টেকসই উন্নয়নে চাই রাজনৈতিক সমঝোতা

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০৫:১১ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমকাল প্রতিবেদক

জাতীয় উন্নয়নের জন্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রধান শর্ত। এ ধরনের নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার খুব প্রয়োজন। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে। গত দেড় দশকে যে উন্নয়ন হয়েছে তাকে টেকসই করা যাবে না। তবে রাজনৈতিক শক্তি সমঝোতায় না এলে সামাজিক শক্তি এগিয়ে আসে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কিংবা ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন এর বড় উদাহরণ।

'রাষ্ট্র এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে ক্ষমতার গতি-প্রকৃতি :বাংলাদেশে যেভাবে পুঁজিবাদের বিকাশ' শিরোনামে এক কর্ম-অধিবেশনে গতকাল রোববার এমন মত এসেছে। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের শেষ দিনে গতকাল এ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান।

অধিবেশনে দর্শকসারি থেকে কথা বলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। এ সময় তিনি বলেন, এক সময় ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করতেন, এখন রাজনীতিকরাও ব্যবসা করছেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত দৃশ্যত সব পর্যায়ের রাজনীতিকরা ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছেন। তাঁরাই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। রাজনীতির মাধ্যমে ব্যবসা করা সহজ। এর মাধ্যমেই ব্যবসা এগিয়ে নেওয়া কিংবা শিল্পকারখানায় নিরাপত্তা দেওয়া যায়।

আলোচনায় সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণ টেকসই হবে না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) কিংবা অন্যান্য উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন হয়ে যাবে। এসডিজি অনুযায়ী গণতন্ত্র উন্নয়নের অংশ। আবার মানবাধিকারও উন্নয়নের অংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও সই করেছে। ড. দেবপ্রিয় বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক শক্তি সমঝোতায় না এলে সামাজিক শক্তি এগিয়ে আসে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন কিংবা ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন এর বড় উদাহরণ। তাঁর মতে, প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা-বাণিজ্য হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ না থাকলে বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা বুঝতে হলে পুঁজি আহরণ এবং পুঁজির গঠন বুঝতে হবে। স্বাধীনতার পর পরিত্যক্ত সম্পদ গ্রহণ ও লুট করা হয়েছে। বিদেশি সহায়তার জন্য এমন সব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। উন্নয়ন ব্যাংক, শিল্পঋণ সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের টাকা মেরে দেওয়া হয়েছে। এর পর শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি হয়েছে। রাষ্ট্রকে শোষণ করে আগামীতেও পুঁজিবাদ এগিয়ে যাবে কিনা, তা এখন বড় প্রশ্ন।

কী ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় বলেন, দেশের প্রয়োজনে নানা সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা মীমাংসা দেখা গেছে। এতে রাজনৈতিক এলিটের বাইরে সামাজিক এলিট শ্রেণিও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বিশেষ করে ১৯৯১ সালে ও ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক সমঝোতা সৃষ্টিতে সামাজিক এলিট শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আগামী দিনেও এ ধরনের প্রেক্ষাপট আসতে পারে।

অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, গত ৩০ বছরে দেশে অন্যায়-অবিচার বেড়ে গেছে। দরিদ্র মানুষেরা নানামুখী শোষণের শিকার হচ্ছে। মনে হয়েছিল, দেশের মানুষ আর বেশি দিন এ অবস্থা মেনে নেবে না। বাস্তবে জনগণ সব অবস্থা মেনেই চলেছে। সঞ্চালনার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আগে বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘাত হতো। এখন সরকারি দলেরই বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংঘাত হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, মৌলিক প্রশ্ন হলো, বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে নাকি রাষ্ট্র বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করবে। মানি পাওয়ার, মাসল পাওয়ার ম্যানিপুলেশন এ তিন শক্তি এক হলে ভোট না দিলেও ভোট হবে। রাতের বেলায় ভোট হবে। এক টাকার কাজ তিন টাকায় হবে। শ্রমিকদের গুলি করা হবে। এ তিন শক্তির বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকের আন্দোলন লাগবে। ছাত্রদের দাঁড়াতে হবে।

অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সিনিয়র গবেষণা ফেলো ড. মির্জা এম হাসান। তিনি বলেন, ৯০-এর দশকে ব্যবসায়ী সমাজ উদার পুঁজিবাদের স্বপ্ন দেখতেন। বাস্তবে তা হয়নি। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় 'বেটার বিজনেস ফোরাম' গঠন করা হয়। তবে পরে তা আর এগোয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর যাঁরা ক্ষমতায় এলেন, তাঁরা জানালেন ব্যবসায়ীরাই নাকি এ ধরনের কোনো প্ল্যাটফর্ম চান না। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই পুঁজি ব্যবস্থা শক্তিশালী হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা থেকে 'আধিপত্যশীল' ব্যবস্থায় যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর নেতারা সরকারপক্ষের লোক হন। যুক্তরাজ্যে সংসদ সদস্য হতে মাত্র ৮০ হাজার পাউন্ড লাগে। আর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ভোলায় একটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হতেও দেড় কোটি টাকা লাগে। রাজনীতির খরচ বেড়ে গেলে আদানি আর ট্রাম্পের মতো লোকের সৃষ্টি হবে। রাজনীতির খরচ কমাতে না পারলে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।

গত ছয় বছর ধরে অর্থনীতিবিদদের সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে সানেম। সম্মেলনের দুই দিনের বিভিন্ন কর্ম অধিবেশনে মোট ৮০টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। ১৫০টি দেশের অর্থনীতিবিদরা আলোচনায় অংশ নেন।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com