মতামত

বাংলা ভাষা টিকিয়ে রাখতে হবে আমাদেরই

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ১৯:০৫ | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ২৩:০২

শাহিদ মোবাশ্বের

ভাষা সংস্কৃতিকে বৈচিত্র্যময় করে তোলে এবং সংস্কৃতি ভাষায় নতুনত্ব আনয়ন করে। কোনো সংস্কৃতির ভাষা যখন হারিয়ে যায় তখন ওই সংস্কৃতির একটি অংশও হারিয়ে যায়। আমরা হারাই আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গহানি ঘটে! আবার একইভাবে বলা যায়, ভাষা সংরক্ষিত হলে ওই ভাষা ব্যবহারকারীদের হৃদয়ে ঐতিহ্য ও প্রথার সজীব উপস্থিতি বিরাজ করে! সে কারণে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনে ভাষার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। 

ইউনেস্কো বলছে, বর্তমান বিশ্বে ৭ হাজার ভাষা চালু রয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭০০ আদিবাসীর ভাষার অনেকগুলো হুমকির সম্মুখীন! এ ভাষাগুলো থেকে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে মোট প্রায় ৩ হাজার ভাষার বিলুপ্তি ঘটতে পারে চলতি শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই!

খোঁজযন্ত্র গুগল বলছে, স্বদেশি ভাষায় কথা বলার দিক থেকে বাংলা পৃথিবীর পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। আর পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার দিক থেকে সপ্তম বৃহৎ সংখ্যক মানুষের ভাষা বাংলা। ৩০ কোটি স্বদেশি ভাষাভাষী এবং আরও ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা। সব মিলিয়ে প্রায় ৩৪ কোটি মানুষের ভাষা বাংলা।

উইকিপিডিয়ার গত ২০২২ সালের ২৫তম সংস্করণের তথ্য অনুযায়ী বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ অবস্থানে রাখা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর ৪ শতাংশ অর্থাৎ ২৩৩.৭ মিলিয়ন মানুষের প্রথম ভাষা বাংলা।

বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। দেশটির জাতীয় ও দাপ্তরিক ভাষাও বাংলা। আর ভারতের ২৩টি দাপ্তরিক ভাষার একটি বাংলা। দেশটির পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বারাক উপত্যকার দাপ্তরিক ভাষা বাংলা। ২০১১ সাল থেকেই দেশটির ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে বাংলা। এ ছাড়া ভারতের বিহার, মিজোরাম, ওড়িশা, মেঘালয়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলা ভাষী মানুষের বসবাস রয়েছে। মোট কথা আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর সব প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাংলা ভাষাভাষী ৩৪ কোটি মানুষ।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী ছাত্র ও আন্দোলনকারীরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরণের দাবিতে যে আন্দোলন করেছিল সেই কষ্টার্জিত ভাষা আন্দোলনের ফল আমরা আস্বাদন করতে পেরেছি। ওই আন্দোলনকারীদের মধ্যে যারা জীবন উৎসর্গ করেছিল তাদের ত্যাগ আর জীবন উৎসর্গীকরণ বৃথা যায়নি। ১৯৮৭ সালেই বাংলাদেশে সব রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। অতঃপর ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ওই ত্যাগের মহিমাকে উজ্জ্বল করেছে! এর পাশাপাশি পশ্চিম আফ্রিকার ক্ষুদ্র দেশ সিয়েরালিওনের গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০২ সালে বাংলা ভাষাকে দেশটির অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

সারাবিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৩৪ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের, বিশেষত শিক্ষিত সচেতন শ্রেণির প্রত্যাশা নিজেদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে মাতৃভাষা বাংলার চর্চা অব্যাহত থাকৃক, স্বগৌরবে টিকে থাকুক। এই প্রত্যাশা বাস্তবায়ন প্রচেষ্টায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মহান ভাষাশহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপন করা হয়। তেমনি এক প্রচেষ্টার নাম- ওয়াশিংটন ডিসি অমর একুশে পালন।

দিনটিতে বিভিন্ন দেশের লোকজনের মাঝে একুশে ফেব্রুয়ারি ও ইউনেস্কো কর্তৃৃক দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়। এ ছাড়াও ১৯৫৩ সালের প্রথম গান, প্রথম বাংলা নাটক, প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ইত্যাদি বিষয়ের পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, নাটক ইত্যাদি আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। তবে বাংলা ভাষাচর্চা, প্রসার ও রক্ষা সংক্রান্ত সার্বজনীন কর্মকৌশল নিয়ে কোনো সরব আলোচনা চোখে পড়ে না! এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাসহ বাংলা ভাষাভাষী সব অঞ্চলের সরকারি পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা অত্যাবশ্যক। আর বিষয়টি যেহেতু মানবীয় যোগাযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই ওই কমিটিতে অভিজ্ঞ যোগাযোগবিদদের অন্তর্ভুক্ত করে সবার মতামতের ভিত্তিতে এই ভাষার চর্চা, প্রসার ও রক্ষা সংক্রান্ত একটি সার্বজনীন কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ!

