
‘মেয়েটা ভাগ্যবান, সঙ্গে বাবাকেও নিয়ে গেল’
প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ০৬ মার্চ ২৩ । ০৫:৪২ | প্রিন্ট সংস্করণ
বকুল আহমেদ

বিস্ফোরণে মারা যাওয়া আবদুল মান্নানের স্ত্রী ও ছেলের আহাজারি - সমকাল
আবদুল মান্নানের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ১১ বছরের মেয়ে মনিরা আক্তার মিনহা মারা গেছে মাত্র ১৮ দিন আগে। লাশ দাফন করা হয়েছে পুরান ঢাকার আজিমপুরে। তার অকালমৃত্যুতে দুই ভাই ও মা-বাবা ছিলেন শোকে কাতর। প্রায় প্রতিদিন মেয়ের কবর দেখতে যেতেন মান্নান। সর্বশেষ শনিবার সন্ধ্যায়ও কবরস্থানে গিয়েছিলেন। এর পরদিন তিনিও অনন্তপথের যাত্রী হলেন।
ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে পরিবারের সদস্যদের বুকফাটা আর্তনাদ যেন কোনোভাবেই থামছিল না। তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছেন স্বজনরা। কী সান্ত্বনা দেবেন এই পরিবারটিকে!
মান্নানের ছোট ছেলে শাকিল বিলাপ করছিলেন, ‘কালকেই (শনিবার) আমার বোনের কবরে পানি দিয়ে এসেছেন আব্বা। রাতে আমাকে বলল, তুই যাস না, কবরে পানি দিয়ে এসেছি। পরদিনই আব্বা কবরের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছেন। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! বোনের সঙ্গে আব্বাও চলে গেল। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। আমার আব্বারে এনে দাও তোমরা।’
শুধু আব্দুল মান্নানের পরিবারই নয়, গতকাল রোববার স্বজন হারানো তিন পরিবারের আর্তনাদে শোকাচ্ছন্ন আবহ তৈরি হয় ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে। গতকাল সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বিস্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধসে আব্দুল মান্নানসহ (৬২) প্রাণ হারান তিনজন। শক্তিশালী বিস্ফোরণে ভবনটির তিনতলার অফিস থেকে দেয়াল ধসে ছিটকে রাস্তায় পড়েন তাঁরা। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁদের। মারা যাওয়া অন্য দু’জন হলেন– শফিকুজ্জামান শফিক (৪৭) ও সাদিকুর রহমান তুষার (৩৫)। তিনজনই নিউ জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডে কর্মরত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি পেনসিল, কলম, জ্যামিতি বক্সসহ স্টেশনারি মালপত্র সরবরাহ করে। সায়েন্স ল্যাব এলাকায় মিরপুর সড়কের পাশে ৩৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের তিনতলা ভবনের তিনতলার একাংশে নিউ জেনারেশনের প্রধান কার্যালয়। ওই কোম্পানিতে ৪০ বছর ধরে অফিস সহকারী পদে কর্মরত ছিলেন মান্নান। শফিকুজ্জামান শফিক প্রায় ২০ বছর ওই প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার অপারেটর ছিলেন। আর সাদিকুর রহমান তুষার ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির স্টোরকিপার কাম কম্পিউটার অপারেটর।
আব্দুল মান্নানের স্ত্রী সাহিদা আক্তার আর্তনাদ করে বলেন, ‘মেয়ের শোক। স্বামীর শোক। সহ্য করব কী করে। মেয়েটা ভাগ্যবান, সঙ্গে বাবাকেও নিয়ে গেল। আমাকেও নিয়ে যাও তোমরা।’ তিনি জানান, প্রতিদিনের মতো গতকাল সকাল ৯টার দিকে বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশে মান্নান বের হন। সকাল ১১টার দিকে তাঁরা মান্নানের অফিসে বিস্ফোরণ ও আগুনের খবর পান। ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। ততক্ষণে লাশ নিয়ে রাখা হয় ঘটনাস্থলের অদূরে পপুলার হাসপাতালে।
মান্নানের ভাতিজা মামুন জানান, তাঁর চাচার গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কোনাপাড়ায়। তবে দীর্ঘদিন পুরান ঢাকার চকবাজারের ইয়াসিন গলিতে ভাড়া বাসায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করছিলেন। আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। তাঁর বড় ছেলে মোসাদ্দেক হোসেন আশিক নিউমার্কেট এলাকার একটি জুতার দোকানের বিক্রয়কর্মী আর ছোট ছেলে শাকিল আরেকটি দোকানের কর্মচারী। মান্নানের মেয়ে মিনহা দীর্ঘদিন রোগে ভুগে ১৮ দিন আগে মারা গেছে। আজিমপুর কবরস্থানে মেয়ের কবরের পাশেই মান্নানকে দাফন করার ইচ্ছা পরিবারের।
নিহত শফিকুজ্জামান শফিক স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করতেন সাভারের গেন্ডায়। প্রথমে শফিকের মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি তাঁর স্ত্রী পপি আক্তারকে। দুর্ঘটনায় স্বামী অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন–এমন খবর পেয়ে দুপুর ২টার দিকে পপুলার হাসপাতালে ছুটে আসেন পপি। হাসপাতালে আসার পর জানতে পারেন, শফিক আর বেঁচে নেই। স্বজনদের জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘সন্তানদের কেন এতিম বানিয়ে চলে গেলে তুমি। বাবার ছায়া সরিয়ে নিলে কেন। আমরা থাকব কী করে। চলব কীভাবে। বাঁচব কী নিয়ে।’ কাঁদতে কাঁদতে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে যান তিনি। স্বজনরা চোখেমুখে পানির ছিটা দেন।
পপি আক্তার জানান, তাঁর স্বামী কয়েক দিন ধরে বলছিলেন, এ বছরটা চাকরি করার পর ছেড়ে দেবেন। পরিবার নিয়ে রাজবাড়ী চলে যাবেন। তাঁদের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে আরাফুজ্জামান প্রান্ত সাভারের একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে তায়েবার বয়স তিন বছর। শফিক সাভার থেকে প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করতেন। নিহত সাদিকুর রহমান তুষারের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করতেন ঢাকার বাসাবো এলাকায়।
নিহত তিনজনকে ছিটকে পড়তে দেখেন একই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী খায়রুল ইসলাম। দুর্ঘটনায় তিনি সামান্য আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, মান্নান, শফিক, তুষার ও হান্নান নামের আরেকজন দেয়ালের পাশে চেয়ারে বসে কাজ করছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দ হয়ে দেয়াল ধসের সঙ্গে চারজনই ছিটকে বাইরে পড়েন। তিনি বলেন, ‘মনে হলো বিস্ফোরণে তারা উড়ে গিয়ে নিচে পড়ল। আমরা তিনজন বেঁচে যায়। পরে পাইপ ও কার্নিশ দিয়ে নিচে নেমে আসি আমরা।’ তিনি জানান, হান্নান ওই প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক। ছিটকে রাস্তায় পড়ায় তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com