
পঞ্চগড়ে হামলা ও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত শতাধিক পরিবার
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০৫ মার্চ ২৩ । ০৫:৫৩ | প্রিন্ট সংস্করণ
সফিকুল আলম, পঞ্চগড়

ঘরবাড়ি হারিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অনেকে এখন খোলা আকাশের নিচে। শনিবার পঞ্চগড়ের আহমদনগর এলাকা থেকে তোলা - সমকাল
পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জলসাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধদের দেওয়া আগুন ও হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শতাধিক পরিবার। পুলিশ ও মুসল্লিদের সংঘর্ষের ঘটনায় শহরে এখনও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। গতকাল শনিবার সকাল থেকে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও শহরে অতিরিক্ত পুলিশ ও বিজিবির টহল দেখা গেছে। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নিয়োগ করা হয়েছে স্ট্রাইকিং ফোর্স। তবে পঞ্চগড় রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার পেছনে জামায়াত-শিবিরসহ বহিরাগতরা সক্রিয় ছিল বলে দাবি পুলিশের।
গতকাল সকালে আহমদনগরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওই অনুসারী কবির হোসেনের বাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে তখনও আগুনের ধোঁয়া বের হচ্ছে। তাঁর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বাড়ির আসবাব, নগদ টাকাসহ সবকিছুই পুড়ে গেছে। তাঁর মতো ওই এলাকার শতাধিক বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। আহমদনগর উচ্চ বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধরা।
ওই সম্প্রদায়ের অনুসারীরা এখনও আতঙ্কে রয়েছেন। শতাধিক বাড়ির নারী-শিশু আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। সালানা জলসা থেকে শুক্রবার রাতে বাড়ি ফিরে তাঁরা দেখেন তাঁদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। বাড়িঘরে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
শালশিড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কৃষিশ্রমিক দবিরুল আহমদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আগুনে ধ্বংস হওয়া বাড়ির এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছেন। কান্নারত অবস্থায় তিনি বলেন, আমরা তো নিরীহ মানুষ। আমাদের কী অপরাধ, আমরা তো কারও কোনও ক্ষতি করিনি। তাহলে আমাদের এই সর্বনাশ কেন। আমরা কি বাংলাদেশের নাগরিক না। আমাদের সুরক্ষা কে দেবে? এখন আমরা কোথায় যাব, কী নিয়ে থাকব?
জেলা শহরের এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে আহমদনগর এলাকা থেকে বোদা উপজেলার ফুলতলা, শালিশিড়ি পর্যন্ত আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তিন হাজারের মতো পরিবার ধীর্ঘদিন থেকেই বসবাস করে। প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় কয়েকটি গ্রামজুড়ে বসবাসকারী এসব পরিবারে বিচ্ছিন্নভাবে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
আহমদনগরের আলতাফ হোসেন বলেন, আমি জলসা মাঠেই ছিলাম। রাতে জলসা বন্ধের পর বাড়িতে গিয়ে দেখি সব শেষ। সব মিলিয়ে এখানে শতাধিক বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, গতকাল বিকেলে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত আরিফুর রহমানের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করেছেন খতবে নবুওয়তের নেতাকর্মী ও পরিবারের লোকজন। তাঁরা আরিফকে শহীদ দাবি করে রক্তমাখা শরীর এবং পরনের রক্তমাখা কাপড়সহ কাফনের কাপড় পরান। জানাজায় কয়েক হাজার মুসল্লি অংশ নেন।
তবে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী নিহত জাহিদ হাসানের মরদেহ প্রাথমিক সুরতহাল এবং পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলে পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। বিকেলে আহমদনগর এলাকায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিং করা হয়। এতে আহমদিয়া মুসলিম জামায়াতের বহিঃসম্পর্ক, গণসংযোগ ও প্রেস বিভাগের প্রধান আহমদ তবশির চৌধুরী দাবি করেন, হামলার ঘটনায় তাঁদের সম্প্রদায়ের একজন নিহতসহ ১৮০ বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে তাঁদের ৭০ জন আহত হন। এর মধ্যে ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা বলেন, এখনও কোনো মামলা হয়নি। এ ঘটনায় ১২ জনকে আটক করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় শহরে পুলিশ ও বিজিবির টহল রয়েছে।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, আমরা আন্দোলনকারীদের বারবার বলেছি, এখানে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন রয়েছে, এখানে জামায়াত–শিবিরের ইন্ধন রয়েছে এবং জঙ্গিগোষ্ঠীরও ইন্ধন থাকতে পারে। সবাই মিলে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে নৈরাজ্য তৈরি করার জন্য তারা এটা করেছে।
সরকারি মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজকর্মী হাসনুর রশিদ বাবু বলেন, পঞ্চগড়ের সাধারণ মানুষ তথা মুসল্লিরা বেশ শান্তিপ্রিয়। এখানে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে একটি পক্ষ নেপথ্যে থেকে কাজ করেছে। জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে অসংখ্য বহিরাগত ছিল। একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের সক্রিয় দেখা গেছে।
একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা-বাবা: সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে আরিফুর রহমান (২৭)। তিনি জেলা শহরের একটি প্রিন্টিং প্রেসে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন। পাশাপাশি পৌর এলাকার ২নং ওয়ার্ডের কাজী আব্দুর রহমানের সহকারী হিসেবেও মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে বিয়ে পড়াতে যেতেন। দুই জায়গায় কাজের সামান্য আয় দিয়েই বাবা-মাকে নিয়ে একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতেন। একমাত্র ছেলে হারিয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকছেন বাবা-মা। আবার কখনও হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন তাঁরা।
শহরের ইসলামবাগ মহল্লার আরিফুর রহমান পঞ্চগড় টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ থেকে কৃষি ডিপ্লোমা কোর্স করেছিলেন। বাবা ফরমান আলী ছিলেন ট্রাক্টরচালক। বয়সের কারণে আর গাড়ি চালতে পারছেন না। মা আলেয়া বেগম গৃহিণী। নিহত আরিফের আয় দিয়েই সংসার চলত।
আরিফের বাবা বলেন, আমার ছেলে কখনও কোনো রাজনীতি করেনি। প্রেসে কাজ করত এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় সে আহত হয়। ছেলের আয় দিয়েই সংসার চলত, আমার সব শেষ হয়ে গেল– বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন ফরমান আলী।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com