মতামত

আমেরিকার 'বন্দুক-সন্ত্রাস' কমবে কবে?

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২৩ । ১৯:৪২ | আপডেট: ০৬ মার্চ ২৩ । ২০:১৭

সাদিক হাসান ইমন

বন্দুক সহিংসতা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবাদ

আমেরিকায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে ‘ম্যাস শুটিংয়ে’র মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা। এভাবে অযাচিত বন্দুক ব্যবহারের বাতিক অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এর পরিণতি কী হতে পারে– তা নিয়ে চিন্তিত সেখানকার বিশ্লেষকরা! আমেরিকার এই দুর্ভাগ্যের পরোক্ষ ছাপ পড়ছে তার সঙ্গে যুক্ত বিশ্বসমাজেও। বস্তুত আমেরিকান বিপ্লবের আগে আমেরিকান সরকারের পূর্ণকালীন সেনাবাহিনী রাখার মতো বাজেট, জনবল বা ইচ্ছা ছিল না। তাই বিদেশি সেনাবাহিনী ও নেটিভ আমেরিকানদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষায় আমেরিকানরা অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা আত্মরক্ষার কাজে অস্ত্র ব্যবহার করত। সে কারণেই সুইজারল্যান্ডভিত্তিক স্মল আর্মস সার্ভের (এসএএস) একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে জনসংখ্যা থেকে অস্ত্রের সংখ্যা বেশি। ১০০ জন মানুষ গড়ে প্রায় ১২১টি অস্ত্র বহন করে এবং সংখ্যাটি বেড়েই চলেছে। 

অনেক আমেরিকানই তাদের অস্ত্র বহনের অধিকারকে পবিত্রতা হিসেবে বিবেচনা করে। এসএএসের তথ্যমতে, বিশ্বের ৮৫৭ মিলিয়ন অস্ত্রের মধ্যে প্রায় ৩৯৩ মিলিয়ন অস্ত্রই আমেরিকানদের দখলে; যা মোট অস্ত্রের প্রায় ৪৬ শতাংশ। তা ছাড়া এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বর্তমানে নতুন ক্রেতার পরিমাণই বেশি এবং অনূর্ধ্ব ২১ বছর বয়সীদের দ্বারাই অপরাধ বেশি সংঘটিত হচ্ছে। তাই ১৮-২০ বছর বয়সী আমেরিকানের কাছে অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে তাদের যাচাই করার আইন জারি করা হয়েছে। আইনটি প্রতিটি অঙ্গরাজ্য মানতে শুরু করলেও, ক্যালিফোর্নিয়া আদালতের মাধ্যমে এটি বাতিল করে। ফলে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের জন্যও আইনটি হুমকির মুখে পড়েছে।

আমেরিকায় স্কুল, পার্ক, রাস্তা, রেস্তোরাঁ, উপাসনালয়, এমনকি বাসা– সবখানেই যেন নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ হানা দিচ্ছে। কারণ, স্থান-কাল নির্বিশেষে প্রতিনিয়ত আগ্নেয়াস্ত্র হামলায় অহরহ মানুষ আহত বা নিহত হচ্ছে। এমনকি গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের তথ্য বলছে, আমেরিকান শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ আগ্নেয়াস্ত্র। সম্প্রতি তার উপযুক্ত প্রমাণ মিলছে স্কুলগুলোতে বন্দুক-সহিংসতার ঘটনাগুলো থেকেই। এই অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংসতা প্রতিরোধে ইতোমধ্যেই স্কুলগুলোতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। যেমন– স্কুলের প্রবেশদ্বারে সতর্কতা বৃদ্ধি, শিক্ষকদের বন্দুক চালনায় প্রশিক্ষণ দেওয়া, নিরাপত্তাকর্মীদের দ্বারা কঠোর মনিটরিং ইত্যাদি। তবে চিন্তার বিষয়, বেশিরভাগ শিক্ষকই অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। অন্যদিকে রক্ষণশীল বন্দুকের মালিকরা বলছেন, স্কুলগুলোতে সরকারি দপ্তরগুলোর মতো নিরাপত্তা বাড়ালে শিশুমৃত্যু কমানো যেতে পারে। তবে সরকারি দপ্তরগুলোর তুলনায় অত্যধিক সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই রকম নিরাপত্তা দেওয়া কষ্টসাধ্য বলে ধারণা করা হচ্ছে। তা ছাড়া অনেকেই বলছেন, স্কুল, সরকারি অফিস, হাসপাতাল ও পরিবহনে বন্দুক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হোক। কিন্তু সমীক্ষায় দেখা যায়, যেসব জায়গায় বন্দুকের ব্যবহার কম, সেখানে সহিংসতার হার বেশি। এর রেশ ধরে রক্ষণশীল বন্দুক ব্যবহারকারীরা বন্দুক আইন শিথিলের ব্যাপারে পাল্টা উপদেশ দিচ্ছেন।

