
নিবন্ধ
সাফো-কথন
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০৩ মার্চ ২৩ । ০৯:৫১ | প্রিন্ট সংস্করণ
অপূর্ব চৌধুরী

গ্রিক শিল্পসাহিত্যে ধ্রুপদিকাল যখন পুরুষ-আধিপত্যের ইতিহাসে পরিপুষ্ট, তারও চারশ বছর আগে, প্রাচীন গ্রিসে এক জনপ্রিয় কবির দেখা মিলেছিল, যিনি ধ্রুপদি গ্রিসের প্লেটো ও অ্যারিস্টটল দু’জনের দ্বারাই উদ্ধৃত হয়েছিলেন। একই সঙ্গে গ্রিক থেকে রোমানদের হাত হয়ে খ্রিষ্টপরবর্তী সপ্ত শতাব্দী পর্যন্ত বহুলভাবে পঠিত, প্রচারিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী এক হাজার বছর প্রায় অপঠিত থেকে বিশ শতকের শুরুতে আবার ফিরে এসেছেন। এবং একুশ শতকে তাঁর কবিতা পুনঃপাঠ, আলোচনা এবং বিশ্লেষণ চলছে। তিনি প্রাচীন গ্রিক কবি সাফো।
গ্রিসের প্রথম সমপ্রেমী কবি সাফো দুটি কারণে ফিরে এসেছেন। একটি– তাঁর কবিতার যৌনধর্মিতা, একই সঙ্গে পুরুষ একাধিপত্যের বিপক্ষে একজন নারী হিসেব কবির অবস্থান। অপরটি হলো– তাঁর কবিতার মান; বিশেষ করে কবিতার লিরিক্যাল শক্তি।
সাফোর জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব সপ্ত শতাব্দীতে, ৬৩০ খ্রিষ্টপূর্বে। তাই তাকে বলা হয় আর্কাইক পিরিয়ডের লেখক ও দার্শনিক। জন্মস্থান গ্রিকের এজিয়ান সাগরের উত্তর পূর্বে লেজবস নামের একটি দ্বীপ। দ্বীপটি গ্রিকের ইতিহাসে মিথিলান নামে পরিচিত ছিল তখন। এটি গ্রিকের তৃতীয় বৃহৎ দ্বীপ। ষাট বছর বেঁচে ছিলেন প্রাচীন গ্রিকের এই শক্তিশালী কবি, মারা যান ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে । এই লেজবস দ্বীপ থেকেই বর্তমান লেসবো বা লেসবিয়ান শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ সমপ্রেমী নারী। লেসবিয়ান শব্দটির প্রচলন উনিশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশে শুরু হয়েছিল। প্রথম ব্যবহার পাওয়া যায় ১৮৬৯ সালে । এ শব্দ ব্যবহারের আগে সাফোর নাম থেকে নেওয়া সাফিক (Saphhic) শব্দ দ্বারা সমপ্রেম বোঝানো হতো। অপর অর্থে সাফিক শব্দ দিয়ে সাফোর কাব্য রীতিকেও বোঝায়।
সাফোর যেটুকু চিন্তাভাবনা, সেটা কাব্য এবং কবিতাতেই বিস্তৃত ছিল। আর্কাইক পিরিয়ড মানে হলো প্রাচীন গ্রিকের অন্ধকার যুগের পর প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম অর্ধেক। এই প্রথম অর্ধেকের পর এসেছিল গ্রিকের স্বর্ণযুগ– এর ধ্রুপদি যুগ, যখন দেখা পাই আমরা সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলদের। এই আর্কাইক পিরিয়ডে সাফোর মতো কবি নারী হয়েও প্রাচীন গ্রিকের সাহিত্য, দর্শন সুরের জগতে মৌলিক ভিত গড়ে তোলায় অবদান রেখেছিলেন, যার ওপর ভিত্তি করে প্লেটো-অ্যারিস্টটলদের কাজের ভিত গড়ে দিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
লেজবস দ্বীপে একটি ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ, পরবর্তী সময়ে কিছু সময়ের জন্য সিসিলিতে বসবাস এবং বাকি জীবন লেজবস দ্বীপে বসবাসের বাইরে ওই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি সাফোর জীবন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। সাফোর মৃত্যুর পর গ্রিসের হাত ধরে রোমানদের মাধ্যমে কিছু কবিতা সংরক্ষিত হয়। বিশ শতকের শুরুতে কিছু লেখার অংশবিশেষ মেলে সপ্তম শতকের প্যাপিরাসে।
সাফোর বেঁচে থাকার শক্তি তাঁর কবিতার গীতিধর্মিতা। কবিতাগুলো সাধারণ কবিতার আঙ্গিকে লেখা হতো, আর সুর বসালেই হয়ে উঠত গান। বর্তমানে সাফোর কবিতাংশ যা মিলেছে তাতে ধারণা হয় তিনি প্রায় দশ হাজার লাইনের বেশি লিখেছিলেন । যার মধ্যে হয়তো ৬৫০ লাইন উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
