
প্রতিবেশী
মোশাররফের শাসন যা শিখিয়েছে
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০৪:৫৪ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইয়াসের লতিফ হামদানি

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ রোববার দুবাইর এক হাসপাতালে মারা গেছেন। প্রোটিন বৃদ্ধির কারণে কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ অচলকারী অ্যামাইলোডসিস নামক জটিল ও বিরল এক রোগে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর ব্রিটিশ নৌ সেনা ও ইতিহাসবিদ হ্যারল্ড কোর্টনি আর্মস্ট্রংয়ের কথা মনে পড়ছে আমার, যিনি তাঁর তুর্কি জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের জীবনীভিত্তিক বই 'গ্রে উলফ'-এ লিখেছেন- কামাল আতাতুর্ক একজন স্বৈরশাসক ছিলেন, তাই এখন তুরস্কের নতুন কোনো আতাতুর্কের প্রয়োজন নেই। তবে দুঃখের বিষয়, মোশাররফ আতাতুর্ক ছিলেন না।
আমার এখনও মনে আছে, ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর মোশাররফ যখন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন, তখন আমি রাটগার্স ইউনিভার্সিটি, নিউ ব্রান্সউইক, যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অ্যাভিনিউতে একটি কম্পিউটার ল্যাবে কাজ করছিলাম। আমার এক পাকিস্তানি আমেরিকান বন্ধু এসে বলল, এটি পাকিস্তানের জন্য খারাপ হবে। কিন্তু আমি বলেছিলাম, নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানের সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশটিকে একটি পূর্ণ ধর্মতন্ত্রে পরিণত করছিলেন, যা জেনারেল জিয়াউল হকের ইসলামীকরণের চেয়েও বাজে ছিল। মোশাররফের অভ্যুত্থান অসাংবিধানিক হলেও শরিফের 'আমিরুল মুমিনিন' হওয়ার প্রচেষ্টা ভন্ডুল করে দেয়। বেনজির ভুট্টোর মতো গণতন্ত্রীরাও তাই মোশাররফকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
মোশাররফ দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আদর্শের পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা হবে একটি উদার ও প্রগতিশীল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। একজন ধর্মনিরপেক্ষ, উদারপন্থি হিসেবে মোশাররফ নিজ পরিচয়কে শক্তিশালী করতে কামাল আতাতুর্ক ও তুর্কি মডেলের কথা বলেছিলেন। জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল, এর প্রতিকার হিসেবে তিনি যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীও পুনরুদ্ধার করেন। তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি আন্তর্জাতিক প্রকাশনাকে বলেছিলেন, নতুন সরকার পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ করতে চায়। তবে প্রত্যাশিতভাবেই ধর্মীয় দলগুলো এর বিরোধিতা করে এবং এটিই মোশাররফকে পিছু হটতে বাধ্য করে।
২০০২ সালের দিকে তিনি সনাতন রাজনীতিবিদদের ওপর নির্ভর করার পাশাপাশি এর সঙ্গে আপস শুরু করেন। সে বছর মোশাররফ পাসপোর্ট থেকে ধর্মের কলাম (জেনারেল জিয়ার শাসনামলে যুক্ত) সরিয়ে দেন। কিন্তু এ পরিবর্তনটি তিনি ধরে রাখতে পারেননি; ধর্ম কলামটি নীরবে পূর্বের স্থানে ফিরে আসে। মোশাররফ যে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী পুনরুদ্ধার করেন, সেখানে তাঁকে এটি নিশ্চিত করতে হয়- আহমদিয়া সম্প্রদায় আগের মতোই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে।
নতুন ভোটার তালিকায় হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান ও মুসলিম একই সঙ্গে থাকলেও আহমদিয়াদের স্থান হয়নি। তাদের জন্য একটি সম্পূরক ভোটার তালিকা করা হয়েছিল। এটি ছিল আতাতুর্ক হতে চাওয়া নেতার আরেকটি পশ্চাদপসরণ। তিনি তখন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পরিবর্তে পাকিস্তানে একটি আধুনিক উদার ইসলামী প্রজাতন্ত্রের কথা বলতে শুরু করেন। এ বিষয়ে অবশ্য তিনিই প্রথম নন। দেশটি ১৯৫৬ সালে প্রথম একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের প্রথম সামরিক স্বৈরশাসক আরেকজন আতাতুর্ক হতে প্রত্যাশী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান দেশের নাম পরিবর্তন করে 'পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র' রাখেন। কিন্তু মাত্র কয়েক মাস পর তিনি এটিকে আবার ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করেন।
তা সত্ত্বেও মোশাররফের শাসনামলে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক ছিল। দেশটি সামাজিকভাবে উদার ছিল এবং ১৯৮০-এর দশক থেকে পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক রক্ষণশীল নীতির বেশিরভাগই বাতিল করা হয়েছিল। এর ফলে পাকিস্তানের ফ্যাশন ও মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। নারী-পুরুষ সমন্বয়ে মিশ্র ম্যারাথনের মতো ইভেন্টগুলো লাহোরের মতো শহরে নিয়মিত বার্ষিক খেলায় পরিণত হয়। বসন্ত উৎসব দেশটিকে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ঠাঁই করে দেয়। মিডিয়াও উন্নতি লাভ করে; প্রচুর সংখ্যক টিভি চ্যানেল সক্রিয় হয় তখন। নানা বিষয়ে বিতর্কের মানও হঠাৎ উন্নত হয়।
