়ে একা একা জীবন কাটানোর কথা ভাবছে দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে সংসার জীবনে আস্থার ভূমিকাটা নড়বড়ে হয়ে গেল?
চির পরিচিত ঘর, শয্যার একই মানচিত্র মধ্যবয়সী অনেক দম্পতির কাছে অচেনা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি সব সময় যে নেতিবাচক কারণেই ঘটতে শুরু করবে, এমন কোনো কথা নেই। কখনও পুরোনো দাম্পত্য সম্পর্কের সীমানায় দাঁড়িয়ে দু'জন মানব-মানবীর মনের গড়নটাই পাল্টাতে শুরু করে। হাসিনা বানুর বৈধব্যের বেদনার অনুভূতি পাল্টে গিয়েছিল স্নেহে, দায়িত্ব পালনে অথবা ভিন্ন এক ভালোবাসায়। বিবাহিত দু'জন মানুষের মনের গড়নটাও তেমনি পাল্টে যেতে পারে নির্ভরতায়, আস্থায়, বন্ধুত্বে। তীব্র ভালোবাসার মধ্য দিয়ে যে জীবনের সূচনা, সেখানে এসে ঘর বাঁধতে পারে নির্ভরতার নিভৃতি। কখনও এই পরিবর্তনের রূপরেখা বুঝে উঠতে পারেন না অনেকে। দাম্পত্য সীমান্তে সেখানেই সংকটের সূচনা হয়। দু'জনের মাঝে একজন হয়তো বুঝতেই চায় না শুধু একরোখা ভালোবাসা মানব-মানবীর সম্পর্ককে কাঁধে করে নিয়ে পুরোটা পথ চলতে পারে না। সেখানে অনেকগুলো উপাদানের প্রয়োজন হয় সময়ের ভারে চাপা পড়া সম্পর্কটাকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে।
বিবাহ প্রতিষ্ঠানটির মাঝেই জন্মজন্মান্তরের মতো একে-অপরের হয়ে যাওয়ার আশ্বাস থাকে। সবাই ভাবে, সামাজিক অনুশাসন, নিয়ম, 'কবুল কবুল' উচ্চারণ অথবা মন্ত্র পাঠের মধ্য দিয়ে একটি চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে অনুমোদন দিয়ে দেওয়া গেল। কিন্তু বাস্তবে কি তাই ঘটে দাম্পত্য সম্পর্কে? আসলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বিয়েকে একটা বেলুনের মতো ফুলিয়ে উপস্থাপন করে। দু'জন মানুষ তাই এই সম্পর্কের আওতায় এসে বিয়ের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে ভারমুক্ত হয়ে জীবনের অন্য অনুষঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একটা সময় তারাই আবিস্কার করে নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতার লেনদেন কমে গেছে। জীবনকে মনে হচ্ছে মুখস্থ হয়ে যাওয়া একটা বই। যদি বলা যায়, হাসিনা বানুর বিয়ে, সংসার তাঁর স্মৃতিতে ছিল বলেই তা টিকে গিয়েছিল? তাঁর দাম্পত্য জীবনের বয়স বাড়লে সেখানেও কি মাথা তুলত বোঝাপড়ার অভাব, অভ্যাসের একঘেয়ে অনুভূতি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন নয়।
'মেনে নেওয়া' আর 'মানিয়ে নেওয়ার' যে চাদরটা দাম্পত্য সীমান্তে সম্পর্ককে ঢেকে ফেলে হাসিনা বানুর ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। তারপর তারা এভাবেই বেঁচে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত মানসিকভাবে, যার পুরোটা হয়তো তারা অনুভব করতেও সমর্থ হতেন না।
