গল্প

রাতকোকিলের ডাক

প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জায়েদ ফরিদ

রাতকোকিলের বুকফাটা ডাকে মরিয়মের ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকারে বালিশের তলা থেকে চিরুনি আর কাজলদানিটা সঙ্গে নিয়ে রোজকার মতো খুব সাবধানে খিল খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে। বারান্দায় জলচৌকির ওপরে বসল। দ্রুত চিরুনি চালিয়ে পরিপাটি করল মাথার চুল। শর্ষে তেলে প্যারা কাজলদানি থেকে তর্জনী দিয়ে অন্ধকারেই পরে নিল কালো টিপ।  
উঠানের দক্ষিণে বিশাল ঝিলপুকুর। পাড় ঘেঁষে ঝাঁকড়ামাথা এক-জঙ্গল পুরোনো শিউলি গাছ। পুবের আকাশ ফিকে হয়ে এলেও গাছের তলায় এখনও অনেক রাত। মৃদু বাতাসের নিঃশ্বাসে ঝুরঝুর খসে পড়ছে শিউলিরা। ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে গলায় পরল মরিয়ম। অঞ্জলি ভরা ফুল উঁচুতে তুলে ধরে অপেক্ষায় চেয়ে রইল ধোঁয়াশায় ঢাকা ঝিলপুকুরের দিকে তাকে নিয়ে যেতে আসবে শিউলিপরী।
একসময় পুকুরের ওপার থেকে কুয়াশার ঢেউয়ে ভেসে এলো আজানের সুর। আজান হলেই নাকি পরীরা অদৃশ্য হয়ে যায়। আজ সময় শেষ, আর আসবে না শিউলিপরী। অঞ্জলির ফুলগুলি গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। মালাটাকে সে ছুঁড়ে মারল ঝিলপুকুরের জলে। বোরখাবউয়ের ওপর খুব অভিমান হলো।
বোরখাবউ এক্কাগাড়িতে চড়ে শহরতলির ঝিলপুকুরে বেড়াতে আসে, যেমনি আসে আরও অনেকে। বিষ্যুদবার বিকেলে মরিয়মের সাথে দেখা হয় তার। মরিয়মকে সে আদর করে, গল্প শোনায়। তার সাথে সুখদুঃখের আলাপ করে।
একদিন মরিয়ম দূর থেকে আঙুল দিয়ে দেখায় ঝিলপুকুরের কিনারে।
বোরখাবউ জিজ্ঞেস করে–
‘ওগুলো কী ভাসছে মরিয়ম?’
‘আমার বই-খাতা, ছোট মা ফেলে দিয়েছে।’
আরেক দিন একই জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখায় মরিয়ম।
বোরখাবউ জিজ্ঞেস করে–
‘ওটা কী ভাসছে মরিয়ম?’
‘আমার সাদা ফ্রকটা, যেটা প’রে পরীর জন্য অপেক্ষা করতে বলছিলা তুমি, পরী আর আমারে নেবে না।’
হতাশায় ফুঁপিয়ে শ্বাস ফ্যালে মরিয়ম।
বোরখাবউ পায়ে পায়ে নেমে যায় জলের কিনারে। তুলে নেয় সাদা ফ্রকটা। একটু ছড়াতেই বুঝতে পারে, সেটা সামনে-পেছনে মাঝ বরাবর বঁটি দিয়ে কাটা। ফ্রকটা নাড়াচাড়া করতেই বোরখাবউয়ের হাতের দস্তানা ভিজে যায়। মরিয়ম ভাবে এবার তার হাতগুলো দেখতে পাবে। কিন্তু বোরখাবউ হাত থেকে দস্তানা খোলে না।
মরিয়ম অনুযোগ করে–
‘তোমার ঠান্ডা লাগবে তো।’
‘না আমাদের কখনও ঠান্ডা লাগে না।’
মরিয়ম আক্ষেপ করে–
‘তোমার পায়ে মোজা, হাতে দস্তানা, সারা গা বোরখায় ঢাকা, চোখে পর্দা, কেউ জানে না তোমার গায়ের রং কেমন!’