২০০২ সালের পাকিস্তানে ফিরে আসি আমি। তখন দেশটিকে প্রাণশক্তিতে ভরপুর বলে মনে হয় আমার। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হতে শুরু করে এবং লাহোরের বাজারগুলো ভারতীয় পর্যটকে ভরে যায়। ভারতীয়রা কার্গিল যুদ্ধের জন্য সরাসরি মোশাররফকে এবং সম্ভবত যথাযথভাবেই দায়ী করা সত্ত্বেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। এমনকি কাশ্মীর বিরোধও এক রকম সমাধানের দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল।
মোশাররফের পতন শুরু হয় ২০০৭ সালে। একই বছরের মার্চ মাসে তিনি স্বেচ্ছাচারীর মতো পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে বলেন। তা মান্যতা না পেলে মোশাররফ 'এমনকি' তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে অকার্যকর করার চেষ্টা করেন। স্বাভাবিকভাবেই এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আইনজীবীদের বিক্ষোভ হয়। যদিও এই বিক্ষোভগুলো প্রাথমিকভাবে অহিংস ছিল, সরকার তাঁদের ওপর দমনপীড়ন চালায়। করাচিতে মোশাররফের সহযোগী মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) আইনজীবী এবং বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণ করলে ১২ মে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে। শুরু হয় 'বিচার বিভাগ বাঁচাও আন্দোলন'।
একই সময়ে ইসলামাবাদের লাল মসজিদে বিদেশি জঙ্গিদের আশ্রয় দিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদীদের একটি দল 'অনৈসলামিক' কার্যকলাপে জড়িত থাকার জন্য চীনা ব্যবসা বিশেষ করে ম্যাসাজ পার্লারগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করতে শুরু করে। এর আগে একই গোষ্ঠী ইসলামাবাদে একটি শিশু গ্রন্থাগার দখল করে, সরকার যাদের সরাতে পারেনি। চীনারা যখন হুমকির মুখে পড়ে, তখন সরকার সক্রিয় হয়। সেই গ্রীষ্ফ্মে এক অভিযানে কমান্ডোরা লাল মসজিদে দলটির প্রধানকে হত্যা করে। এর পর গণমাধ্যমে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মোশাররফের শাসন একটি প্রবল ঝড়ের মধ্যে পড়ে। আইনজীবীদের সঙ্গে এরই মধ্যে যোগ দেয় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় ধর্মবাদী বিভিন্ন শক্তি। জুলাই মাসে বরখাস্তকৃত প্রধান বিচারপতিকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং অক্টোবরে বেনজির ভুট্টোকে পাকিস্তানে ফিরে আসার অনুমতি দেয় সরকার। নভেম্বরে মোশাররফ জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং তাঁর শাসনের প্রতি অনুগতদের ছাড়া সব বিচারপতিকে সরিয়ে দেন। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, যখন ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর বেনজির ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন। একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এর দায় স্বীকার করলেও জনমত এর জন্য মোশাররফকে দায়ী করে। ২০০৬ সালে প্রবীণ বালুচ নেতা নবাব আকবর বুগতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বেলুচিস্তানে তখন বিক্ষোভ হচ্ছিল। সব মিলিয়ে ২০০৮ সালে নবনির্বাচিত পাকিস্তান পিপলস পার্টি সরকার মোশাররফকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। অবসান ঘটে মোশাররফের ৯ বছরের সামরিক শাসনের।
মোশাররফের উত্থান ও পতন আমাকে এ শিক্ষা দিয়েছে- পাকিস্তানের একজন সামরিক স্বৈরশাসক কখনোই কামাল আতাতুর্ক হতে পারেন না। কারণ, পাকিস্তান সেনাবাহিনী গঠনগতভাবে তুর্কি সেনাবাহিনী থেকে একেবারেই আলাদা। তারা পাকিস্তান গড়ার সংগ্রামে জড়িত ছিল না। কোনো সামরিক জেনারেল নন; একজন আইনজীবী রাজনীতিবিদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ঐতিহ্যে বেড়ে উঠেছিলেন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র এবং বেসামরিক নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই।
তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী টিকে থাকলে এর পরিণতি কী হতে পারত, তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। এরই মধ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষিত একটি দেশে ওই সংশোধনী বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর নাগরিকদের ওপর আরও কঠোর ইসলামী ধারা চাপিয়ে দেওয়ার সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছিল। এটি 'যদিও' অমুসলিমদের ওইসব বিধান থেকে অব্যাহতির কথা বলেছিল, এর সম্ভাব্য ক্ষতি ছিল অপূরণীয়।
সৌভাগ্যক্রমে এমনকি নওয়াজ শরিফ ও তাঁর দল ২০১৩ সালে ক্ষমতায় ফিরে এলেও সেই বিপর্যয়মূলক সংশোধনীকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেননি। মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থান মর্মান্তিক ও উদ্ভট হলেও আমাদের একটি সম্পূর্ণ ধর্মতন্ত্রের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। তা একই সঙ্গে আমার মতো সেক্যুলার পাকিস্তানপ্রত্যাশী মানুষের জন্য এ শিক্ষাও রেখে গেছে- কোনো সামরিক শাসকের পক্ষে সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
ইয়াসের লতিফ হামদানি: পাকিস্তানি আইনজীবী ও লেখক; ভারতের অনলাইন পোর্টাল দি প্রিন্ট থেকে ভাষান্তরিত
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com