
খুঁড়িয়ে চলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে দুর্ভাবনা
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০৪:৩৯ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাব্বির নেওয়াজ

শিক্ষক আটজন, শিক্ষার্থী মাত্র দু'জন। সিলেবাসও ছিল সংক্ষিপ্ত। তবুও আট শিক্ষক মিলে এই দুই শিক্ষার্থীকে চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করাতে পারেননি। এই দুই শিক্ষার্থী কখনও কলেজের আঙিনা মাড়াননি। কাগজে-কলমে আটজন শিক্ষক থাকলেও চারজন মূলত অন্যত্র চাকরি করছেন। এই চিত্র মাগুরা সদর উপজেলার রাউতড়া হৃদয়নাথ স্কুল অ্যান্ড কলেজের। কলেজের অধ্যক্ষ তপন কুমার ঘোষ বলেন, তাঁরা এমপিওভুক্তির আশায় অত্যন্ত দুর্বল ৬ শিক্ষার্থীর ফরম ফিলাপ করিয়েছিলেন। তার মধ্যে জোর করে দুই শিক্ষার্থীকে বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করান। দু'জনই ফেল করেছে।
এ প্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশে ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (কলেজ ও মাদ্রাসা) কেউ পাস করেননি। এর মধ্যে রাজধানীতে আছে দুটি কলেজ। একটি মালিবাগের ঢাকা অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, অপরটি সবুজবাগের সেন্ট্রাল আইডিয়াল কলেজ। অক্সফোর্ড কলেজ থেকে তিনজন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সেন্ট্রাল আইডিয়াল কলেজ থেকে একজন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এই ৫০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত ১৫টিতে একজন করে পরীক্ষার্থী ছিলেন। এদিকে অনেক মাদ্রাসাও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্নিষ্ট মহলে প্রশ্ন উঠেছে- এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাখার দরকার কী?
গত বুধবার ২০২২ সালের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার ফল সারাদেশে একযোগে প্রকাশিত হয়। একজনও পাস করেননি এমন প্রতিষ্ঠান গতবার ছিল ৫টি।
সবাই ফেল করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৪৪টি ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন। এর মধ্যে দিনাজপুর বোর্ডের ১৩টি, রাজশাহী বোর্ডের ৯, ঢাকা বোর্ডের ৮, যশোর বোর্ডের ৬, কুমিল্লা বোর্ডের ৫ ও ময়মনসিংহ বোর্ডের অধীন ৩টি কলেজ রয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ৪টি মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন দুটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেননি। অনেকে বলছেন, এমপিওভুক্তির আশায় ও শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।
কলেজের একজনও পাস করতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ সাহাবুদ্দিন মজুমদার বলেন, করোনাকালে শিক্ষার্থীরা চলে গিয়েছিল। প্রবেশপত্র আসার পর তাদের বাড়িতে গিয়ে বুঝিয়ে ক্লাসে আসতে বলা হয়। তবু কেউ আসেনি। তিনি জানান, তাঁদের ৩০ শিক্ষার্থী ও ২৪ জন শিক্ষক আছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃতপক্ষেই ধুঁকে ধুঁকে চলছে। নানা কৌশলে তারা পাঠদানের অনুমতি ও স্বীকৃতি পেয়েছে। বেশিরভাগই ভাড়া বাড়িতে কলেজ চালাচ্ছে। ফলও ভালো করতে পারছে না। আমরা তাদের বিষয়ে কঠোর হচ্ছি। ভাড়া বাড়িতে এখন আর কাউকেই কলেজ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, একজনও পাস করাতে পারেনি এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাথমিকভাবে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিক্ষা বোর্ডগুলো তাদের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে শোকজ নোটিশ দেবে। জবাব পর্যালোচনা করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমপিও বাতিল, বাকিদের ক্ষেত্রে সরকারি স্বীকৃতি বাতিল করা হবে।
শিক্ষক নেই, পাঠদান নেই, পাসও নেই- এমন এক প্রতিষ্ঠান ড. এম সামছুল হক কলেজ। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ড. এম সামছুল হক ২০০৩ সালে চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার বহুরী গ্রামে নিজের নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজের ১০ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেননি একজনও। শুক্রবার সেখানে গিয়ে জানা গেল, কলেজের সম্পত্তি দখল নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানান, সামছুল হক ২ একর জায়গায় কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ৩-৪ বছর কলেজটি ভালোই চলছিল। তিনি নিজের টাকায় শিক্ষকদের বেতন দিতেন। অসুস্থ হয়ে পড়লে শিক্ষকদের বেতন আটকে যায়। তিনি কলেজটি এমপিও করতে মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র জমা দিয়ে যান। তারপর পরিবারের কেউ কলেজটির হাল ধরেননি। কলেজের অধ্যক্ষ মোশারফ হোসেনকে মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল করলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শাহ আলী রেজা আশ্রাফি বলেন, সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য অভ্যন্তরীণ দলাদলি, শিক্ষক না থাকায় পাঠদান ছিল না, তাই এমন রেজাল্ট হয়েছে।
