
সমকালীন প্রসঙ্গ
আদানির জালিয়াতি ও বাংলাদেশের বিপাক
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:৫৭ | প্রিন্ট সংস্করণ
কল্লোল মোস্তফা

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিনডেনবার্গ রিসার্চ ভারতের আদানি গ্রুপের জালিয়াতি, অর্থ পাচার ও শেয়ার কারসাজির তথ্যপ্রমাণসহ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর পর থেকে করপোরেট কোম্পানিটির শেয়ারের যে ব্যাপক দরপতন শুরু হয়েছে, তা এখনও চলমান। এই আদানি গ্রুপের সঙ্গেই বাংলাদেশ ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করেছিল। চুক্তি অনুযায়ী আগামী ২৫ বছর ঝাড়খণ্ডের গোড্ডাস্থ ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার কথা আমাদের। হিনডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টে শেয়ারবাজারে কারসাজি ছাড়াও বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি ও কয়লা আমদানি নিয়ে যে ধরনের জালিয়াতি উঠে এসেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বার্থও ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা বেড়েছে।
তোলপাড় করা প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, আদানি পাওয়ার ২০১১ থেকে '১৩ সালে মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের দুটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে বয়লার, জেনারেটর ও টারবাইন আমদানি করে। এগুলো দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের প্রকৃত যন্ত্রপাতি নির্মাণকারী (ওইএম) কোম্পানি থেকে সরাসরি ভারতে এলেও মূল্য পরিশোধ করা হয় দুবাইভিত্তিক তৃতীয় একটি কোম্পানির মাধ্যমে। ইলেকট্রোজেন ইনফ্রা এফজেডই (ইএফই) নামের কোম্পানিটি আসল ইনভয়েসের ওপর জালিয়াতি করে দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে সেই ইনভয়েস আদানি পাওয়ারের কাছে পাঠায়। আদানি পাওয়ার সেই অনুযায়ী বাড়তি দাম পরিশোধ করে।
এর পর দুবাইভিত্তিক ইএফই যন্ত্রপাতির প্রকৃত মূল্য চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার যন্ত্রপাতি নির্মাতা কোম্পানিগুলোকে পরিশোধ করে বাড়তি অর্থ পাঠিয়ে দেয় ইএফইর প্যারেন্ট কোম্পানি মরিশাসভিত্তিক ইলেকট্রোজেন ইনফ্রা হোল্ডিংস প্রাইভেট লিমিটেডের কাছে। মরিশাসভিত্তিক এ কোম্পানির প্রকৃত মালিক হলেন আদানি গ্রুপের কর্ণধার গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানি। এভাবে আদানি গ্রুপ ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যায়ে স্রেফ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতির দাম বাড়িয়ে দেখানোর মাধ্যমে ৮০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করে।
শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতিই নয়; সেখানে ব্যবহূত জ্বালানি কয়লার আমদানি মূল্যও বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ রয়েছে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে। ভারতের ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্সের (ডিআরআই) অভিযোগ- কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে জাহাজে সরাসরি ভারতে আনা হলেও এর দাম পরিশোধ করা হয় হংকং, সিঙ্গাপুর, দুবাইভিত্তিক তৃতীয় কোনো কোম্পানির মাধ্যমে। এগুলো আসলে জালিয়াতির উদ্দেশ্যে আদানিরই তৈরি বিভিন্ন বেনামি কোম্পানি। এই কোম্পানিগুলো কয়লা আমদানির আসল ইনভয়েসের ওপর জালিয়াতি করে দাম বাড়িয়ে সেই বাড়তি দামের ইনভয়েস আদানি গ্রুপের কাছে পাঠায়। আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলো সে অনুযায়ী বাড়তি দাম পরিশোধ করে। এর পর হংকং বা সিঙ্গাপুর বা দুবাইভিত্তিক বেনামি কোম্পানিগুলো কয়লার প্রকৃত দাম ইন্দোনেশিয়ার কয়লা রপ্তানিকারী কোম্পানিকে পরিশোধ করে। আর বাড়তি অর্থ পাঠিয়ে দেয় এসব বেনামি কোম্পানির প্যারেন্ট কোম্পানি মরিশাসভিত্তিক বিভিন্ন 'অলস' কোম্পানির কাছে; এগুলোরও প্রকৃত মালিক গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানি।
