সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:৫৮ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাক্ষাৎকার গ্রহণ :এহ্‌সান মাহমুদ

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বাংলাদেশি ভূতত্ত্ববিদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগ থেকে ১৯৭৫ সালে স্নাতক ও ১৯৭৬ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৮৬ সালে ভারতের ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁর ৫০টির বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর জন্ম ১৯৫৫ সালে, কুষ্টিয়ায়।



সমকাল: ভূমিকম্পের প্রবণতা নিয়ে আপনি দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন। আপনার গবেষণা মডেলে বলেছেন, বাংলাদেশের ভূ-গঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। বিষয়টি যদি ব্যাখ্যা করেন।

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার : ২০০৩ সাল থেকে ভূমিকম্প নিয়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা করে আসছি। সেখানে আমার গবেষণা মডেলে উল্লেখ করেছি ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা- এই তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ভূতাত্ত্বিক কাঠামো অনুযায়ী বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর মধ্যে একটি হলো- ইন্ডিয়া প্লেট। এর পূর্বদিকে বার্মা প্লেট এবং উত্তরে এশিয়া প্লেট। ইন্ডিয়া ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থল বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর হয়ে মেঘনা দিয়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে। প্লেটের সংযোগস্থলে ৮০০ থেকে ১০০০ বছর আগে ভূমিকম্প হয়েছিল। ফলে এই সময়ে এই অংশে যে পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে, সেটি যদি একসঙ্গে বের হয়, তাহলে ৮ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের গবেষণা অনুযায়ী আমরা বলতে পারি, এই শক্তি একদিন না একদিন বের হবে। এই শক্তি একবারে বের হতে পারে। আবার আংশিকও বের হতে পারে। বের হবে- এটি নিশ্চিত। তবে ঠিক কোন সময়ে বের হবে, এই তারিখ বলতে পারব না।

সমকাল: এ ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য কতটা বিপর্যয়কর হতে পারে?

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: আমাদের এ অঞ্চলে ভূমিকম্প হলে এটি হবে জীবনহানিকর। কারণ স্পষ্ট- ভূমিকম্পের উৎসস্থল হবে ঢাকার খুব কাছে। ঢাকা শহরের দালানকোঠা অধিকাংশ অপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। গোটা দেশেই অনিয়ন্ত্রিতভাবে বসতি গড়ে উঠেছে। রাজধানী ঢাকার নিচে যদি ৫ মাত্রার ভূমিকম্পও হয়, তাহলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। ঢাকার কাছাকাছি যদি ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে ঢাকার অবস্থা কী হবে, তা এখন আমরা কল্পনাও করতে পারব না। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে কোথায় কী পরিমাণ ক্ষতি হবে, এটা বোঝার উপায়ও থাকবে না। মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার এবং প্রতিটি এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিহ্নিত করতে হবে। প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে ম্যাপ তৈরি করতে হবে। সে অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নিতে পারবে।

সমকাল: মানচিত্র তৈরির বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করবেন?

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: আসলে দুটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের উৎস বাংলাদেশের প্রান্তে অবস্থান করছে। একটা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব কোণে সিলেট অঞ্চলে ডাউকি ফল্টে, আরেকটা আমাদের পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা বেল্টে পাহাড়ি এলাকায়। উত্তর প্রান্তে যেটি ডাউকি ফল্ট; এখানে সংকোচনের হার হচ্ছে প্রতি একশ বছরে এক মিটার। গত ৫শ থেকে ৬শ বছরে বড় ধরনের ভূমিকম্পের কোনো রেকর্ড নেই। তার মানে, ৫-৬ মিটার চ্যুতি ঘটানোর মতো শক্তি অর্জন করেছে। যদি রিখটার স্কেলে প্রকাশ করি, তাহলে এটি হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। এখান থেকে আমাদের রাজধানী ঢাকা শহর হচ্ছে দেড়শ কিলোমিটারের মধ্যে। ঢাকার মধ্যে বড় ভূমিকম্পের মতো ভূতাত্ত্বিক অবস্থা না থাকলেও সিলেট এবং চট্টগ্রামে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজধানী ঢাকা।

সমকাল: বাংলাদেশের কোন কোন এলাকা বেশি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে?

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার : কোনো স্থানের ভূকম্পনের জন্য ফল্ট লাইন এবং টেকনিক স্পেস ফিল্ড গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। সাধারণত, বড় ধরনের ভূকম্পন হয়ে থাকে প্লেট বাউন্ডারির মধ্যে। যদিও বাংলাদেশ প্লেট বাউন্ডারির মধ্যে নয়, তথাপি ভূপ্রাকৃতিক অবস্থান ও বিন্যাসের স্বকীয়তায় ভূমিকম্প মণ্ডলের আশপাশেই রয়েছি। বাংলাদেশকে ভূকম্পনের তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জোন হিসেবে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিছু স্থান যেমন- সিলেট, রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার উল্লেখযোগ্য। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সর্বাপেক্ষা কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সমকাল: এর লক্ষণ কি দেখা গেছে?