একজনও পাস করেননি মাগুরা সদরের শিবরামপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকেও। অধ্যক্ষ প্রকাশ কুমার সাহা জানান, একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ফেল করেছে। প্রতিবন্ধী হওয়ার পাশাপাশি লেখাপড়ায় দুর্বল ওই শিক্ষার্থী কখনও ক্লাস করেনি। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আফরোজা রমজান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪ জন পরীক্ষা দিলেও কেউ পাস করেননি। মানিকগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. রমজান আলী তাঁর স্ত্রীর নামে ১৫ বছর আগে এমপিওভুক্ত মানিকগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়কে নামকরণ করেন আফরোজা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে। ২০২০ সালে বিদ্যালয়টিতে কলেজ শাখার অনুমোদন এনে শিক্ষার্থী ভর্তি করেন। ওই বছর মানবিক বিভাগে ৬ জন ভর্তি হন। তাঁদের মধ্যে চারজন এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কেউ পাস করতে পারেননি। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শাহনাজ বেগম বলেন, করোনাকালে কলেজের ৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে দু'জন ঝরে পড়ে। ৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন এক বিষয়ে পরীক্ষা দেয়নি। বাকি তিনজনও পাস করেনি।
বগুড়ার ধুনট উপজেলার বিশ্বহরিগাছা বহালগাছা বহুমুখী কলেজ ২০১৮ সাল থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও এ বছর ফল বিপর্যয় ঘটেছে। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হারুনার রশিদ জানান, ১৪ জন শিক্ষক থাকলেও তাঁরা নিয়মিত ক্লাসে আসেন না। পরিচালনা কমিটিও বেতন ভাতা দিতে না পারায় শিক্ষকদের ক্লাসে উপস্থিতির জন্য চাপ দেন না। ভালো মানের ছাত্রছাত্রীরা এখানে ভর্তি হয় না। নানা কারণে ফল বিপর্যয় হয়েছে।
শতভাগ ফেলের তালিকায় রয়েছে গোপালগঞ্জের দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সদর উপজেলার পাইককান্দি ইউনিয়নের ডা. দেলোয়ার হোসাইন মেমোরিয়াল কলেজ ও কাশিয়ানী উপজেলার রাতইল ইউনিয়নের রাতইল আইডিয়াল কলেজ। ঠাকুরগাঁওয়ের ৩ কলেজের ২৫ শিক্ষার্থীর কেউ পাস করেননি এবার। সদর উপজেলার সালন্দর মহিলা কলেজে ১১ জন, পীরগঞ্জ কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন ও রানীশংকৈল উপজেলার গোগর মহাবিদ্যালয়ের ১৩ জন ফেল করেছেন। গোগর মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আবুল কালাম জানান, ১৯৯৯ সালে কলেজ করার পরও বেতন হয়নি। অনেক শিক্ষক অন্যের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। বিল বেতন চালু না হলেও অনেকে অবসরে গেছেন। সালন্দর মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আলম সরকার বলেন, এ ফলের জন্য আমরা লজ্জিত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমন ঘটেনি। গত বছর ইংরেজির প্রভাষক হঠাৎ অন্যত্র চলে যাওয়ার কারণে এমন হয়েছে।
সাইনবোর্ড থাকলেও বাস্তবে অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি নাটোরের সিংড়া উপজেলার শেরকোল আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দুই প্রতিষ্ঠানের একজনও পাস করতে পারেননি। এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ৭ জন। শেরকোল আদর্শ মহাবিদ্যালয় থেকে একজন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ফেল করেছেন। অপর ৬ জন আগপাড়া শেরকোল বন্দর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে অংশ নিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার গিয়ে শেরকোল মহাবিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড পাওয়া যায়। কিন্তু কলেজটির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বোর্ডের কাগজপত্র অনুযায়ী, এ বছর কলেজটি থেকে রানীনগর গ্রামের শুভ হোসেন নামের একজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছে।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কে এম আইডিয়াল কলেজ থেকে একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করতে পারেননি। কলেজটিতে ১৩ জন শিক্ষক আছেন। কলেজের অধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান ঝন্টু বলেন, এমপিও না হওয়ায় নানা সংকট আছে। শিক্ষকরা দীর্ঘ সময় ধরে ফ্রি ক্লাস নিয়ে আসছেন। এতে করে অনেকেই এখন হতাশ।
একই অবস্থা আমলা ইউনিয়নের হাজী নুরুল ইসলাম কলেজের। কলেজ থেকে ১০ জন এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সবাই অকৃতকার্য হয়েছেন। তবে কারিগরি শাখা থেকে ১৯ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১৪ জন পাস করেছেন। অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম বলেন, ২০০০ সালে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়নি।
(প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সমকালের সংশ্নিষ্ট জেলা ও উপজেলার প্রতিনিধিরা)
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com