ওদের পাশে নেই আপনজন

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০২:০২ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাহাদাত হোসেন পরশ

ফাতেমা-আয়েশা। যমজ বোনের কোনটা ফাতেমা আর কোনটা আয়েশা- চেনা বেশ মুশকিল। দু'জনার চুলের যত্ন-আত্তি হয় না তাও তিন বছর। উশকোখুশকো চুলে পেকেছে জট। গতকাল হাসপাতালে নরসুন্দর ডেকে তাদের মাথা ন্যাড়া করার ব্যবস্থা করে পুলিশ। এরপর যমজ বোন চিনতে আরও গোলকধাঁধা। এর মধ্যে ফাতেমা নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে কিছুটা। তবে আয়েশার অস্বাভাবিক আচরণ চিকিৎসকদের ভাবাচ্ছে। সে কথা বলছে একা, হাসছেও একা। শরীরে রাখতে চাইছে না পোশাক।

এদিকে, রাজধানীর উত্তরার নিজ ফ্ল্যাট থেকে যমজ মেয়েসহ শাফানা আফিফা শ্যামীকে (৩৫) উদ্ধারের দু'দিন পার হলেও গত রাত পর্যন্ত তাঁদের সান্নিধ্যে আসেননি কোনো নিকটাত্মীয়। ফলে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ অভাগা এই পরিবারকে নিয়ে পড়েছে মহাফ্যাসাদে। তবে ওই নারীর সাবেক স্বামী রেজওয়ান সাদের খোঁজ পেয়েছে পুলিশ। সংশ্নিষ্ট চিকিৎসক দ্রুত তাঁদের মানসিক হাসপাতালে স্থানান্তর করার পরামর্শ দিয়েছেন। আজ তাঁদের মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর কথা রয়েছে।

সোমবার সমকালের প্রথম পাতায় 'এক কক্ষে যমজ মেয়ে, অন্য কক্ষে অচেতন মা' শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর খবরটি অনেকের মন নাড়া দেয়। অনেক পাঠক সমকাল কার্যালয়ে ফোন করে পরিবারটির সর্বশেষ খবর জানতে চান। এমন মর্মস্পর্শী খবর জানতে পেরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তা গতকাল উত্তরার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসাধীন মা ও দুই মেয়ের খোঁজ নেন।

গতকাল থেকে শাফানা একটু একটু করে কথা বলতে পারছেন। হাসপাতালের চিকিৎসক, সেবিকা ও পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতে তিনি বলেন, 'আমরা তিনজন টানা চার দিন তেমন কিছু খাইনি। আমি রাস্তার মানুষ। আমার আপন কোনো ভাইয়ের হাসপাতালে আসার দরকার নেই। তাদের ছাড়াই আমি চলতে পারব।' এরপর শাফানা তাঁর নিজের ও সন্তানদের জন্য কিছু পোশাক কিনে দেওয়ার অনুরোধ করেন। পরে পুলিশের তরফ থেকে শাফানা ও তাঁর ১০ বছর বয়সী যমজ মেয়ের জন্য দুই সেট করে পোশাকসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দেওয়া হয়।

পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি মোর্শেদ আলম বলেন, 'স্বজনের কাউকে না পাওয়ায় এই পরিবারকে সহযোগিতা করতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে। অনেক দিন তাঁরা খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করতে পারেননি। পুলিশের তরফ থেকে নতুন পোশাকসহ খাবার কিনে দেওয়া হয়েছে। মানসিক হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হলে তাঁদের দেখভালের জন্য একজন নারী দরকার। হাসপাতালে এই ধরনের রোগীকে সহযোগিতা করতে পারে এমন কাউকে আমরা খুঁজছি।'

উত্তরা থানার পরিদর্শক মুজাহিদুল ইসলাম জানান, শাফানার এক সৎ ভাই হাসপাতালে এসেছিলেন। এ ছাড়া আরেকজন দূরসম্পর্কের আত্মীয় আসেন। এর বাইরে তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য এখন পর্যন্ত হাসপাতালে আসেননি। এটা খুবই দুঃখজনক। দুই শিশুর চুল কাটার পর এখন তারা একটু সুস্থ বোধ করছে।

পরিদর্শক মুজাহিদুল আরও বলেন, শুরু থেকে শাফানার সাবেক স্বামী রেজওয়ান সাদকে খোঁজার চেষ্টা করা হয়। সোমবার তাঁর খোঁজ মেলে। তিনিও থাকেন উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরে। রেজওয়ান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, ১০ বছর আগে শাফানার সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়েছিল। শ্বশুর পক্ষের পরিবারের চাওয়াতেই ওই বিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদের সময় শাফানা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন- এটা জানা ছিল না রেজওয়ানের। যমজ সন্তানের বাবা এটা তিনিও জানতেন না।

উত্তরার ওই ফ্ল্যাটের নিরাপত্তারক্ষী আবদুর রহমান জানান, ১৫ দিন ধরে দোতলার ওই ফ্ল্যাট থেকে কাউকে নিচে নামতে দেখেননি। একটা ছেলে এসে মাঝেমধ্যে কিছু বাজার করে দিতেন। তাঁকে অনেক দিন আসতে দেখি না। ৪ থেকে ৫ দিন আগে বিদ্যুতের লোকজন ওই ফ্ল্যাটের বকেয়া বিল চান। তখন ইন্টারকমে বাসার মালিকের সঙ্গে কথা বলি। ফোনের ওপাশ থেকে বলা হয়েছিল টাকা নেই। প্রয়োজনে লাইন যেন কেটে দিতে পারে। ওই ফ্ল্যাটের পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল বকেয়া। সার্ভিস চার্জও বাকি। উদ্ধারের এক দিন আগেও ওই ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে বাচ্চাদের কান্নাকাটির শব্দ শুনেছিলাম। ধারণা করেছিলাম, ক্ষুধার জ্বালায় তারা কাঁদছে।

এমন পরিস্থিতির পর কেন আগেই পুলিশ বা ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দাদের বলেননি- এমন প্রশ্নে নিরাপত্তারক্ষী বলেন, 'তাঁর ভাইবোন ও স্বজনই খোঁজ-খবর নেন না। ছোট চাকরি করি। আমি কীভাবে এসব আগ বাড়িয়ে বলতে যাব। যতদূর জানি, গ্যারেজ ভাড়ার ৪ হাজার টাকাই তাঁর মাসিক আয়। এটা দিয়ে সংসার চলার কথা নয়।'

শাফানার চাচাতো বোন জহুরা রতন রূপা বলেন, বৃহস্পতিবার উত্তরায় শাফানার বাসায় গিয়েছিলাম। ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি করলেও দরজা খুলছিল না। দারোয়ানকে নিয়ে চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। এর পর ফেরত আসি।

এদিকে গতকাল দুপুরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ওই ফ্ল্যাটে ঢোকেন। ঘরের ভেতর বাচ্চার কোনো কাপড়-চোপড় পাওয়া যায়নি। শুধু ছেঁড়া একটা কামিজ মিলেছে।

গত শনিবার গভীর রাতে উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর সড়কের ২৮ নম্বর বাড়ির ২/বি-১ ফ্ল্যাট থেকে মরমর অবস্থায় শাফানা ও যমজ মেয়েকে উদ্ধার করে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। পরে জানা যায়, আর্থিক অনটনে ছিল পরিবারটি। মানসিকভাবে তাঁরা বিপর্যস্ত। কয়েক দিন না খেয়ে তাঁরা নিস্তেজ হয়ে পড়েন।



© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com