প্রাচীন গ্রিকে ৯ জন গীতিকবিকে বলা হতো মেলিক পোয়েট । মেলিক এসেছে গ্রিক শব্দ মেলিকস থেকে, মেলিকস এসেছে মেলস থেকে, যার অর্থ গান। পরবর্তী সময়ে মেলিকস ল্যাটিনে লিরিকস; ক্রমে লিরিক হয়েছে। এই মেলিক বা পরবর্তী সময় ৯ জন প্রধান কবিদের মধ্যে অন্যতম ও একমাত্র নারী ছিলেন সাফো। বাকিদের মধ্যে থিবাসের পিন্ডার, কিওসের সিমোনিডাস ও স্পার্টান কবি আলকম্যান ছিলেন বলে জানা যায়। প্রাচীন গ্রিকে গদ্যের সূচনা হওয়ার আগে গল্প বলা হতো কাব্যে। কবিতার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের কথা, জীবনের কথা, বেদনার কথা, বীরদের কথা মুখে মুখে বলা হতো। সেগুলো লিখিত আকারে পরবর্তী শতকে সংরক্ষিত হতো কিছু কিছু। তিন ধরনের কবিতা লেখা হতো গ্রিসে। এপিক (মহাকাব্যিক), ড্রামাটিক (নাটকীয়) এবং লিরিক (গীতিধর্মী)। প্রাচীন গ্রিকে ড্রামা বা নাটকগুলো লেখা হতো কাব্যে। নাটকের মূল ভাষ্য থাকত দুই ধরনের। হয় ট্র্যাজেডি, নয়তো কমেডি। সবচেয়ে বেশি কবিতা লেখা হতো লিরিক। দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা, রাজনীতি, দর্শন, তর্কবিতর্ক ইত্যাদিকে লিরিক বা গীতকাব্যে প্রকাশ করত প্রাচীন গ্রিক কবিরা। এই লিরিক কাব্য বা গীতিকবিতা কখনও সিম্পোজিয়ামে (গ্রিক শিল্পী দার্শনিকদের সভা-সমাবেশ) শুধু কবিতার আকারে পাঠ হতো, কখনও তারের মিউজিক যন্ত্র কিতারার মাধ্যমে একজন বাজাত, আরেক জন গাইত। প্রাচীন এই গীতিধর্মী কবিতাকে তুলনা করা যায় আজকের হিপ হপ কিংবা র্যাপ মিউজিকের সাথে। এই হিপ হপ অথবা র্যাপ মিউজিকে কথাই মূল। একটি বিষয়কে কাব্যের ঢঙে কথার মধ্যে ফুটিয়ে তোলা হয়, কখনও বাদ্যযন্ত্র বাজে, কখনও থাকে না।
সাফোর কাব্যের মূল বিষয় ছিল প্রেম। আবার সেই প্রেমের কিছু অংশে একটি নির্দিষ্ট প্রকারের প্রেমের কথা আছে; নারীর প্রতি নারীর প্রেম। কাব্যগুণ ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে ভালোবাসার এই বহুমাত্রিক মুক্তপ্রকাশের কারণে সাফো পরবর্তী অনেক পুরুষ কবির ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন ।
জানা যায়, সাফোর বেশির ভাগ কবিতা খ্রিষ্টপরবর্তী পাঁচশ বছরে প্রায় নিখোঁজ ছিল। ১৮৯৬ সালে অক্সেফার্ডের দু’জন প্রত্নতাত্ত্বিক বার্নার্ড গ্রিনফেল এবং আর্থার হান্ট মিসরে গিয়ে প্যাপিরাসের ওপর কাজ করতে গিয়ে সাফোর কিছু কবিতার অংশবিশেষ খুঁজে পান। সাফো গ্রিক পরবর্তী রোমানদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন এবং একসময় মিসরের কিছু অংশ রোমকদের দখলে ছিল। ধারণা করা হয়, সাফোর মৃত্যুর কয়েক শ বছর পর কিছু কবিতা লিখিত আকারে সংরক্ষিত হয়েছিল, যেগুলো রোমকদের হাত ধরে রোম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সাফোর মৃত্যুর এক হাজার বছর পরে সেগুলো সংরক্ষিত হয় এবং এরও দেড় হাজার বছর পর উদ্ধার করা হয়।
সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তী কবি সাফোর ব্যক্তিসত্তা অনেকটাই অজানা। তবে তাঁর কাজের যে পাঁচ শতাংশ আমাদের কাছে আছে বা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তা থেকেই তাঁর কাব্যশক্তির প্রখরতা অনুমান করা যায়। গত একশ বছরে সাফোর কবিতা আধুনিক অনেক লেখক কবিকে প্রভাবিত করেছে। প্রভাবিতদের তালিকায়ে রয়েছেন ভার্জিনিয়া উল্ফ, নাতালিয়া বার্নি, সিডনি আবোট, মেরি বার্নার্ডের মতো লেখকেরা। সাফোর কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত এ লেখকদের রচনাবলি নারীর অস্তিত্ব, সংকট ও সামাজিক সমতায়নে ভূমিকা রেখেছে।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com