আমরা যারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর কানাডার মতো পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে বসবাস করি তাঁদেরই এই সার্বজনীন কর্মকৌশল প্রণয়ন নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের বাংলা ভাষা চর্চা, প্রসার ও রক্ষাবিষয়ক আলোচনা করে ব্যাপক জনমত তৈরি করতে হবে। সেসঙ্গে ওই আলোচনার সুপারিশগুলো সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে হবে। কাজটি হবে এক ধরনের প্রেসার গ্রুপের মতো।

সেই সঙ্গে বাংলা বই পড়ার অভ্যাস শুরু করতে হবে ব্যক্তি পর্যায় থেকেই। কেননা শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। আর তাই ঘরে ঘরে লাইব্রেরি গড়ে তুলে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। লাইব্রেরি গড়ে আমাদের সন্তানদের স্বচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে, শিক্ষার পথ দেখিয়ে দিতে হবে, তাদের মাঝে কৌতূহল আর জ্ঞানপিপাসাকে জাগিয়ে দিতে হবে এবং তাদের মনোরাজ্যে ঐশ্বর্যের সন্ধান দিতে হবে। আর তা করতে হবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার মধ্যদিয়ে।

নেলসন ম্যান্ডেলা একদা বলেছিলেন, 'যে শুধু বুঝতে পারে, তার সাথে যখন তুমি কথা বলো তখন তা তার মস্তিস্ক পর্যন্ত পৌঁছায়, আর যখন তুমি তার নিজ ভাষায় কথা বলো তখন তা তার অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়!' এর অর্থ এই যে, আমরা যেন আমাদের সন্তানদের সঙ্গে মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলি যাতে করে আমাদের বার্তা তাদের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

আমরা যেন আমাদের সন্তানদের এ কথা শেখাই যে, সাহিত্যচর্চা শিক্ষার প্রধান অঙ্গ। সাহিত্যচর্চাই তার মনকে সচল আর সমৃদ্ধ করতে পারে। তার দর্শন, অন্তরের স্বপ্ন, আশা-নৈরাশ্য, অনুরাগ-বিরাগ, দর্শন, ধর্মনীতি, বিজ্ঞান- এসব কিছুর সমন্বয়েই সাহিত্য। তাদের আরও শেখাই যে সাহিত্যচর্চার মাধ্যমেই প্রত্যেক মানুষ তার স্বীয় শক্তি ও রুচি অনুসারে নিজের মনকে নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। মনকে সজাগ ও সবল রাখতে না পারলে জাতির প্রাণ যথার্থ ফুর্তি লাভ করে না; অতপর যে জাতি যত নিরানন্দ সে জাতি তত নির্জীব। একমাত্র আনন্দের স্পর্শে মানুষের মনপ্রাণ সজীব ও সতেজ হয়ে ওঠে। সুতরাং, সাহিত্যচর্চার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অর্থই হচ্ছে জাতির জীবনীশক্তি হ্রাস করা। একমাত্র বই পড়েই এই সাহিত্যচর্চা সম্ভব। আর সেই বই হতে হবে মাতৃভাষার তথা বাংলা বই।

সন্তানদের আরও শেখাই যে আমাদের সবচেয়ে পছন্দের শখগুলোর অন্যতম হচ্ছে বই পড়া। বই মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলে! আর বই পড়ে তথা সাহিত্যের রস আস্বাদন করার মাধ্যমেই জীবনকে মহৎ আর সুন্দর করা যায়! নিজ ভাষা তথা বাংলা ভাষার বই পড়েই তা আরও বেশি করে অর্জন সম্ভব। তবে সাহিত্যচর্চার জন্য চাই লাইব্রেরি। আর তাই ঘরে ঘরে লাইব্রেরি গড়ে তুলে সন্তানদের জীবনকে মহৎ আর সুন্দর করে তুলি!

উন্নত বিশ্বে বসবাসকারী আমরা অনেকেই সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি! বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কায় থাকে বহু মাতা-পিতা! এসব বিপথগামিতা থেকে তাদের বিরত রাখার অন্যতম কৌশল হতে পারে বই পড়া। সে ক্ষেত্রে সন্তানদের মাঝে ইরানি দার্শনিক ও কবি ওমর খৈয়ামের উক্তি- মদ রুটি ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, কিন্তু বই, সে তো অনন্ত যৌবনা, যদি বইয়ের মতো বই হয়- ছড়িয়ে দিতে হবে।

৩৪ কোটি বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা পৃথিবীর বুকে স্বগৌরবে টিকে থাক এবং পারিবারিকভাবে প্রাত্যহিক জীবনে বাংলা চর্চার মাধ্যমে ঘরে ঘরে এ ভাষা জাগ্রত থাকুক- এই আমাদের প্রত্যাশা!

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com