কবি বিষুষ্ণ দে কবিতায় লিখেছিলেন, 'অভ্যাস শুধু অভ্যাস লিলি, তাই তো আসি।' এই অভ্যাস হয়ে যাওয়ার মানসিকতাই দম্পতিদের আজও বিয়ে নামের বইয়ের মলাটটা ঠিক রাখতে তৎপর করে রাখে। তারা হয়তো ভাবেন, ভিতরটা পাল্টে গেলে যাক, খোলসটা তো অবিকৃত থাকল। আর এই মলাট ঠিক রাখার খেলা খেলতে খেলতে তারা একটা সময়ে আবিস্কার করেন একসঙ্গে থাকা তাদের জীবনে ঢুকে পড়ছে আরও অনেক চরিত্র: হারিয়েছে নিজেদের একান্ত সময়। তাই হয়তো অনেকে চান, বিয়ে যুগের অবসান হোক। পথ বেঁধে রাখার চাইতে পথটা খোলা থাকাই তো ভালো। রবীন্দ্রনাথ তো লিখেই গেছেন, 'পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।' অনেক বছর আগে গ্রামের বাড়ির পুকুরঘাটের পোশাক পাল্টানোর ঘরটার দেয়ালে পেন্সিল দিয়ে কেউ লিখে রেখেছিল এই লাইন। কিশোর বয়সে পড়ে অবাক লেগেছিল। আরেকটু বড় হয়ে ভেবেছি, নিশ্চয়ই বাড়ির জ্যেষ্ঠ সদস্যদের কেউ তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথের লাইন দেয়ালে লিখে দিয়েছিলেন। ভালোবাসার অনুভূতির বাইরে আর কোনো গভীর ভাবনা তাকে তাড়িত করেছিল বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু বন্ধনহীন গ্রন্থি বিষয়টা আমাকে ভাবিয়েছে। যখন নারী ও পুরুষের যৌথ সম্পর্কের মধ্যে 'লিভ ইন' প্রথাটা প্রবল বেগে ঢুকে পড়ল, পৃথিবীজুড়ে আলোড়ন তৈরি হলো ভাবলাম, এই হয়তো বন্ধনহীন গ্রন্থি। দু'জন মানুষ একই ছাদের তলায় কোনো ধরনের সামাজিক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর না-করে দাম্পত্য সম্পর্কে জড়াতে চাইছে। তাদের ঘরের দুয়ার খোলা আছে সহজে বিদায় নেওয়ার জন্য। বিয়ে নামের প্রথার বিরুদ্ধে এ এক বিদ্রোহ। কেউ কেউ বলেন, মন এবং শরীরের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া হয় এই পন্থায়। তাহলে বিবাহ নামের এই প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা টিকে থাকল কেন! জানতে ইচ্ছে করে, পৃথিবীর মানব-মানবীরা আসলে কী চায়? এই লেখা লিখতে লিখতেই টেলিফোনে এক বন্ধুর বার্তা এলো। বিয়ের দিনের একটি ছবি দিয়ে সেই বন্ধু লিখেছেন, তাদের বিবাহিত জীবন আজ চব্বিশ বছর অতিক্রান্ত হলো। যৌথ জীবনের জন্য তারা সবার শুভেচ্ছা কামনা করছেন। বন্ধুর পাঠানো ওই খুদেবার্তাটি পাঠ করতে করতে ভাবছিলাম মানুষ আসলে কী চায়? সংসার, যৌথ জীবনের মধু, সন্তান কোলে তুলে নেওয়ার মাঝে নারীর জীবনের একধরনের পূর্ণতার অনুভূতি, পুরুষের সাফল্যের গল্পটাও রয়ে গেছে একবিংশ শতাব্দীর এই টালমাটাল সময়ে? যে সময়টা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে, ইচ্ছার স্বাধীনতাকে সমর্থন করে, যে সময়টা পুরুষকেও প্রতারণার পথ বেছে না-নিয়ে স্বাধীন ভাবনাকে বিকশিত করার কথা বলে।
