
মতামত
ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে মিসরের এলসিসি কেন?
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ১৮:৩২ | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ১৯:১৫
অয়নাংশ মৈত্র

গত ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হিসেবে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে মিসরের রাষ্ট্রপতি আবদেল ফাত্তাহ এলসিসি ভারতে যান। জি২০-এর সভাপতিত্বে থাকা ভারত যখন আন্তর্জাতিক স্তরে তার প্রতিপত্তি বিস্তৃত করতে অন্য কোনো দেশের নেতাকে আহ্বান জানাতে পারত, তখন মিসরের রাষ্ট্রপতিকে প্রধান অতিথি করার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই বিস্ময় ও কৌতূহলের। আরব ও আফ্রিকার সংযোগবর্তী এ দেশের প্রতি ভারতের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ শুধু ভূকৌশলগত কারণেই নয়; ভারতের সমসাময়িক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মিশরের রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানানোর নেপথ্যে ছিল একাধিক কারণ।
রাষ্ট্রপতি এল-সিসি হলেন প্রথম মিসরীয় রাষ্ট্রনেতা, যিনি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সাধারণতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ নেন। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, বিদেশমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারত ও মিসর হলো জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন বা ন্যামের স্থপতি। জোট নিরপেক্ষতার জন্য এই ন্যাম এক জোট। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় মিসরের নেতা আবদেল নাসের, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং যুগোস্লাভিয়ার জোসেপ টিটো জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হিসেবে মিসরের রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণ কিছু কারণে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। যে সময়ে ভারত তার বড় অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তখন মিসর কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া সুন্নি মুসলিম দেশগুলোর কাছে মিসর একটি প্রসিদ্ধ স্থান। ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশে যখন মুসলমান সমাজকে নিয়ে বিশেষ উষ্ফ্মা দেখা দিচ্ছে, মিসরের রাষ্ট্রপতির প্রধান অতিথি হিসেবে আগমন ভারতের চিরায়ত চেহারার সপক্ষেই বার্তা দেয়। ভারত প্রশাসিত কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কিত বিষয় বা নবী সম্পর্কে বিজেপি নেতা নুপূর শর্মার বিভ্রান্তিকর মন্তব্যের পর মিসর খুব একটা উচ্চবাচ্য করেনি।
সাম্প্রতিককালে মিসরীয় ও ভারতীয় বাহিনী যৌথ মহড়া চালিয়েছে। কূটনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে দুই দেশের সম্পর্ক ঊর্ধ্বমুখী। প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের সময় এই সফরে মিসরের রাষ্ট্রপতি দেশটির সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে কৌশলগত স্তরে উন্নীত করেছেন। আফ্রো-আরবীয় এই জাতির সঙ্গে কৌশলগত সুসম্পর্ক ভারতকে কৌশলগত দিক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে দিয়েছে এক নতুন দিশা। একটি বিশেষ সুবিধা। মিসর ও ভারত যৌথভাবে হেলওয়ান থ্রি হান্ড্রেড ফাইটার জেট প্রস্তুত করেছে। মিসর ভারতের কাছ থেকে নানা রকমের সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম অর্জনে আগ্রহ দেখিয়েছে। ভারত যে সময় স্বদেশে প্রস্তুত সামরিক সরঞ্জামের ওপর জোর দিচ্ছে, যদি ভারত ও মিসর যৌথভাবে সামরিক চালিত গভীর রাজ্যে প্রতিরক্ষা হার্ডওয়্যার তৈরি করে, তাহলে ভারতের কাছে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিশাল এবং উদীয়মান বাজারের জন্য বাণিজ্যিক সুযোগের আধিক্য উন্মুক্ত হবে। সফরের সময় নয়াদিল্লি ও কায়রো সন্ত্রাস সম্পর্কিত সমস্যা মোকাবিলায় আরও প্রচেষ্টা চালানোর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। এলসিসির সঙ্গে যৌথ ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, 'সাইবার স্পেসের অপব্যবহার, চরমপন্থি মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া এবং উগ্রবাদ একটি ক্রমবর্ধমান বিপদ। এর বিরুদ্ধেও আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেব।'