আমেরিকায় গত কয়েক বছরে ম্যাস শুটিংয়ের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। কোনো ব্যক্তি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে যদি একই সঙ্গে চার বা তার অধিক ব্যক্তিকে আহত বা নিহত করে, তবে সেটা ম্যাস শুটিং বলে গণ্য হয়। ২০১৪ সালে এ ঘটনার সংখ্যা ছিল ২৭৩; ২০১৫ সালে ৩৩৬; ২০১৬ সালে ৩৮৩; ২০১৭ সালে ৩৪৮; ২০১৮ সালে ৩৩৬; ২০১৯ সালে ৪১৭; ২০২০ সালে ৬১০; ২০২১ সালে ৬৯০ এবং ২০২২ সালে ৬৪৭। তা ছাড়া এ বছর সংখ্যাটি ইতোমধ্যে ৮০ ছাড়িয়েছে। কিন্তু সংখ্যাটি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা অনুমান করা দুরূহ! ২০২১ সালে বন্দুক-সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছিল মোট ৪৮৮৩০ জনের, যা ২০২০ সালের ৪৫২২২ জনের চেয়ে প্রায় ৮ শতাংশ বেশি এবং ২০১২ সালের চেয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ বেশি। তা ছাড়া ২০২২ সালে এই সংখ্যাটি ৪০ হাজারেরও বেশি।

অনেকে বলছেন, মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিরাই শুটিংয়ের সঙ্গে বেশি জড়িত। পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। ম্যাস শুটিংয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশের মতো মানসিক বিকারগ্রস্ত। আবার কেউ কেউ বলছেন, যখন তাপমাত্রা বেশি থাকে তখন বন্দুক-সহিংসতার পরিমাণ বাড়ে। তাপমাত্রা বেশি হলে বাইরে লোক সমাগম বৃদ্ধি পায় এবং হামলাকারীর মাথা গরম থাকে। অনেকে বলছেন, হামলাকারীর কেউ কেউ হতাশাগ্রস্ত হয়ে কাজটি করছে। এ ছাড়া অনেকে শুধু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার জন্য হামলা চালাচ্ছে বলেও বেশ কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে। চারপাশে এত এত বন্দুক-সহিংসতার ঘটনা বিবেচনায় এনে কঠোর বন্দুক আইন প্রয়োগ করা জরুরি। ২০২২ সালের অক্টোবরে গ্যালাপের একটি জরিপে দেখা যায়, ৫৭ শতাংশ আমেরিকান এমনটাই ভাবছে। তবে ৩২ শতাংশ আমেরিকান বর্তমান আইনগুলোকে বহাল রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেছে।  ১০ শতাংশ আমেরিকানের মত– বন্দুক আইন আরেকটু শিথিল করা হোক। বন্দুক আইনের ব্যাপারে কূটনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ জনতা– সবার মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। গ্যালাপের আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৯১ শতাংশ ডেমোক্র্যাট কঠোর বন্দুক আইনের পক্ষে থাকলেও, মাত্র ২৪ শতাংশ রিপাবলিকান তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ‘রেড ফ্লাগ ল’ (অন্য মানুষের ক্ষতি করতে পারে, এমন সন্দেহভাজন মানুষের কাছ থেকে পুলিশ অস্থায়ীভাবে বন্দুক বাজেয়াপ্ত করতে পারবে) চালুর ব্যাপারেও জনসাধারণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। 

সরকারের অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রের বিনিময়ে পুরস্কার ঘোষণার উদ্যোগও খুব একটা কার্যকর হয়নি। এ ছাড়া  দফায় দফায় কঠোর বন্দুক আইন চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, যথেষ্ট সমর্থনের অভাবে সেগুলো সিনেটে আটকে আছে। তবে আমেরিকা যদি বন্দুক-সহিংসতার ব্যাপারে কঠোর আইন বা কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারে, তবে ভবিষ্যতে তা তাদের সভ্যতা বা সমৃদ্ধির জন্য বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে– এটা অনেকেই বলছেন এখন। 

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com