দাম্পত্য সীমান্তে একজন নারী অথবা একজন পুরুষ আসলে স্বাধীনতার সন্ধান করে। দু'জন মানুষের যৌথ জীবনে কখনোই একে-অপরকে দখল করতে পারে না। মাঝে খানিকটা জমিন 'নো ম্যানস ল্যান্ড' হয়ে থাকে, থাকতে হয়। সেটুকুই হয়তো নিঃশ্বাস ফেলবার জায়গা হয়ে বাঁচায়। বিবাহ নামের বইয়ের মলাট এবং ভেতরটাও অবিকৃত থাকে। কিন্তু তাই কি ঘটে বাস্তব জীবনে? মহাভারতেই উল্লেখ আছে পাঁচ স্বামীর একমাত্র স্ত্রী দ্রৌপদী অর্জুনের প্রতি দুর্বল ছিলেন, পাঁচ স্বামীর মাঝে অর্জুনকেই অধিকার করতে চেয়েছিলেন খানিকটা বেশি। সেই পক্ষপাতে তার বাকি স্বামীরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন কিনা জানা নেই। আমরা দাম্পত্য জীবনে অধিকার বোধের কাহিনি লিখতে গিয়ে এই সত্যটাই হয়তো ভুলে যেতে বসি।
মহাভারতের আদিপর্বের এক জায়গায় উল্লেখ আছে, পাঁচ স্বামীর কুটিরে রাতে দ্রৌপদীর ঘুমানোর জন্য স্থান নির্ধারিত হয়েছিল তাদের পায়ের দিকে আর পঞ্চপাণ্ডবের মাতা কুন্তী শুয়েছিলেন মাথার দিকে। সেখানে লেখা হয়েছে- 'কুশশয্যায় এইরূপে পায়ের বালিশের মতন শুয়েও দ্রৌপদীর মনে দুঃখ বা পাণ্ডবদের প্রতি অবজ্ঞার ভাব হলো না।' একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে অথবা বিগত শতাব্দীতেও দাম্পত্য সম্পর্কে এমন দৃশ্য খুঁজে পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমার আত্মজাকে দ্রৌপদীর দাম্পত্য জীবনে প্রবেশের প্রথম দিনের খণ্ড দৃশ্যটির বিবরণ দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, সে কবে বিয়ে করবে বলে ভাবছে অথবা দাম্পত্য সম্পর্কে তার ভাবনা কী? কন্যার সোজাসাপটা উত্তর, 'খবরে পড়েছি এই ঢাকা শহরে বছরে গড়ে তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে বিয়ে করার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।'
দুটো ছবিই যার যার প্রেক্ষাপটে এক ধরনের চরম অবস্থার কথাই বলে। একাধিক স্বামীর পায়ের বালিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া আর অন্যদিকে নতুন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে উপলব্ধ সত্য। তাহলে ঠিক কোথায় এসে আজকে দাঁড়াল দাম্পত্য নামে নারী ও পুরুষের সুপ্রাচীন এই সম্পর্ক? কোথাও দাঁড়াল তো নিশ্চয়ই। সমাজে এখনও সংসার নামের প্রতিষ্ঠানটি টিকে আছে। এই কাঠামোকে প্রতিষ্ঠান বলাই ভালো। কারণ, দাম্পত্য সম্পর্কের ভিত্তিতে যা গড়ে ওঠে সেটার একটা নিয়ম আছে, রীতি আছে, সংস্কৃতিও আছে। বহু বছর ধরে একটু একটু করে এই নিয়ম, রীতি আর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এবং আবার তা ভাঙনের মুখেও চলে গেছে।
আমার দাদুর বিয়ে হয়েছিল এগারো বছর বয়সে। বর এসেছিল হাতিতে চড়ে। নাবালিকা পাত্রী সেই হাতি দেখতে ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে গিয়েছিল। তারপর চৌদ্দ বছর বয়সে বৈধব্যের সাদা শাড়ি ঘেরাও করে ফেলে তাঁর জীবনের বাকি অধ্যায়গুলোকে। পঁচাশি বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে সেই ভদ্রমহিলা দুই সন্তান নিয়ে জীবন কাটিয়ে গেছেন। নিজের দাম্পত্য জীবনের সীমানা ফুরিয়ে কখনও পুত্রের, কখনও কন্যার দাম্পত্য জীবনের ভিতরে একবচন হয়ে জীবন কাটিয়ে গেছেন। দ্রৌপদীর মতোই স্বামীর স্মৃতির পায়ের কাছে বালিশ হয়ে কেমন ছিল তাঁর সেই জীবন?
