
খুলনায় সড়কে নৈরাজ্য
দুই নেতার চাঁদার চাপে চালকরা চিড়েচ্যাপ্টা
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০২:০৫ | প্রিন্ট সংস্করণ
হাসান হিমালয়, খুলনা

প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি। খুলনা নগরীর ডাকবাংলো মোড় থেকে তোলা সমকাল
রূপসা ঘাট থেকে ফুলতলা বাজার। ৩২ কিলোমিটারে ৯টি মোড়। খুলনার এসব মোড়ে থ্রি
হুইলার ও অটোরিকশা চালকদের নিত্যদিন গুনতে হচ্ছে চাঁদা। নগরীর ডাকবাংলো
মোড় ও দৌলতপুর স্ট্যান্ডকেন্দ্রিক দুটি শ্রমিক ইউনিয়নের ছায়ায় ক্ষমতাসীন
দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন শ্রমিক লীগের প্রভাবশালী দুই নেতা এ চাঁদাবাজির
নিয়ন্ত্রক। তাঁরাই করেন চাঁদার টাকা ভাগবাটোয়ারা। চাঁদা দিতে না চাইলে
কিংবা দেরি হলে চলে হুমকি-ধমকি। প্রকাশ্যে এ চাঁদাবাজি চললেও স্থানীয়
প্রশাসন দেখেও বুজে আছে চোখ, কানে দিয়েছে তুলো!
চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে রূপসা ঘাট থেকে ফুলতলা বাজার পর্যন্ত
একাধিক নগর পরিবহন চলত। কয়েক বছর ধরে বন্ধ এসব গণপরিবহন। বিকল্প হিসেবে সেই
জায়গা দখল করেছে থ্রি হুইলার। বর্তমানে এই পথে ১ হাজার ৬০০ যান চলছে। এক
চালককে চাঁদার পেছনে দিনে গুনতে হচ্ছে অন্তত ৬৫ টাকা। মাসের শুরুতে দিতে হয়
আরও ১০০ টাকা। শ্রমিক নেতাদের ইশারায় প্রতি মাসে আদায় হয় ৩৩ লাখ টাকা।
চালকরা জানান, একদিকে ইজিবাইকের আধিক্যের কারণে যাত্রী অনেক কমে গেছে,
অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় থ্রি হুইলার পরিচালন খরচ বেড়েছে। এতে
চালকদের আয় কমেছে, বেড়েছে সংসার খরচা। এর মধ্যে প্রতিদিন চাঁদার টাকার
জোগান দিতে গিয়ে খাবি খাচ্ছেন তাঁরা।
এদিকে বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, খুলনা নগরে নিবন্ধিত থ্রি হুইলার ও অটোরিকশার
সংখ্যা ২ হাজার ৫৯০টি। এর মধ্যে সাতটি ছাড়া বাকিগুলো ফিটনেস ও নিবন্ধন
নবায়ন করা। অর্থাৎ সব গাড়িই সড়কে চলাচল করছে। তবে ইউনিয়নগুলো বলছে, সড়কে
চলে মাত্র ১ হাজার ৬০০ থ্রি হুইলার ও অটোরিকশা।
চতুর দুই শ্রমিক নেতা :খুলনায় অটোরিকশা চালকদের ইউনিয়ন দুটি। দুটিরই বড়
কমিটি থাকলেও সাধারণ সম্পাদকরাই সংগঠন দুটির হর্তাকর্তা। ডাকবাংলো মোড়ে
খুলনা জেলা বেবি ট্যাক্সি শ্রমিক ইউনিয়ন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার
হোসেন সোনা জাতীয় শ্রমিক লীগ মহানগর কমিটির সহসভাপতি। আনোয়ারের দাবি, তাঁর
সংগঠনের আওতায় গাড়ি চলে ১৮০ থেকে ২০০টি। তবে চালকরা জানান, এই ইউনিয়নে চালক
প্রায় ৪০০।
চালকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন দৌলতপুর-খুলনা বেবি টেক্সি সিএনজিচালিত অটোরিকশা
থ্রি হুইলার ড্রাইভার্স ইউনিয়ন। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম
পান্নু খানজাহান আলী শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। এই সংগঠনের আওতায় চলে
প্রায় ১ হাজার ২০০ গাড়ি।
বিভিন্ন পয়েন্টে শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের জন্য যে জনবল নিয়োগ করা
হয়েছে, তাঁদের বলা হয় স্ট্যাটার। দুই ইউনিয়নের হয়ে চাঁদা আদায়ে ২৫ থেকে ৩০
জনের মতো স্ট্যাটার রয়েছেন।
সূত্র জানায়, দৌলতপুর ও ডাকবাংলো মোড়ে প্রতিদিন গাড়ি প্রতি আদায় করা ১০
টাকা সরাসরি ইউনিয়নের তহবিলে জমা হয়। সাধারণ সম্পাদকরা এই টাকা খরচ করেন।
বিভিন্ন পয়েন্টে আদায় করা বাকি টাকা ইউনিয়নের নেতা এবং স্ট্যাটাররা ভাগ করে
নেন। ১ হাজার ৬০০ গাড়িতে দৈনিক গড়ে ৬৫ টাকা হিসাবে প্রতি মাসে আদায় ৩১ লাখ
২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া মাসের শুরুতে এককালীন ১০০ টাকা হিসেবে আদায় করা হয় ১
লাখ ৬০ হাজার টাকা। এই টাকাও ভাগ করে নেন ইউনিয়নের নেতারা। এ ছাড়া নতুন
কোনো গাড়ি নিবন্ধন করাতে হলে ইউনিয়নে ২ থেকে ৫ হাজার পর্যন্ত টাকা দিতে হয়।
খুলনা জেলা বেবি ট্যাক্সি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন
সোনা বলেন, শ্রম অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে প্রতিদিন গাড়ি থেকে ১০ টাকা আদায়
করা হয়। তা দিয়ে অফিস ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, অন্য খরচ করা হয়। বাকি যে
টাকা থাকে তা বিভিন্ন সময়ে শ্রমিকদের মৃত্যু ভাতা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার
খরচ দেওয়া হয়। বিভিন্ন পয়েন্টে যে টাকা আদায় হয়, তা স্ট্যাটাররা ভাগ করে
নেন। ওই টাকা ইউনিয়নে আসে না।
দৌলতপুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম পান্নু বলেন, একজন শ্রমিক
মৃত্যুকালীন ভাতা পান ১০ হাজার টাকা। এর বাইরে অসুস্থ হলে, দুর্ঘটনা ঘটলে,
বিভিন্ন সময় অনুদান দেওয়া হয়। বড় বড় দিবসে খরচ হয়- এই টাকা আসে কোথা থেকে?