২০১৬ সালে ডিআরআই প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে ভারতের যে ৪০টি কোম্পানির বিরুদ্ধে কয়লার আমদানি মূল্য ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ আনা হয়, তার মধ্যে সরাসরি আদানি গ্রুপের কোম্পানি ছিল পাঁচটি। অভিযুক্ত আরও পাঁচটি কোম্পানির কয়লা সরবরাহকারী ছিল আদানি গ্রুপ। এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে ল্যাবরেটরির টেস্ট রিপোর্ট জালিয়াতির মাধ্যমে কয়লার তাপীয় মান বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগও ছিল।
ডিআরআই মনে করে, কয়লার আমদানি মূল্য এভাবে বাড়িয়ে দেখানোর উদ্দেশ্য দুটি- এক. আদানি গ্রুপের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আদানি পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানির অর্থ ডলার আকারে বিদেশে পাচার করা, যার ফলে সাধারণ শেয়ার মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। দুই. কয়লার বাড়তি মূল্য দেখিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা।
সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকার পরও কয়লা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতির দাম বাড়িয়ে দেখানোর কারণে আদানি গ্রুপের কোনো শাস্তি হয়নি। তদন্ত চলমান থাকা অবস্থাতেই আদানি গ্রুপ আদালতের রায় নিয়ে বাড়তি দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করে চলেছে। এর নেপথ্যে রয়েছে ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা।
প্রশ্ন হচ্ছে, আদানি গ্রুপ যেখানে স্বদেশেই জালিয়াতি করে চলেছে, সেখানে কীভাবে নিশ্চিত হবো- বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য স্থাপিত গোড্ডা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও একইভাবে কয়লার দাম বাড়িয়ে দেখাবে না? ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে কয়লার দর নিয়ে আদানির কারসাজির সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদ থেকে দেখা যাচ্ছে, আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে বিক্রির উদ্দেশ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমদানি করা কয়লার দর টনপ্রতি ২০০ ডলার বাড়তি দাবি করছে। (বাংলাদেশের সঙ্গেও আদানির কারসাজি/ দৈনিক বাংলা, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।
আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিটি বিশ্নেষণ করে ওয়াশিংটন পোস্ট সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম একটি নির্দিষ্ট সীমার বেশি হলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাড় পায়। কিন্তু আদানির ক্ষেত্রে কয়লার দাম যতই বাড়ুক, বাড়তি দরের পুরোটাই বাংলাদেশকে দিতে হবে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, আদানির এই কয়লার মূল্য জালিয়াতির খেসারত বাংলাদেশের জনগণকেই দিতে হবে।
ওয়াশিংটন পোস্টের ওই প্রতিবেদন অনুসারে, বিদ্যুৎ ক্রয় করা হোক বা না হোক, চুক্তি অনুযায়ী বছরে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান করতে হবে বাংলাদেশকে। এ ছাড়া আদানির অস্ট্রেলিয়ার কয়লা খনি থেকে আদানির জাহাজে করে ভারতে আদানির বন্দরে কয়লা এনে আদানির তৈরি রেলওয়েতে করে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরিবহন করা হবে এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ আদানি নির্মিত ট্রান্সমিশন লাইনে বাংলাদেশের সীমান্তে সঞ্চালন করা হবে। এভাবে কয়লা পরিবহন ও বিদ্যুৎ সঞ্চালনের পুরো খরচই বহন করতে হবে বাংলাদেশকে (৯ ডিসেম্বর ২০২২, ওয়াশিংটন পোস্ট)।
দেশে বর্তমানে ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ১৫ টাকা পড়লেও আদানির কাছ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের খরচ ইউনিটপ্রতি ২০-২২ টাকা পড়বে। বিষয়টি উপলব্ধি করে সম্প্রতি পিডিবির পক্ষ থেকে চুক্তি সংশোধনের জন্য আদানিকে চিঠি দেওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে (ইউএনবি, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)। দেখার বিষয়, কয়লার দাম বাড়তি দেখিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ রেখে চুক্তি স্বাক্ষরের পাঁচ বছরেরও বেশি সময় পর আদানি গ্রুপ চুক্তি সংশোধনে আদৌ রাজি হয় কিনা!
কল্লোল মোস্তফা :বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com