মিসর ভারতের একটি ঐতিহাসিক অংশীদার। মোদির সময়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে কায়রো বিশেষ স্থান অর্জন করেছে। উল্লেখ্য, ইউক্রেনের যুদ্ধের আগে মিসর রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর খাদ্যশস্য সরবরাহের বিষয়ে অত্যন্ত নির্ভরশীল ছিল। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারত বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় পণ্যটি রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু মিসর ব্যতিক্রম ছিল; দেশটি প্রায় ৬১ হাজার টন গম ভারত থেকে আমদানি করেছে। মিসরে মন্দা চলাকালীন খাদ্যনিরাপত্তা সুনিশ্চিতকরণে দুই দেশের মধ্যে আরও বোঝাপড়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মিসরের কৌশলগত ও কূটনৈতিক মহলের বেশ কয়েকজন এই লেখকের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় মিসর ও ভারতের মধ্যে সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক আরও মজবুত করার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। ভারত, ইসরায়েল, সংযুক্ত আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে সম্প্রতি তৈরি হয়েছে কৌশলগত গোষ্ঠী আইটুইউটু।
রাষ্ট্রপতি এলসিসির সফরের সময় মিসর ও ভারত অন্তর্জাল নিরাপত্তা, সংস্কৃতি, তথ্যপ্রযুক্তি, যুব বিষয় এবং সম্প্রচারের লাইনে সমঝোতা স্মারক বিনিময় করেছে। মিসরের রাষ্ট্রপতির সফরের সময় আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা এবং অর্থনীতি চাঙ্গা করা। মিসর ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০২১-২২ সালে ৭ দশমিক ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেকর্ড করে। যা এমন এক পর্যায়ে, যখন মহামারি কভিড আন্তঃসীমান্ত ব্যবসা বিধ্বস্ত করে। প্রধানমন্ত্রী মোদি ও রাষ্ট্রপতি এলসিসি পাঁচ বছরের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ১২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন। অধিকন্তু, মিসর সুয়েজ খাল অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতীয় শিল্পের জন্য একটি বিশেষ এলাকা বরাদ্দ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ভারতের রিনিউ পাওয়ার এবং আদানি গ্রুপ 'মোস্ট ফেভারড নেশন' মিসরে সংকট-বিধ্বস্ত অবস্থাতেও আরও বেশি অর্থ বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে।
মিসরে সেনাবাহিনীর দুর্দান্ত প্রতাপ। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্র শাসন ও পরিচালনায়। সেনাবাহিনীর হাতেই রয়েছে প্রভূত ক্ষমতা। সেনাবাহিনী পরিকাঠামো থেকে জ্বালানি সরবরাহের ব্যবসাও করে। রাষ্ট্রপতি আবদেল ফাত্তাহ এলসিসি, যিনি এক বছর ধরে মোহাম্মদ মুরসির প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনি দেশে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই এলসিসির নেতৃত্বে মিসরের বৈদেশিক ঋণ তিন গুণ বেড়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব এই ঋণগ্রস্ত দেশকে আর্থিকভাবে সমর্থন করেছে। মিসর অর্থনৈতিক দুর্বলতার জন্য নাজুক দেশ। অতীতে বহুবার এর আর্থিক সংকটে পড়েছে, কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্ব তা থেকে খুব কমই শিক্ষা নিয়েছেন। দ্রুত পতনশীল অর্থনীতি ঠিক করা রাষ্ট্রপতি এলসিসির জন্য সবচেয়ে কঠিন হবে। প্রধান অতিথি হিসেবে প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রপতি এল-সিসির সফর ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার পাশাপাশি মিসরের কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু সুযোগ উন্মুক্ত করবে বলে আশা রাখা যায়।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com