‘আমার গায়ের রং কারও গায়ের রঙের সাথে মেলে না মরিয়ম। কেউ দেখে ফেললে হাজারটা মানুষ আমাকে আঙুল দিয়ে দেখাবে, তখন আর আমার ঝিলপুকুরে তোমার সাথে গল্প করা হবে না।’
মরিয়ম ভয় পেয়ে যায়, মন থেকে উবে যায় বোরখাবউয়ের শরীরের রং দেখার ইচ্ছাটা। প্রসঙ্গ বদলে সে তবু জিজ্ঞেস করে–
‘আমার তো আর কোনো সাদা জামা নাই, তুমি যে বলছিলা সাদা রঙের জামা পরে শিউলিতলায় যেতে ...।’
‘বলেছিলাম, পরীরা সাদা রং ভালোবাসে, তাই। কিন্তু জামা না থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। পরীর দেশে কেউ পৃথিবীর পোশাক পরে যেতে পারে না। তোমাকে এবার কঠিন পরীক্ষা করার সময় এসেছে শিউলিপরীর। আমার ধারণা, পরীকে তুমি খুব ভালোবাসো আর তার কাছে যেতে হলে তুমি কঠিন অনেক কাজই করতে পারো। বলো, পারো না?’
‘হ্যাঁ পারি।’
‘তাহলে মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শোনো– মানুষের পোশাক তোমার প্রয়োজন নেই। কাল ভোরে তুমি পরবে শিউলি পোশাক।’
বোরখাবউয়ের উপদেশ-নির্দেশগুলো শুনে শীত-বিকেলেও মরিয়মের কপালে জমে উঠল বিন্দু বিন্দু ঘাম। বোরখাবউ তার অন্ধকার শরীর হাতড়ে বের করে আনল একটি সাদা রুমাল। ধীরে ধীরে মুছিয়ে দিল তার মুখ।
রুমালের মিষ্টি ঘ্রাণে ঘুম পেল মরিয়মের। বোরখাবউয়ের দেহের কালো চাদরে শুয়ে আছে সে, মাথাটা বাম বুকের নরম সিথানে। বোরখাবউয়ের বুকের অনেক গভীর থেকে একটা আওয়াজ উঠে আসছে। তার নিজের মায়ের বুকের শব্দটা এ রকম ছিল না। ভাবে মরিয়ম, ধুকপুক শব্দের পরিবর্তে সেখানে কেমন এক আহাজারির আওয়াজ।
সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান ভেসে আসতেই চঞ্চল হয়ে উঠল বোরখাবউ। ঘুমঘোরেও মরিয়ম তাকে সজোরে আঁকড়ে ধরল দু’হাতে। আবার সাদা রুমালটা বের হয়ে এলো। মিষ্টি ঘ্রাণে ঘুম এসে গেল তার।
উঠে পড়ল বোরখাবউ। ঝিলপুকুরের অবকাশযাপনকারীরা একে একে উঠে গেল সবাই। অবচেতন মরিয়মের কানে এসে ঢুকল তীব্র চিঁ চিঁ আওয়াজ। টগবগে শব্দ তুলে পুকুরের উল্টো দিকে বোরখাবউয়ের এক্কাগাড়িটাকে ছুটে যেতে দেখল সে।
রাতে কিছুতেই ঘুম এলো না মরিয়মের। রাতকোকিলের ডাক শুনে বিছানায় উঠে বসল সে। বালিশের নিচ থেকে ভাঁজ করা ওড়নাটা সঙ্গে নিয়ে ছুট দিল ঝিলপুকুরের ঘাটে। তালগাছের কাফ্ফে বাঁধানো ঘাটের শেষ ধাপে গিয়ে দাঁড়াল।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে জামাকাপড় খুলে ফেলল। হিমেল বাতাসে কাঁটা দিয়ে উঠল সারা গা, শিনশিন করে উঠল স্তন। ঠকঠক কাঁপুনি নিয়ে জলে নেমে পড়ল মরিয়ম। জলটা বেশ উষ্ণ, বোরখাবউয়ের বুকের মতো। লম্বা শ্বাস নিয়ে ডুব দিল। জলের তলায় যেন শুনতে পেল রাতকোকিলের করুণ ডাক আর বোরখাবউয়ের বুকের যন্ত্রণার শব্দ। জলের ওপরে মাথা তুলল মরিয়ম। নাহ্ আশপাশে কেউ নেই। সাদা ওড়না দিয়ে গা মুছে দৌড়ে শিউলি বাগানের অন্ধকারে ঢুকে পড়ল।

