অন্যদৃষ্টি

আন্তঃমশানগর লোডশেডিং

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০৪:৫৭ | প্রিন্ট সংস্করণ

এস এম সাব্বির খান

মাঘের শীতে বাঘ আদৌ কাঁপে কিনা, তা নিয়ে ঢাকাবাসীর মনে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। রাজধানীতে আধিপত্য বিস্তারে চুটকো মশাদের যে বেপরোয়াপনা নজরে পড়ছে, এর কাছে হালের উঠতি নেতাদের ঔদ্ধত্যও রীতিমতো নস্যি। অসহায় নগরবাসী নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে ঠিক। তবে লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা, যখন আধুনিক নগরীর অত্যাধুনিক মেট্রোরেলের বিলাসী বগির ভেতর যাত্রীদের নিজের কানে-গালে উদ্‌ভ্রান্তের মতো চড় কষতে দেখা যায় এই মশাদের কারণে।

শতভাগ বিদ্যুতায়নের অনন্য সাফল্যের আনন্দে আত্মহারা দেশবাসী। কিন্তু উচ্ছ্বসিত করতালি থামার আগেই দেখা গেল প্রতি তালির তালে তালে বিদ্যুৎ আসে আর যায়! তবে তিলোত্তমা নগরীর নাগরিকরাও নাছোড়বান্দা- থামবে না; করতালি চলবেই। এতে মন্দের ভালো হলো, অন্তত তালির তালে তালে লোডশেডিংয়ের একটা সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে ভাগ্যগুণে যদি দু-চারখান মশা তালির সময় তালুর তলায় পিষে মারা যায় তো মন্দ কী!

গত প্রায় এক যুগে পরিবেশ অধিদপ্তর দেশে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করেছে আড়াইশ কোটি টাকার মতো। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যানমতে, আগের ১০ বছরে পরিবেশ অধিদপ্তর দেশে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ২২১ কোটি টাকা খরচ করেছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণের অর্থে 'নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ' নামের প্রকল্পের (কেইস) মাধ্যমে এই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। যার অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ১২৩ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছিল প্রশিক্ষণের নামে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর, পরামর্শক ফি, গাড়ি কেনা ও ভবন নির্মাণে। ২০০৯ থেকে '১৯ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল ওই প্রকল্প। শতকোটি টাকার ব্যয় নিপাত গেছে বায়ুদূষণের প্রাবল্য বৃদ্ধিতে। এ ছাড়া ২০২২ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশের জিডিপির ৩ দশমিক ৯ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে শুধু বায়ুদূষণের কারণে। এদিকে দূষণ বাড়ার সংবাদ নজরে এলেই নামে নগর সংস্থার পানি ছিটানোর গাড়ি। এতেই যদি সমস্যার সমাধান সম্ভব হতো, তাহলে শতকোটি ব্যয়ের যৌক্তিকতা কী?

রাজধানীবাসীকে মশা থেকে রক্ষা করতে দুই সিটি করপোরেশনের বর্ণাঢ্য আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবছরই বরাদ্দ বাড়ে; সেই সঙ্গে বাড়ছে মশাও। এ খাতে গত ৯ বছরে ব্যয় হয়েছে ৬৩৬ কোটি টাকা। ফলাফল, মাঘের শীতেও মশার নজিরবিহীন বিস্তার। কামান দাগার প্রাচীন প্রথা ফেলে নামানো হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তির আধুনিক ড্রোন। তাতেও বাগে আনা যায়নি মশকবিভ্রাট। তবে পরিস্থিতির অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর সিটির মেয়র যে ভুল স্বীকারের সৎ সাহসটুকু করেছেন, সে জন্য তাঁকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের গিরিখাদে না হয় নাই নামলাম।

এ তো মাত্র নগরবাসীর ত্রিবেদনের ছোটগল্পটুকু। নগরসেবার তীর্থস্থানখ্যাত ওয়াসা ভবনের ত্রিসীমানায় নাইবা গেলাম। এ শহরের বাসিন্দাদের প্রায় প্রতিদিন শুরু হয় ঘুম থেকে উঠেই গ্যাস সংকটে বন্ধ চুলার খেদ নিয়ে। সড়কে নামতেই প্রাতরাশ জোটে মিহি ধুলার লালচে গুঁড়া। প্রকল্প, সংস্কার আর উন্নয়নের পাশ কেটে যানজট ঠেলে কর্মস্থলের পথে এগিয়ে যাওয়া, বাড়ি ফেরা। বিনোদন বলতে নিত্যবাজারের দ্রব্যমূল্যের মশকরা, সাডেন প্রাইজ কুইজ, ক্রেতা-বিক্রেতার রোমাঞ্চকর বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিশেষ গোষ্ঠীর 'জনস্বার্থ'তত্ত্বের দ্ব্যর্থ রসিকতা আর তাঁদের সঙ্গে সভ্য সমাজের কতিপয় সুধী-সুশীলের সচেতন মতিবিভ্রাট।

পৃথিবীর আর কোনো নগরের মানুষ নিত্যজীবনের এমন নিকৃষ্টতা আর নৈরাশ্যের নাশকতা সয়ে বাঁচার জন্য স্বপ্ন দেখতে আর হাসতে শিখেছে কিনা জানা নেই। এর পরও থেমে থাকার সুযোগ নেই। কালের পরতে জমা হাজারো প্রতিশ্রুতি, প্রত্যাশা ও প্রবৃদ্ধির প্রহসনমূলক বচন নিয়ে অজানা আগামীর পথে আপন গতিতে ছুটে চলেছে রাজধানী ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা দূষিত আন্তঃমশানগর লোডশেডিং এক্সপ্রেস।

এস এম সাব্বির খান: সাংবাদিক

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com