প্রচ্ছদ

অদেখা চোখে দেখা

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ফারুক মঈনউদ্দীন

নিস্তব্ধতা কীভাবে উটের গ্রীবার মতো হতে পারে? একজন কবি কীভাবে দেখেন, থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে এসে কথা বলছে? কিংবা শীতের রাতে ইঁদুরের রেশমের মতো রোমে খুদ মাখামাখি হয়– কে দেখেছে এসব অলৌকিক নিবিড় দৃশ্য? কেউ কেউ দেখতে পায় বলেই এরকম হিরণ্ময় পংক্তিমালা অবিরল ঝরনার মতো নেমে আসে হৃদয়ের উৎরাই বেয়ে। নয়ন তাদের দেখতে পায় না, তবু নয়নের মধ্যেই ঠাঁই তার, আর সেসব ধরা দেয় এক অদেখা চোখের আলোয়। অদেখা চোখের আলো যাঁদের থাকে, তাঁরাই সৃষ্টি করতে পারেন অমর কবিতা, জন্ম দিতে পারেন কালজয়ী চিত্রকলার, সপ্তসুরকে জয় করে চারপাশ ভরিয়ে তুলতে পারেন স্বর্গীয় সুরের মূর্ছনায়। এটি তাঁরা পারেন কারণ, ‘তাঁদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা’থাকে। এই ‘চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা’যে কেবল কবিকুলেরই থাকে তা নয়, সেটি থাকে সকল সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে। তিনি কবি বা শিল্পী হতে পারেন, হতে পারেন ভাস্কর বা চিত্রকর, লেখক, সুরশিল্পী বা বৈজ্ঞানিকও হতে পারেন।
সসীম বাস্তবের কথা চিন্তা করে একজন স্বতন্ত্র সারবত্তার মানুষ বলেন যে জীবনের মধ্যে থাকে বাস্তব, সেই অসংলগ্ন অব্যবস্থিত জীবনকে দেখে সৃষ্টিশীল মানুষের কল্পনাপ্রতিভা সম্পূর্ণভাবে তৃপ্ত হয় না। আরও নির্দিষ্ট করে তিনি বলেন, ‘কবিতা সৃষ্টি করে কবির বিবেক সান্ত্বনা পায়, তার কল্পনা-মনীষা শান্তি বোধ করে, পাঠকের ইমাজিনেশন তৃপ্তি পায়।’এই কল্পনাপ্রতিভা একজন বৈজ্ঞানিকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জগদীশচন্দ্র বসু এটা স্বীকার করে বলেছেন, কবিত্ব-সাধনার সঙ্গে বৈজ্ঞানিকের সাধনার ঐক্য আছে। কবি যেমন হৃদয়ের দৃষ্টি দিয়ে অরূপকে দেখতে পান, অন্যের দেখা যেখানে শেষ হয়ে যায়, সেখানে তাঁর দৃষ্টি চলমান থকে। তেমনি বৈজ্ঞানিকও ‘দৃষ্টির আলোক’ যেখানে শেষ হয়ে যায়, সেখানে তিনি আলোকের অনুসরণ করতে থাকেন, শ্রুতির শক্তি যেখানে সুরের শেষ সীমায় পৌঁছায়, সেখান থেকেও কম্পমান বাণী আহরণ করে আনেন। উভয়ই তাঁদের উদ্দিষ্টে পৌঁছাতে ব্যবহার করেন ভিন্ন পথ। একজন যান ভাবের পথে, আরেকজন বাস্তব পথে। এটি সম্ভব হয় এই উভয় স্রষ্টার রয়েছে অন্তরের অদেখা দৃষ্টি।
অন্তরের অদেখা চোখের কথায় বৈজ্ঞানিকের প্রসঙ্গ যখন এসেই যায়, তাহলে আইনস্টাইন প্রসঙ্গও অনিবার্য হয়ে ওঠে। বিখ্যাত আপেক্ষিকতা তত্ত্ব উদ্ভাবনের বেশ কয়েক বছর পর সাংবাদিক তাঁকে তাঁর চিন্তার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে তিনি কোনো জটিল সমীকরণ বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রয়োগ করে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেননি। সহজভাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ইনটুইশন এবং প্রেরণায় বিশ্বাস করি। কখনও ভাবি যে আমি সঠিক। জানি না আমি সঠিক কিনা, তবে ভুল প্রমাণিত হলে অবাক হতাম আমি। নিজের কল্পনাপ্রতিভার ওপর ভর করে স্বাধীনভাবে ছবি আঁকার মতো যথেষ্ট যোগ্য শিল্পী আমি। জ্ঞানের চেয়ে কল্পনাপ্রতিভা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞান সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে কল্পনাপ্রতিভা প্রগতিকে উদ্দীপিত করে বিবর্তনের জন্ম  দিয়ে বেষ্টন করে থাকে পুরো বিশ্বকে।’   