তিনি বলেন, ইউনিয়নের আওতায় ১ হাজার ২০০ গাড়ি থাকলেও প্রতিদিন ৩০০ জনের বেশি
চাঁদার টাকা দেয় না। প্রতিদিন আদায় হয় মাত্র ৩ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে
কী হয়? প্রতিদিন অফিস খুললে ৫ হাজার টাকা খরচ।
পান্নু আরও বলেন, চালকরা মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। মোড়ে মোড়ে এত টাকা আদায় হয়
না। আর হলেও সেটা ইউনিয়নে আসে না। স্ট্যাটাররা ভাগ করে নেন। তিনি বলেন,
মোড়ে মোড়ে স্ট্যাটার না দিলে প্রতিদিন ওরা (চালকরা) মারামারি করে মাথা
ফাটাবে।
দুই ইউনিয়ন নেতার কাছেই জানতে চাওয়া হয়, স্ট্যাটারদের নিয়োগ দেয় কারা? দুই
নেতা জানান, ইউনিয়নের লোক তাঁরা। তাহলে তাঁদের আদায় করা চাঁদার দায়িত্ব
কাদের ওপর বর্তাবে- প্রশ্ন করা হলে দুই নেতা কোনো উত্তর দেননি।
চালকরা ভালো নেই :কয়েক দিন অত্যন্ত ২০ জন চালকের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল।
নাম প্রকাশ না করে তারা জানান, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চালকদের
আয় কমেছে। এর সঙ্গে কয়েক বছর ধরে যোগ হয়েছে ইজিবাইক। প্রায় ৩০ শতাংশ যাত্রী
ইজিবাইক নিয়ে গেছে।
দৌলতপুর পাবলা এলাকার বাসিন্দা এক চালক বলেন, সিএনজিচালিত অটোরিকশার দৈনিক
ভাড়া ৫০০ টাকা, প্রতিদিন লাগে ৫০০ টাকার গ্যাস। এর সঙ্গে দৈনিক ৬৫ থেকে ৮০
টাকা চাঁদা। দিনে এই ১ হাজার ৬৫ টাকা খরচ তুলে বাড়তি আয় করতে কষ্ট হয়ে যায়।
অনেক দিন শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয়।
আরেক চালক জানান, চাঁদা না দিলে হুমকি দেয়। অনেকে বলে, ৫ টাকা নিয়ে কিপটেমি
করিস কেন? কিন্তু একেকজনকে ৫ টাকা করে দিতে দিতে দিনশেষে আমাদের ৬৫ থেকে
৮০ টাকা নেমে যায়।
প্রশাসন জানে না কিছুই :অটোরিকশা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি
মাসের শুরুতে চালকরা যে ১০০ টাকা দেন, তা মালিকদের কাছ থেকে কেটে রাখা হয়।
মালিকরা ইউনিয়নের নেতাদের কাছে জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, পুলিশসহ প্রশাসনকে
'ম্যানেজ' করতে এই টাকা লাগে।
১০০ টাকা কী খাতে খরচ হয়- প্রশ্ন করা হলে দুই ইউনিয়ন নেতা বলেন, 'এটা
কীভাবে খরচ হয় বলা যাবে না, বললে সমস্যা আছে।' তবে মালিকদের কাছ থেকে টাকা
আদায়ের বিষয়ে প্রশাসনের কেউ কিছু জানে না।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) মনিরা সুলতানা বলেন, তাঁরা
শ্রমিকদের কাছ থেকে কী বলে টাকা তোলে এটা শ্রমিক ও ইউনিয়নের বিষয়। পুলিশের
কেউ এক টাকা কোথাও থেকে নেয় না। অভিন্ন বক্তব্য বিআরটিএর। খুলনা শ্রম
অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, চাঁদা আদায়ের অনুমতি কখনও
কাউকে দেওয়া হয় না। কোনো ইউনিয়নের কল্যাণ তহবিল থাকলে সেই টাকাও রসিদের
মাধ্যমে আদায় করতে হবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে টাকা আদায়ের কোনো নিয়ম নেই।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com