
অগ্নিঝরা মার্চ
মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা ও দিনু বিল্লাহ
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০১ মার্চ ২৩ । ১১:৩৭ | প্রিন্ট সংস্করণ
এন এন তরুণ

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ যে ধর্মনিরপেক্ষ ধারা ও জাতীয়তাবাদের চেতনায় চালিত হয়েছিল, তা যেন আমরা ভুলতে বসেছি। স্বাধীনতার পর ’৭৫-এর পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মৌলবাদী শক্তির উত্থান আমাদের সে পথে পরিচালিত করে। বাঙালি যে এক সময় কী রকম অসাম্প্রদায়িক ছিল এবং এই অসাম্প্রদায়িকতাই যে ছিল মূল শক্তি ও প্রেরণা, যা সম্ভব করেছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হতে। অসাম্প্রদায়িকতার এমন ছবি বর্তমান বাংলাদেশে সচরাচর দেখা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা দিনু বিল্লাহ্র ‘টয় হাউজ থেকে ১৯৭১ : মৃত্যু ছায়াসঙ্গী’ বইটিতে সেই অসাম্প্রদায়িকতার গল্প, ভালোবাসার গল্প এবং কারা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছেন, তা আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।
দিনু বিল্লাহ্ শুরু করেন তাঁর নিজের মুক্তিযুদ্ধের গল্প দিয়ে। ১৯৬৪ সালে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র দিনু বিল্লাহ্কে উৎসর্গ করে দেন মা তাঁর ধর্মের ভাই অধ্যাপক অজিত গুহর হাতে; অকৃতদার ভাইয়ের দেখভাল করার জন্য। দিনু বিল্লাহ্ মাকে উদ্ধৃত করেন– ‘দাদার শরীর ভালো যাচ্ছে না। পাকিস্তান সরকার দাদাকে স্লো-পয়জন করেছে, গতকাল বাথরুমে পড়ে ছিলেন সারারাত। দাদাকে দেখার কেউ নেই, তাই আমি কথা দিয়েছি আমার একটি ছেলে তাঁকে সেবা দেবে এবং সেই ছেলেটি তুমি।’ দিনু বিল্লাহ্ অবাক হয়ে ভাবেন, ‘সংসারের কাজকর্মে ভাইবোনদের মধ্যে আমিই বেশি মাকে সাহায্য করি, সারাক্ষণ পাশাপাশি থাকি, সেই আমাকেই কিনা নিঃশর্তভাবে দিয়ে দিচ্ছেন তাঁর এক বিধর্মী ভাইকে!’
মুসলমানের ঘরে জন্ম নেওয়া দিনু বিল্লাহ্ কাকাবাবু অজিত গুহের কুমিল্লার একান্নবর্তী বৃহৎ পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন কীভাবে, সেই গল্প ধর্মের ভিত্তিতে কৃত্রিমভাবে তৈরি মানুষের মাঝখানের দেয়াল ভেঙে খান খান করে দেয়; মোচন করে সব বিভেদ রেখা। অজিত বাবুর সঙ্গে দিনু বিল্লাহ্র বসবাসের শুরু থেকেই বাড়িতে লেখা প্রতি চিঠিতেই উল্লেখ থাকে তাঁর কথা। দিনু বিল্লাহ্ তা উপলব্ধি করেন, যখন প্রথমবার গিয়েই তিনি দেখেন সবাই তাঁর নাম জানে, পরিবারের প্রতিটি সদস্য কীভাবে আপন করে নেন। কাকাবাবুর বাবা দিনু বিল্লাহ্কে বলেছেন, ‘অজিতের সব চিঠিতেই তোর কথা লেখা থাকে, তোকে আমরা সবাই চিনি। পূর্বজন্মে তুই আমাদের আপন কেউ ছিলি, না হলে তোর মা এমন করে কোনো সন্তানকে বিনা পণে দিয়ে দেয়?’
