
সমকালীন প্রসঙ্গ
যেমন রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০১:১২ | প্রিন্ট সংস্করণ
আবদুল মান্নান

দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করছেন আগামী ২৩ এপ্রিল। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম রাষ্ট্রপতি, যিনি সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদ পূরণ করতে যাচ্ছেন। প্রাতিষ্ঠানিক সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে কেমন ছিলেন মোঃ আবদুল হামিদ, তা ইতিহাস বিচার করবে। তবে বলতে পারি, মানুষ হিসেবে তিনি অসাধারণ।
সংবিধানের ৪৮ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার দায়িত্ব সংসদ সদস্যদের। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তৎকালীন দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার বাগডোগরায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বিজয়ী প্রায় ৪০০ সদস্য। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে; তাঁর অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নেন সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করবেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণীত হলে তিনি পুনরায় সংবিধানের আলোকে সংসদ সদস্যদ দ্বারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে বাকশাল ব্যবস্থার প্রবর্তন হলে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে জাতীয় সংসদ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ঘাতকদের অন্যতম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহচর খোন্দকার মোশতাক। তখনও দেশে সংবিধান বলবৎ ছিল। সাংবিধানিকভাবে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকেই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার কথা। মোশতাকের কাছে তখন সংবিধানের কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তিনিও ৮৬ দিনের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। তাঁকে হটিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেন এবং বঙ্গবন্ধু নিযুক্ত প্রধান বিচারপতি সায়েমকে 'সাক্ষী গোপাল' রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেন। কিছুদিন পর সেই সাক্ষী গোপালকে সরিয়ে জিয়া নিজেই এক অভিনব পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি 'নির্বাচিত' হন। পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নামে জাতিকে একটি তামাশা উপহার দেন; যেখানে তিনি একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। জনগণকে বলা হলো, তাঁকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সমর্থন করেন কিনা- তা 'হাঁ' বা 'না' বলে অনুমোদন দিতে হবে। সেই নির্বাচনে দেশের অনেক স্থানে ভোটারদের শতভাগেরও বেশি নাকি 'হাঁ' বলেছিলেন। ১৯৮১ সালে জিয়া নিহত হলে তাঁর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন।
১৯৮২ সালের মার্চ মাসে সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান জেনারেল এইচএম এরশাদ। প্রথমে আরেক প্রধান বিচারপতি আ ফ ম আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করলেও পরে তাঁকে হটিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ তাঁর উপরাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের কাছে 'ঘণ্টাখানেকের জন্য' দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। তিন জোটের রূপরেখার আলোকে মওদুদ প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। তিনি পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করেন এবং বিএনপি নির্বাচিত হলে তাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। আবদুর রহমান বিশ্বাস ১৯৯৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বহাল ছিলেন, যদিও তার আগেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে দায়িত্ব পালন ও মেয়াদ পূরণে সহায়তা করেন।
আবদুর রহমান বিশ্বাস তাঁর মেয়াদ পূরণ করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি করেন। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য দলের বাইরে 'নিরপেক্ষ' কাউকে বেছে নেওয়ার সেই পদক্ষেপ সব মহলে প্রশংসিত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, পরবর্তীকালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এর প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান দেশে প্রশাসনিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিলেন; তা নিবৃত্ত করার বিচক্ষণতা দেখাতে পারেননি। ২০০১ সালে নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট বিজয় লাভের পর সারাদেশে, বিশেষত দক্ষিণবঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মী যে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল, তা বন্ধ করতেও তিনি সাহস দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার অবশ্য বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে 'নিরপেক্ষ' হিসেবে ছাড় দেয়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর খালেদা জিয়া জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে যখন সরকার গঠন করেন, তখনও রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দীন আহমদের মেয়াদ কয়েক মাস বাকি। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে তাঁকে অসম্মান করার জন্য তখন খালেদা জিয়া ও তাঁর সরকার এমন কোনো কাজ নেই, যা করেননি। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বা সচিবালয় থাকতেও প্রায় সময় মন্ত্রিপরিষদের সভা করতেন রাষ্ট্রপতির কোনো অনুমতি ছাড়াই বঙ্গভবনে।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের মেয়াদ শেষ হলে বিএনপি দলের সিনিয়র সদস্য ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করে। কিন্তু তাঁকে অত্যন্ত অমর্যাদাকরভাবে কয়েক মাসের মাথায় অনেকটা এক কাপড়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করতে হয়। তাঁর 'অপরাধ'- তিনি জেনারেল জিয়ার কবর জিয়ারত করতে যাননি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিল, তিনি পদত্যাগ করেও নিস্তার পাননি। তাঁকে বিএনপির কর্মীরা রেললাইনের ওপর দিয়ে তাড়া করেছে; তাঁর বাসভবনে আগুন দিয়েছে। ইতিহাসের পরিহাস, এখন সেই বিএনপি নির্বাচিত হলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার কথা বলে।
ডা. বদরুদ্দোজার পর খালেদা জিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. ইয়াজউদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন। তিনি ছিলেন একজন নিরেট ভদ্রলোক, সজ্জন ব্যক্তি। কিন্তু বিএনপির পাল্লায় পড়ে হয়ে যান 'জি হুজুর'। একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে তাঁর সামাজিক মৃত্যু ঘটে, যখন তাঁকে অসাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে অনেকটা বাধ্য করা হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রবীণ রাজনীতিক জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। মেয়াদপূর্তির প্রায় ১১ মাস আগে তিনি প্রয়াত হলে জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার মোঃ আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের যে অনুপাত, তাতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীই অনিবার্যভাবে দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন। এই পদের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব দলের পক্ষ থেকে সভানেত্রী শেখ হাসিনার ওপর অর্পিত হয়েছে। যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে আছেন একজন সাবেক আমলা ও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা; আর আছেন কয়েকজন রাজনীতিবিদ। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সাবেক উপাচার্যের নামও শোনা গিয়েছিল। যদিও কেউ কেউ সাবেক আমলা বা সাবেক বিচারপতি থেকে রাষ্ট্রপতি বাছাই করার ব্যাপারে সতর্ক। কারণ এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতায় রয়েছেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।
আমাদের দেশে যদিও রাষ্ট্রপতির পদ অনেকটা আলঙ্কারিক, তারপরও সময়ের প্রয়োজনে তিনি সরকার তথা সরকারপ্রধানকে নানাভাবে পরামর্শ দিতে পারেন; জাতিকে পথ দেখাতে পারেন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এপিজে আবদুল কালাম রাজনীতিবিদ ছিলেন না। অন্যদিকে প্রণব মুখার্জি ছিলেন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। দু'জনই রাষ্ট্রপতিই ছিলেন অসাধারণ।
আসলে ইচ্ছা, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ়তা থাকলে একজন রাষ্ট্রপতি শত বাধা-বিপত্তির মুখেও তাঁর দৃঢ়তা ও সক্ষমতা প্রদর্শনে সক্ষম। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন হবে এমন একজন রাষ্ট্রপতি। অবশ্য শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে তেমন একটা ভুল করেন না। এবারও তেমন হবে বলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। যোগ্য ব্যক্তিই ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হোন- এটিই সবার প্রত্যাশা।
আবদুল মান্নান: বিশ্নেষক ও গবেষক
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com