দাম্পত্য জীবন দু'জন মানুষের যৌথ সময়ের গল্প। ঘুম থেকে জেগে ওঠার মুহূর্তে অথবা ঘুমিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত একই ঘর, একই শয্যার মানচিত্রে বেঁচে থাকা একজন পুরুষ ও একজন নারী দুটি পৃথক নৌকা পাশাপাশি বেঁধে অনেকটা পথ অতিক্রম করতে চায়। দাম্পত্য সীমান্তে এই একসঙ্গে পথ অতিক্রম করতে চাওয়াটাই হয়তো বিয়ের মূলমন্ত্র; একসঙ্গে থাকাটা নয়। দাদুর প্রসঙ্গে ফিরে আসি আবার। অনেকগুলো বছর তিনি একা একা কাটিয়ে দিলেন ছোট্ট একটু সময়ের দাম্পত্য জীবনের স্মৃতি নিয়ে। মনে মনে হয়তো একটা সংসারই করে গেলেন; একজন মানুষের রোজ খবরের কাগজ পড়ার স্মৃতি, দরজায় দাঁড়ানোর ভঙ্গি, ছোটখাটো দু-একটি কথা, উপহার দেওয়া বইতে শুকনো গোলাপের কয়েকটা পাপড়ির স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই পথটা অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন হয়তো। এভাবে অবয়বহীন, শরীরহীন মানুষের স্মৃতির সঙ্গে দাম্পত্য জীবন কাটানো যায়! জীবনের স্টেজে দাম্পত্যের দ্বিতীয় পর্দা ওঠার সুযোগ তৈরি করতে তাঁর মন ছুটে যায়নি কখনও? নাকি নিঃসঙ্গ জীবনে শরীর আর মনের আবেগের গতিমুখ ঘুরিয়ে দেয় স্নেহ, ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ? মনের সেই গহিন গল্প জানা হয়নি কোনোদিনই।
এখনকার পৃথিবীতে দ্রৌপদীর কাহিনি বেঁচে নেই, বেঁচে নেই দাদু মোসাম্মৎ হাসিনা বানুর গল্পও। একদা ভিন্ন একটি সংসারে বিয়ে হয়ে আসা নারীটিকেই বলা হতো নতুন ধারাপাতে নিজেকেই মানিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু এখন সেই পর্বের অনেকদূর অবসান ঘটেছে। এখন এই সম্পর্কের উভয় যাত্রীকেই মানিয়ে নিতে হয়, মেনেও নিতে হয়। তারা মানিয়েও নেন। কিন্তু এর পরেও একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে একজন তরুণী দাম্পত্য সীমান্তের পথটা পার হতে ভয় পাচ্ছে, শঙ্কিত হয়ে একা একা জীবন কাটানোর কথা ভাবছে দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে সংসার জীবনে আস্থার ভূমিকাটা নড়বড়ে হয়ে গেল?
