ভাষা আন্দোলনের আদর্শে সাংস্কৃতিক আন্দোলন

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০১:১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

যতীন সরকার

ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গ এলেই অনেক কথা মনে পড়ে যায়। এ বিষয়ে পত্রপত্রিকাতেও প্রচুর লেখালেখি হয়। সেসব লেখা অনেকাংশে সত্য। আবার কিছু লেখা বিভ্রান্তিও তৈরি করে।

ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আমি ছেলেবেলা থেকেই যুক্ত ছিলাম। ১৯৪৮ সালে যখন জিন্নাহ সাহেব এসে বললেন- স্টেট ল্যাংগুয়েজ অব পাকিস্তান ইজ গোয়িং টু বি উর্দু অ্যান্ড নো আদার ল্যাংগুয়েজ। ছাত্ররা নো নো বলে প্রতিবাদ করার পর তাদের ওপর পুলিশের হামলা হলো। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র নেত্রকোনা শহরে। আমি নেত্রকোনায় যে স্কুলে পড়তাম, সে স্কুলের নাইন-টেনের ছেলেরা আমাদের ক্লাসে এসে বলল, জিন্নাহ বলেছেন আমাদের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে। রাষ্ট্রভাষা উর্দু হলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। উর্দুতে আমরা কিছুই করতে পারব না। সব পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে চলে যাবে। কাজেই প্রতিবাদে আমরা সব বের হয়ে আসব।

নেত্রকোনায় তখন কোনো কলেজ ছিল না। তিনটা স্কুল ছিল। আমরা স্কুলের ছাত্ররা বের হয়ে এলাম। উত্তরপাড়ার এক মাঠে সবাই সমবেত হলো। সেখানে বলা হলো, জিন্নাহকে আমরা জাতির পিতা বলি, কায়েদে আজম বলি। কিন্তু জিন্নাহ যে অবস্থা সৃষ্টি করেছেন, এরপর আর তাঁকে কোনোভাবেই জাতির পিতা বলা যায় না। আমাদের ভাষার অধিকার কেড়ে নিয়ে তিনি আসলে আমাদের সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইছেন। কাজেই এটা রুখতে হলে আমাদের সবাইকে রাস্তায় নামতে হবে।

এভাবে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। এটা আটচল্লিশ সালের কথা বলছি। তারপর যখন বায়ান্ন সাল এলো, তখন আমি আর নেত্রকোনা শহরে থাকি না। গ্রামের স্কুলে পড়ি। সেই খবর যখন আমাদের গ্রামে এলো, আমরা আবারও বের হয়ে এলাম। কাছেই একটা বাজার ছিল, বসুর বাজার। আমরা সেই বসুর বাজারের সামনে গিয়ে মুখে টিনের চোঙ লাগিয়ে বলতে শুরু করলাম, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চেয়ে আন্দোলন করা হলে আমাদের ভাইদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। আমাদের হরতাল করতে হবে।

গ্রামে তখনও সব খবর ঠিকভাবে আসেনি। আমরা যা শুনেছি তার সঙ্গে কিছু রং মিশিয়ে বলতে থাকলাম যা ঘটেছে। হরতাল করার ঘোষণা দেওয়ার পর যাঁরা সেখানে ছিলেন তেমন অনেকে বললেন- আমাদের ছেলেদের আমরা শহরে লেখাপড়া করার জন্য পাঠাই, আর তারা সেখানে তাদের গুলি করে মারে। আবার নাকি ভোটাভুটি করবে। এদেরকে ভোট দেওয়া দূরের কথা, ঝাঁটা দেওয়া হবে। ঠিক আছে ভাইসব। আমরা কেউ আজকে হাট করব না। আজ হরতাল। সেদিন হাট উঠে গেল।

যখন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লেখা হয়, তখন এইসমস্ত গ্রামাঞ্চলে ভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে মানুষ কীভাবে সংঘবদ্ধ হয়েছিল, সে বিষয়ে প্রায় কিছুই বলা হয় না। ইতিহাস বইগুলোয় বড়জোর মহকুমা শহরগুলোর কথা কিছুটা বলা হয়। কিন্তু সারা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যদি ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে এই সংঘবদ্ধতা তৈরি না হতো, তাহলে এই আন্দোলনের হাত ধরে আমরা যে ক্রমশ স্বাধীনতার উপকূলে পৌঁছালাম, তা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।