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বদ্ধমূল ধারণা ছিল, শিক্ষিত হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন করলে ওরা দেশ ছেড়ে চলে যাবে। এ লক্ষ্যে সরকার একের পর এক কৌশল অবলম্বন করে, গুন্ডা ও ধর্মান্ধ সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে, রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও শুধু হিন্দু হওয়ার কারণে নির্যাতন করা হতো, যাতে দেশত্যাগে বাধ্য হয়।
দিনু বিল্লাহ্ ওই সময়ের একটি বর্ণনা উপস্থাপন করেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জবানিতে, যা এ রকম : সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে জন্ম নেওয়া অজিত কুমার গুহ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে আর ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়াই তো পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। রাষ্ট্র তাঁকে ক্ষমা করেনি, বারবার কারারুদ্ধ করেছে। এটা তারা করেছে কারণ তৎকালীন সরকার চেয়েছিল, তিনি যেন ভারতে চলে যান। ভারতে চলে গেলে, ভাষা আন্দোলন যে ভারতের প্ররোচনায় হচ্ছে– এই অজুহাত দাঁড় করাতে পারে। এই উদ্দেশ্যেই প্রাদেশিক সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব অজিত বাবুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য কলকাতা চলে যেতে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এরপর মন্তব্য করেছেন, ‘কিন্তু তিনি গেলেন না, ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়ে রইলেন, তাঁর স্বপ্নের সংস্কৃতির মতোই।’
পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিকার হয়ে অজিত গুহকে জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপকের চাকরি হারাতে হয়। অধ্যাপক গুহ একটি উদাহরণ মাত্র। এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে পাকিস্তান আমলে। দিনু বিল্লাহ্ তাঁর বইয়ে তাঁর পিতৃতুল্য কাকাবাবু অধ্যাপক অজিত গুহ ঘিরে বাঙালির যে জীবনচর্চা, তার গল্প নির্মাণ করেন। অতএব অজিত গুহর কথা বারবার ফিরে ফিরে আসে।
অজিত গুহ চাকরি হারানোর পর দিশেহারা হয়ে পড়েন। নিজের সংসারের খরচ, বাড়ি ভাড়া, অতিথি আপ্যায়ন, কুমিল্লার বাড়ির বিশাল পরিবারের জন্য নিয়মিত অর্থ জোগান ইত্যাদি চিন্তায় ভীষণ ভেঙে পড়েন। এর ওপর আবার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অনেকেই প্রতারণা করেছেন অধ্যাপক গুহের সঙ্গে। অনেক অর্থও নষ্ট করিয়েছেন তাঁরা। এই দিশেহারা অবস্থাই অধ্যাপক গুহকে টেনে নিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। ১৯৬৯ সালের ১২ নভেম্বর নিজ শহর কুমিল্লার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়লেন। সেদিনই রাত সাড়ে ১১টায় ঢাকার টয় হাউজের বাড়িতে লেখকের কাছে ফোন আসে। শুনতে পান কাকাবাবুর মৃত্যু সংবাদ। একটি মুসলমান ছেলে একটি বৃহৎ হিন্দু পরিবারে কীভাবে তাঁদেরই একজন হয়ে উঠেছিলেন, তার দুটি উদাহরণ– ‘রাতে আবার ফোন এলো। প্রবোধ জ্যাঠা মশাই, অনিলদাকে বললেন : যত কষ্টই হোক, দিনুকে পাঠাতেই হবে। পরদিন সকালে রওয়ানা দিয়ে স্টেশনে নেমে দেখি দশ-বারোজন অপেক্ষা করছেন আমার জন্য।’
নিঃসন্তান গুহবাবুর মুখাগ্নির ধর্মীয় ক্রিয়া করার দায়িত্ব গুহ পরিবার অর্পণ করতে চেয়েছিল পুত্রপ্রতিম মুসলিম দিনু বিল্লাহ্কে। কিন্তু সমাজের ‘গণ্যমান্য’ ব্যক্তির পরামর্শে সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়। একসময় সে মৃতদেহের কাছে যায়, পা জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে কান্না নদী হয়ে যায়। সেই জলে চরণ ধৌত হয়। তাঁর আহাজারিতে আকাশ ভারি হয়ে ওঠে; পুরো বাড়িতে নেমে আসে বিষাদের করুণ ছায়া।
ড. এন এন তরুণ : ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড; সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ
nntarun@gmail.com
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com