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: ১৯৭৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যতবার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে, তার প্রায় সব ক'টির উৎপত্তিস্থল সিলেট, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার এলাকায়। এসব অঞ্চলে ভবিষ্যতে আরও বেশি মাত্রার ভূকম্পনের পূর্বাভাস একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা স্মরণ করতে পারি, আসাম-বাংলা অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালের ১২ জুন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, মেঘালয়ের সীমান্তসংলগ্ন সিলেট, ময়মনসিংহ অঞ্চলকে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে আমরা চিহ্নিত করেছি।

সমকাল: ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকি ও মাঝারি ঝুঁকির অঞ্চলগুলো আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব?

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট, ময়মনসিংহ এবং রংপুর, ঢাকা, কুমিল্লা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু অংশ। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের চারটি জেলা বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। একইভাবে ময়মনসিংহ বিভাগের পাঁচটি জেলাও ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আবার ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদী জেলার অংশবিশেষ। অপরদিকে পুরো কিশোরগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার উত্তরাংশ। আবার ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের অংশবিশেষ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলাও মাঝারি ঝুঁকিতে আছে। তবে ভূমিকম্পের কম ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা ও বরিশাল বিভাগ।

সমকাল :
ভূমিকম্প মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত?

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি সেখানে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনাই সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ। আমরা পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ করতে পারিনি। আমাদের এখানে ভবন নির্মাণে কোনো নিয়ম মানা হয় না। যদি বলা হয়, বাড়ি নির্মাণের সময় ২৫ শতাংশ জমি খালি রেখে তা নির্মাণ করতে হবে, দেখা যাবে এটা মানতে কেউ রাজি হবেন না। এইভাবে অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণের কারণে দেশে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। তার পরিমাণ এখন কল্পনাও করা কঠিন হবে।

সমকাল: এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী?

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: চাইলে এ পরিস্থিতিতেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়। যেমন ধরা যাক- আমি ভূমিকম্পের তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে জানি। কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল ভূমিকম্প মোকাবিলার অভিজ্ঞতা না থাকায় ওই পরিস্থিতিতে পড়লে ঠিক কী করতে হবে, তা হয়তো তখন করতে পারব না। এ জন্য আমাদের নাগরিকদের পরিস্থিতি মোকাবিলায় মহড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মাঝেমধ্যে এমন মহড়া দিলে মোকাবিলা করার সাহস তৈরি হবে। আমাদের বাড়ি-ঘর হয়তো নিয়ম মেনে তৈরি হয় না। কিন্তু এই দুর্বল অবকাঠামোর বাড়িঘরেও কীভাবে আসবাব অথবা ভবনের কোন অংশে আশ্রয় নিয়ে শরীরের কোন বিশেষ অঙ্গ আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করলে অন্তত জীবন বাঁচানো সম্ভব, এ বিষয়ে সচেতনতা ও প্রচারণা বাড়াতে কাজ করতে হবে।

সমকাল: ভূমিকম্প মোকাবিলায় অবকাঠামোগত দিক থেকে করণীয় কী?

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: শহরে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে মাটির নিচে থাকা গ্যাস ও বৈদ্যুতিক লাইনগুলোকে অটো শাটডাউন করার মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে ভূমিকম্পের পরে ক্ষয়ক্ষতি অনেক ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। ঢাকায় বেশিরভাগ ভবনই তৈরি হয়েছে জলাভূমি ভরাট করে। যেখানে মাটির সক্ষমতা যাচাই করা হয়নি। মাঝারি মানের ভূমিকম্প হলেও এগুলো ভেঙে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে। বলতে গেলে ভবন নির্মাণ বিধিমালা না মানার কারণে সব বিভাগীয় শহরই ঝুঁকিতে আছে। ভূমিকম্পের পর এগুলো থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। শহরের অপরিকল্পিত ভবন ও সরু সড়কের কারণে ফায়ার সার্ভিস এবং স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য উদ্ধার তৎপরতা চালানোও কঠিন হবে। তা ছাড়া ভূমিকম্পের সময় খোলা জায়গা না থাকা, মাঠ বা উদ্যান না থাকার কারণে ভবন ছেড়ে বের হয়েও দুর্ঘটনার হুমকিতে থাকবে মানুষ। পরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণের দিকে ফিরে যাওয়াই হচ্ছে আগাম সতর্ক ব্যবস্থা। সেদিকেই জোর দিতে হবে।

সমকাল:প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি সম্পর্কে বলবেন?

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: ফায়ার সার্ভিস, ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা বাহিনীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি স্ব্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে। এ ছাড়া ভূমিকম্পের পর দেশের উপকূলীয় এলাকায় সুনামির আশঙ্কা থাকে। তাই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও হাসপাতালগুলোকে আধুনিক করতে হবে।

সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: সমকালকেও ধন্যবাদ জানাই।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com