তাড়াতাড়ি মালা গাঁথতে হবে, আঙুলে সুচ ফোটাতে হবে, সেই রক্ত দিয়ে বুকের মাঝখানে টিপ দিতে হবে। বোরখাবউয়ের কথামতো একটি মালা পেঁচিয়ে নিল কোমরে আর একটি পরল গলায়। অঞ্জলি ভরে নিল আরও কিছু শিউলি। তারপর প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাত দুটো ওপরের দিকে প্রসারিত করে অপেক্ষায় চেয়ে রইল ঝিলপুকুরের জলে।
উঁচু করে রাখা হাত দুটো ব্যথায় টনটন করছে। সামান্য শিউলির ভারে নুয়ে পড়তে চাইছে। টুপটাপ শিশিরের বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে তার গা। দু-একটি ফোঁটা গলা থেকে শিরশির করে নেমে যাচ্ছে পায়ের আঙুল দিয়ে।
স্পষ্ট দেখল মরিয়ম, ঝিলপুকুরের বুকে সাদা জমাট কুয়াশা অপার্থিব অবয়বে শিউলির জঙ্গলে ঢুকে পড়ছে। শিউলিপরী আজ নিশ্চয় আসবে, বোরখাবউয়ের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস।
বাড়ির উঠোন থেকে হঠাৎ ভেসে এলো ছোট বউয়ের কটকটে গলার আওয়াজ–
‘কই গেল মইরম? যেইহানে খুশি মরুকগা, ভূত-পেতনি চোখে দ্যাহে না অরে। সতিনের ঝি!’
মরিয়মের বুক শুকিয়ে ওঠে। চোখ ফেটে জল আসে। শিউলিপরী আর আসবে না ...
রাগে গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকে আবার খিল এঁটে দিল ছোট বউ। মরিয়মের ঝাপসা চোখে চারদিকে আরও নিবিড় করে কুয়াশা নামল।
হঠাৎ আবছা দেখতে পেল, ঘন বাষ্প-শরীরে তার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে শিউলিপরী। কাছে এসে দাঁড়াতেই তার দ্যুতিতে শিউলিবনের অন্ধকার সরে গিয়ে জোছনায় ভরে গেল। গাছ থেকে ঝরে পড়ল সব শিউলি ফুল। কাছে এসে মাথা নোয়াল পরী। মরিয়ম গলার মালা খুলে পরিয়ে দিল তাকে। তার কপালে চুমু খেল শিউলিপরী। আনন্দে কেঁদে উঠল মরিয়ম। পরী তাকে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল কুয়াশার সাদা চাদর পেঁচিয়ে। শিউলিঝাড়ের ভেতর থেকে ডেকে উঠল রাতকোকিল। একটা পঙ্খিরাজ ঘোড়ার রথ এসে থামল ঝিলপুকুরের পাড়ে।
রথ চলতে শুরু করেছে। শিউলিপরীর বুকের চাদরটা একটু ফাঁক করে রথের জানালা দিয়ে দূরে তাকাল মরিয়ম। একটা বিশাল পাহাড়ি ঢাল বেয়ে লোকালয় ছাড়িয়ে ক্রমাগত ওপরে উঠছে রথ। ছোট হয়ে আসছে শিউলিবন, ঝিলপুকুর সবকিছু। হঠাৎ পাহাড়ের পাদদেশের লোকালয় থেকে ভেসে এলো ক্ষীণ আজানের ধ্বনি। মরিয়মের নাকে বোরখাবউয়ের রুমালের মিষ্টি ঘ্রাণ এসে ঢুকল।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com