প্রকৃত প্রস্তাবে এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সারাদেশে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা ঘটে। যে আন্দোলন রাষ্ট্রের রবীন্দ্র বিরোধিতার প্রভাব থেকে আমাদের রক্ষা করেছে, নজরুলকে খণ্ডিত করার প্রভাব থেকে রক্ষা করেছে। এভাবে আমাদের ভাষাকে বিকৃত করার যে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল পাকিস্তান, সেখান থেকে আমাদের রক্ষা করেছে। এই প্রতিরোধ ও তার ফলাফলের সবই তৈরি হয়েছে ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়। কাজেই ভাষা আন্দোলন ছিল প্রকৃত প্রস্তাবে একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনই ক্রমে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। যার ফলে আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করি।

এ সমস্ত কথা যখন বর্ণনা করা হয় তখন সেখানে প্রায়ই কিছু বিকৃত থাকে। প্রকৃত ইতিহাসকে আমাদের উদ্ধার করা উচিত। এই বোধ থেকে কাজ হয়নি বলেই আমরা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে সমগ্র দেশের ইতিহাস নিয়ে আসতে পারি নাই। কাজেই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা যে শক্তি অর্জন করেছিলাম, তা একসময় হারিয়ে ফেললাম। আর বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো- যে পাকিস্তানকে আমরা হত্যা করেছিলাম, সেই পাকিস্তানের ভূত আমাদের কাঁধে চেপে বসল। সেই ভূত আজও নামেনি। এই ভূতগ্রস্তদের হাতেই আমাদের সংবিধান নষ্ট হলো। বঙ্গবন্ধুর যে চার মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা; তাঁকে হত্যার পর তা থেকে সরে আসা হলো। ভাষা আন্দোলন নিয়ে যখন আমরা কথা বলি, তখন এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা নীরব থাকি। আমাদের এই নীরবতার কারণ, ভাষা আন্দোলনের আদর্শ থেকে সরে আসাই আমাদের পরবর্তীকালের রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণ, তা বোধ হয় আমরা মনে করি না।

ভাষা আন্দোলনের আদর্শে উজ্জীবিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে আমরা আজ অনেক দূরে সরে গেছি। আমাদের মতো যারা পূর্বজ, তারা বর্তমান প্রজন্মের প্রতি তাদের প্রকৃত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা ক্রমাগত ব্যর্থ হয়ে চলেছি। এই দূরত্ব আমাদের ঘোচাতে হবে, এই ব্যর্থতা আমাদের দূর করতে হবে। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা-উত্তর বাস্তবতায় আমরা যদি ভাষা আন্দোলনের আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হতাম, তাহলে মৃত পাকিস্তানের ভূত আমাদের ঘাড়ে এভাবে চেপে বসতে পারত না। আমরা আরও বৃহত্তর কল্যাণের অংশীদার হতে পারতাম।

আমি ২০২৩-এর কথা বলছি। এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছেন তাঁরাই, যাঁরা আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরাও পাকিস্তানের ভূতকে তাড়িয়ে দিতে পারেননি। আমাদের বর্তমান সংবিধানেও সে কথা স্পষ্ট। আমরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলি। অথচ আমাদের সংবিধানে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছে। যখন একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয় তখন সে দেশে প্রকৃত প্রস্তাবে গণতন্ত্র থাকে না। আবার বলা হচ্ছে- ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার মূলনীতি বজায় আছে। এটা গোঁজামিল।

এই গোঁজামিলকে ভাষা আন্দোলনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের দূর করতে হবে। তাহলেই আমরা প্রকৃত স্বদেশ ফিরে পাব। এই গোঁজামিল যদি আমরা দূর করতে না পারি তাহলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমরা যত বড় বড় কথাই বলি না কেন, সব অর্থহীন। এই গোঁজামিল দূরীকরণে আমাদের নতুন করে রাজনীতি শুরু করতে হবে। আর সেই রাজনীতিকে পথ দেখাবে ভাষা আন্দোলনের আদর্শ-উদ্ভূত সাংস্কৃতিক আন্দোলন।



লেখক
শিক্ষাবিদ
প্রাবন্ধিক

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com