চির পরিচিত ঘর, শয্যার একই মানচিত্র মধ্যবয়সী অনেক দম্পতির কাছে অচেনা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি সব সময় যে নেতিবাচক কারণেই ঘটতে শুরু করবে, এমন কোনো কথা নেই। কখনও পুরোনো দাম্পত্য সম্পর্কের সীমানায় দাঁড়িয়ে দু'জন মানব-মানবীর মনের গড়নটাই পাল্টাতে শুরু করে। হাসিনা বানুর বৈধব্যের বেদনার অনুভূতি পাল্টে গিয়েছিল স্নেহে, দায়িত্ব পালনে অথবা ভিন্ন এক ভালোবাসায়। বিবাহিত দু'জন মানুষের মনের গড়নটাও তেমনি পাল্টে যেতে পারে নির্ভরতায়, আস্থায়, বন্ধুত্বে। তীব্র ভালোবাসার মধ্য দিয়ে যে জীবনের সূচনা, সেখানে এসে ঘর বাঁধতে পারে নির্ভরতার নিভৃতি। কখনও এই পরিবর্তনের রূপরেখা বুঝে উঠতে পারেন না অনেকে। দাম্পত্য সীমান্তে সেখানেই সংকটের সূচনা হয়। দু'জনের মাঝে একজন হয়তো বুঝতেই চায় না শুধু একরোখা ভালোবাসা মানব-মানবীর সম্পর্ককে কাঁধে করে নিয়ে পুরোটা পথ চলতে পারে না। সেখানে অনেকগুলো উপাদানের প্রয়োজন হয় সময়ের ভারে চাপা পড়া সম্পর্কটাকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে।
বিবাহ প্রতিষ্ঠানটির মাঝেই জন্মজন্মান্তরের মতো একে-অপরের হয়ে যাওয়ার আশ্বাস থাকে। সবাই ভাবে, সামাজিক অনুশাসন, নিয়ম, 'কবুল কবুল' উচ্চারণ অথবা মন্ত্র পাঠের মধ্য দিয়ে একটি চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে অনুমোদন দিয়ে দেওয়া গেল। কিন্তু বাস্তবে কি তাই ঘটে দাম্পত্য সম্পর্কে? আসলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বিয়েকে একটা বেলুনের মতো ফুলিয়ে উপস্থাপন করে। দু'জন মানুষ তাই এই সম্পর্কের আওতায় এসে বিয়ের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে ভারমুক্ত হয়ে জীবনের অন্য অনুষঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একটা সময় তারাই আবিস্কার করে নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতার লেনদেন কমে গেছে। জীবনকে মনে হচ্ছে মুখস্থ হয়ে যাওয়া একটা বই। যদি বলা যায়, হাসিনা বানুর বিয়ে, সংসার তাঁর স্মৃতিতে ছিল বলেই তা টিকে গিয়েছিল? তাঁর দাম্পত্য জীবনের বয়স বাড়লে সেখানেও কি মাথা তুলত বোঝাপড়ার অভাব, অভ্যাসের একঘেয়ে অনুভূতি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন নয়।
'মেনে নেওয়া' আর 'মানিয়ে নেওয়ার' যে চাদরটা দাম্পত্য সীমান্তে সম্পর্ককে ঢেকে ফেলে হাসিনা বানুর ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। তারপর তারা এভাবেই বেঁচে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত মানসিকভাবে, যার পুরোটা হয়তো তারা অনুভব করতেও সমর্থ হতেন না।
কবি বিষুষ্ণ দে কবিতায় লিখেছিলেন, 'অভ্যাস শুধু অভ্যাস লিলি, তাই তো আসি।' এই অভ্যাস হয়ে যাওয়ার মানসিকতাই দম্পতিদের আজও বিয়ে নামের বইয়ের মলাটটা ঠিক রাখতে তৎপর করে রাখে। তারা হয়তো ভাবেন, ভিতরটা পাল্টে গেলে যাক, খোলসটা তো অবিকৃত থাকল। আর এই মলাট ঠিক রাখার খেলা খেলতে খেলতে তারা একটা সময়ে আবিস্কার করেন একসঙ্গে থাকা তাদের জীবনে ঢুকে পড়ছে আরও অনেক চরিত্র: হারিয়েছে নিজেদের একান্ত সময়। তাই