আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইন প্রকল্প

ভারতের বাধায় আটকে আছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ নির্মাণ

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০৬:১৬ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাজীব আহাম্মদ

ছবি: ফাইল

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের আপত্তির কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের আখাউড়া-লাকসাম অংশে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণকাজ বারবার বিঘ্নিত হচ্ছে।

বিএসএফের বাধায় একটি ছোট সেতু ও বিক্ষিপ্তভাবে রেলপথের কাজ অসম্পন্ন থাকলে দেশের প্রধান রেলপথ ঢাকা-চট্টগ্রামের পুরোটা ডাবল লাইনে উন্নীত করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে ২৩টি ট্রেন চলে এই পথে। ডাবল লাইন নির্মাণ শেষে তা ৭২টিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে রেলওয়ের।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন এই প্রকল্পের কসবা-মন্দবাগ অংশে নবনির্মিত ডুয়েলগেজ রেলপথে ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করেন, সেদিনই বিএসএফের বাধায় বন্ধ হয় মন্দবাগ থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে সালদা নদী সেতু নির্মাণকাজ।

১৮৯৫ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সেকশনে রেলপথ নির্মাণ করে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া আখাউড়া ও কসবা এলাকায় রেললাইন ঘেঁষে সীমান্ত নির্ধারিত হয়। বিধান আছে, আন্তর্জাতিক সীমানার ১৫০ গজের মধ্যে স্থাপনা নির্মাণে প্রতিবেশী দেশের অনুমতি নিতে হয়। কসবা স্টেশন, সালদা নদী স্টেশন এবং সালদা নদী সেতু সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে বিএসএফ বাধা দিচ্ছে। গত দুই বছরে পাঁচবার কাজ বন্ধ হয়েছে বিএসএফের বাধায়।

এ প্রসঙ্গে রেলের পূর্বাঞ্চলের প্রধান ও আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন সমকালকে বলেছেন, ১৮৯৫ সালে সালদা নদী সেতু নির্মিত হয়েছে। সালদা নদী সেতুর দৈর্ঘ্য মাত্র ৬৫ মিটার। বাংলাদেশ নতুন স্থানে সেতু নির্মাণ করছে না। পুরোনো সেতু ভেঙে একই জায়গায় সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। বিএসএফ সেতুর পাইল ও পিলার নির্মাণের সময় কোনো আপত্তি তোলেনি। গত দুই বছর ধরে বাধা দিচ্ছে। কসবা, সালদা নদীতে স্টেশন ও রেললাইন পুরোনো লাইনের দক্ষিণ-পশ্চিমে অর্থাৎ বাংলাদেশের দিকে নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরোনো লাইনের অবস্থান নিয়ে আপত্তি না থাকলে সীমান্ত থেকে আরও দূরে নতুন লাইন নির্মাণে বাধার বিষয়টি বোধগম্য নয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক সেহেলী সাবরীন সমকালকে বলেছেন, আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণ বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমানার অত্যন্ত কাছাকাছি হওয়ায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আপত্তির মুখে বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক সীমান্তের দুটি স্থানে এ প্রকল্পের কাজ বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। সীমান্তে কোনো কাজ সম্পন্ন করার জন্য দু'পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর প্রয়োজন রয়েছে। সাময়িক এ অচলাবস্থা নিরসনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্নিষ্ট সবাইকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলমান। এই বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বৃহস্পতিবারও আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারত দুই দেশই অতীতে উদ্ভূত বিভিন্ন বিষয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করেছে। এ বিষয়েও অচিরেই একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে উপনীত হওয়া যাবে। এ প্রকল্পের নির্মাণকাজ খুব দ্রুতই আবার শুরু হবে বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসানও একই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, রেলওয়ের নীতি হলো বাধা এলে কাজ বন্ধ রাখা। অতীতেও বাধা এসেছে। তখনও দুই দেশের আলোচনায় কাজ এগোনো হয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দৈর্ঘ্য ৩২১ কিলোমিটার। ১২৪ কিলোমিটার ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই সিঙ্গেল গেজে ডাবল লাইনের ছিল। লাকসাম থেকে চিনকিআস্তানা পর্যন্ত ৬১ কিলোমিটার ডাবল লাইন ২০১৫ সালের এপ্রিলে চালু হয়। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে টঙ্গী থেকে ভৈরববাজার পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার ডাবল লাইন চালু হয়েছে। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকায় এই ১২৫ কিলোমিটার রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ২৪৯ কিলোমিটার এখন ডাবল লাইন। মাঝের ৭২ কিলোমিটার অর্থাৎ আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন করা হচ্ছে।

কাজ বারবার বন্ধ হলেও ব্যয় কমে যাওয়ার বিরল ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে আখাউড়া-লাকসাম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে। ২০১৪ সালে অনুমোদিত এই প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালে সম্পন্ন হওয়ার লক্ষ্য ছিল। ৬ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার এই প্রকল্প দুই দফায় বাড়িয়ে ২০২১ সালে জুন এবং ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়াতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সুখবর হলো, প্রকল্প ব্যয়ও কমতে যাচ্ছে। সংশোধিত ডিপিপিতে (আরডিপিপি) প্রকল্প ব্যয় ৫ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। ৯২১ কোটি টাকা কমতে যাচ্ছে ব্যয়।

গত ৪ জানুয়ারি রেলের সচিব ড. হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, লুপ ও মেইন লাইনসহ ১৮৪ কিলোমিটারের মধ্যে ১৩২ কিলোমিটার নতুন ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। ২৪টি সেতু বড় এবং ২২টির সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে, ১১টি স্টেশন ভবন পুনর্নির্মাণ হয়েছে। ৯টির কাজ চলমান। প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৫ শতাংশ।

সভায় জানানো হয়, বিএসএফের ২০২১ সালের মার্চ থেকে ১৩ দিন, জুন থেকে বছরের বাকি সময় সালদা নদীতে কাজ বন্ধ থাকে। ওই বছরের জুনে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনকে জানানো হয়। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করতে অনুরোধ করা হয়। ২০২২ সালের প্রথম দিনে কাজ শুরু হলেও ১৩ দন পর আবার বিএসএফের চাপে কাজ বন্ধ করতে হয়। গত ২৬ নভেম্বর কাজ শুরু করলে তিন দিন পর বিএসএফ ফের বাধা দেয়। গত ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব নির্মাণ এলাকা পরিদর্শন করেন।

রেল সূত্র জানিয়েছে, আগামী নির্বাচনের আগে প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করার তাড়া রয়েছে। ভারত অনড় অবস্থানে থাকলে, প্রয়োজনে পথ পরিবর্তন করা হবে। সেতু আরও দক্ষিণ-পশ্চিমে সরিয়ে আনা হবে। দুই স্টেশনের নির্মাণকাজ ততটা জরুরি নয়। এই সূত্রের ভাষ্য, দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরাই ভারী সজ্জিত। জোর করে নির্মাণকাজ করতে হলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যা দুই দেশের সম্পর্কে অনবতি ঘটাতে পারে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com