হয়তো অনেকে চান, বিয়ে যুগের অবসান হোক। পথ বেঁধে রাখার চাইতে পথটা খোলা থাকাই তো ভালো। রবীন্দ্রনাথ তো লিখেই গেছেন, 'পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।' অনেক বছর আগে গ্রামের বাড়ির পুকুরঘাটের পোশাক পাল্টানোর ঘরটার দেয়ালে পেন্সিল দিয়ে কেউ লিখে রেখেছিল এই লাইন। কিশোর বয়সে পড়ে অবাক লেগেছিল। আরেকটু বড় হয়ে ভেবেছি, নিশ্চয়ই বাড়ির জ্যেষ্ঠ সদস্যদের কেউ তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথের লাইন দেয়ালে লিখে দিয়েছিলেন। ভালোবাসার অনুভূতির বাইরে আর কোনো গভীর ভাবনা তাকে তাড়িত করেছিল বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু বন্ধনহীন গ্রন্থি বিষয়টা আমাকে ভাবিয়েছে। যখন নারী ও পুরুষের যৌথ সম্পর্কের মধ্যে 'লিভ ইন' প্রথাটা প্রবল বেগে ঢুকে পড়ল, পৃথিবীজুড়ে আলোড়ন তৈরি হলো ভাবলাম, এই হয়তো বন্ধনহীন গ্রন্থি। দু'জন মানুষ একই ছাদের তলায় কোনো ধরনের সামাজিক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর না-করে দাম্পত্য সম্পর্কে জড়াতে চাইছে। তাদের ঘরের দুয়ার খোলা আছে সহজে বিদায় নেওয়ার জন্য। বিয়ে নামের প্রথার বিরুদ্ধে এ এক বিদ্রোহ। কেউ কেউ বলেন, মন এবং শরীরের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া হয় এই পন্থায়। তাহলে বিবাহ নামের এই প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা টিকে থাকল কেন! জানতে ইচ্ছে করে, পৃথিবীর মানব-মানবীরা আসলে কী চায়? এই লেখা লিখতে লিখতেই টেলিফোনে এক বন্ধুর বার্তা এলো। বিয়ের দিনের একটি ছবি দিয়ে সেই বন্ধু লিখেছেন, তাদের বিবাহিত জীবন আজ চব্বিশ বছর অতিক্রান্ত হলো। যৌথ জীবনের জন্য তারা সবার শুভেচ্ছা কামনা করছেন। বন্ধুর পাঠানো ওই খুদেবার্তাটি পাঠ করতে করতে ভাবছিলাম মানুষ আসলে কী চায়? সংসার, যৌথ জীবনের মধু, সন্তান কোলে তুলে নেওয়ার মাঝে নারীর জীবনের একধরনের পূর্ণতার অনুভূতি, পুরুষের সাফল্যের গল্পটাও রয়ে গেছে একবিংশ শতাব্দীর এই টালমাটাল সময়ে? যে সময়টা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে, ইচ্ছার স্বাধীনতাকে সমর্থন করে, যে সময়টা পুরুষকেও প্রতারণার পথ বেছে না-নিয়ে স্বাধীন ভাবনাকে বিকশিত করার কথা বলে।
দাম্পত্য সীমান্তে একজন নারী অথবা একজন পুরুষ আসলে স্বাধীনতার সন্ধান করে। দু'জন মানুষের যৌথ জীবনে কখনোই একে-অপরকে দখল করতে পারে না। মাঝে খানিকটা জমিন 'নো ম্যানস ল্যান্ড' হয়ে থাকে, থাকতে হয়। সেটুকুই হয়তো নিঃশ্বাস ফেলবার জায়গা হয়ে বাঁচায়। বিবাহ নামের বইয়ের মলাট এবং ভেতরটাও অবিকৃত থাকে। কিন্তু তাই কি ঘটে বাস্তব জীবনে? মহাভারতেই উল্লেখ আছে পাঁচ স্বামীর একমাত্র স্ত্রী দ্রৌপদী অর্জুনের প্রতি দুর্বল ছিলেন, পাঁচ স্বামীর মাঝে অর্জুনকেই অধিকার করতে চেয়েছিলেন খানিকটা বেশি। সেই পক্ষপাতে তার বাকি স্বামীরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন কিনা জানা নেই। আমরা দাম্পত্য জীবনে অধিকার বোধের কাহিনি লিখতে গিয়ে এই সত্যটাই হয়তো ভুলে যেতে বসি।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com