মানুষের এই কল্পনাপ্রতিভার মূল অনুষঙ্গ ও নিয়ামক হচ্ছে মনের অগণিত চোখ। সেই চোখ দিয়ে মানুষ কালো রঙের মধ্যে দেখতে পায় রংধনুর সপ্তবর্ণ, অথচ সাদা চোখে সেটি কালোই। সুতরাং যেকোনো সৃষ্টির পেছনে থাকে মানুষের কল্পনাপ্রতিভা, সেটি আহরিত হয় মনের চোখ দিয়ে। কল্পনাপ্রতিভাই যুগে যুগে মানুষকে প্রলুব্ধ করেছে অজানা বিশ্বের আহ্বানে, অদেখা রহস্যের সন্ধানে। রাইট ভাইয়েরা যদি কল্পনায় আকাশে ওড়ার স্বপ্ন না দেখতেন, মানুষের আকাশচারী হয়ে দেশান্তরে পাড়ি দেওয়া বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করত কিনা, সংশয় থাকে। কল্পনাপ্রতিভা দিয়েই মানুষ তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিরন্তর অগ্রগতির সঙ্গে মানবসভ্যতার ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষের পেছনে ছিল মানুষের কল্পনাপ্রতিভাপ্রসূত ধারণার বাস্তবায়ন।
বিশ্বের যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনগুলো যখন বদলে দিচ্ছিল মানুষের জীবনযাপন, উন্মোচিত হচ্ছিল একের পর এক আবিষ্কার, তখনও সাধারণ মানুষের কল্পনায়ও আসেনি যে মানুষ কখনও লক্ষ মাইল দূরে দেখা যাওয়া চাঁদের মাটিতে হেঁটে বেড়াতে পারবে, কিংবা আদৌ ভাবতে পারেনি চাঁদ জিনিসটা মাটির তৈরি। চাঁদে যাওয়ার বিষয়টা কল্পবিজ্ঞান লেখকদের লেখায় এসেছিল হয়তো। কিন্তু একদল প্রতিভাবান মানুষের কল্পনাপ্রতিভা এবং উদ্ভাবনীশক্তির মেলবন্ধনে সাধারণ মানুষের পক্ষে অকল্পনীয় সেই ঘটনাটি সম্ভব হয়েছে। এরকম আরও বহু উদাহরণের মাধ্যমে দেখানো সম্ভব, মানুষের কল্পনাশক্তির ক্ষমতা মানবসভ্যতার বিবর্তনে এবং বিজ্ঞানের উৎকর্ষে কতখানি ভূমিকা রেখেছে। জুল ভার্ন যদি তাঁর কল্পনাপ্রতিভা দিয়ে আলবাট্রস নামের খাড়া উঠে যেতে সক্ষম একটা উড়ন্তযানের কথা লিখে না যেতেন, তাহলে প্রায় অর্ধশতাব্দী পর অ্যারোপ্লেনের মতো দীর্ঘ দৌড় না দিয়ে সোজা ওপরে উঠে যাওয়া হেলিকপ্টার আবিষ্কৃত হতো কিনা জানার উপায় নেই।
তবে অতিরিক্ত কোনো বিষয় যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত, তেমনি কল্পনাপ্রতিভার আতিশয্যও মূল প্রতিপাদ্যকে ছাড়িয়ে চলে যেতে পারে ভিন্ন পথে। সেটিকে তখন আর কল্পনাপ্রতিভা বলা যায় না, সেটি পর্যবসিত হয় কল্পনাবিলাসে। যেমন আইনস্টাইনের তত্ত্বটি প্রকাশিত হওয়ার পর সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ জটিল এই বিষয়টির নানাবিধ ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছিল নিজ নিজ কল্পনাশক্তির নিরিখে।  
এরকম একটা অপব্যাখ্যায় ধারণা দেওয়া হয়, আপেক্ষিকতা তত্ত্বটি দিয়ে বোঝানো যায় যে সবকিছুই আপেক্ষিক। পুরোনো সবকিছু বাতিল, কোনো কিছুই আর নির্দিষ্ট বা চূড়ান্ত নয়। চরম হাস্যকর এসব ব্যাখ্যার মাধ্যমে আপেক্ষিকতা যেন দার্শনিকের খেলনায় পরিণত হয়েছে–এমন বক্তব্যের জবাবে আইনস্টাইন শান্ত কণ্ঠে বুঝিয়ে বলেছিলেন যে ধারণাটি নিয়ে ব্যাপক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। দার্শনিকেরা বাচ্চাদের পুতুল নিয়ে খেলার মতো শব্দ নিয়ে খেলা করে। আপেক্ষিকতা কেবল নিশ্চিত ও স্থায়ী এমন নির্দিষ্ট কিছু বস্তুগত ও যান্ত্রিক বিষয়কে বোঝায়, যেগুলো নির্দিষ্ট অন্য কিছুর সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞান ও বলবিদ্যার পরিমণ্ডলে আপেক্ষিক। এটা এমন কিছু বোঝায় না যে জীবনের সবকিছুই আপেক্ষিক এবং সারা বিশ্বকে ক্ষতিকরভাবে ওলটপালট করে দেওয়ার অধিকার আমাদের আছে।  
এই কালজয়ী তত্ত্বটি ছিল আইনস্টাইনের মনোজগতের অদেখা চোখের আলোতে প্রাপ্ত। এটি উদ্ভাবনের জন্য তাঁকে ব্যবহার করতে হয়নি আধুনিক কোনো ল্যাবরেটরি কিংবা বিশেষায়িত কোনো যন্ত্রপাতি। এটিই কল্পনাপ্রতিভা ও অনন্য চিন্তাশক্তির উৎকৃষ্ট উদাহরণ   
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারের সময়ও আইনস্টাইন মানুষের মনোজগতের ভিন্নতর দৃষ্টির কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, মনোজগতে এমনকি প্রাত্যহিক জীবনে আমরা যা ভাবি, সেটি ঘটে মন যখন তার বাইরের বাস্তবতাগুলো জানতে পারে। কোনো একটা পদার্থ চাক্ষুষ করার পর যখন দৃষ্টির অন্তরালে চলে যায়, সেটির উপস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে প্রমাণ করা যায় না বটে, কিন্তু অস্তিত্বশীল সেই পদার্থটির উপস্থিতি নির্ভর করে আমাদের অদেখা চোখ দিয়ে দেখার ওপর।
আইনস্টাইনের এই ধারণা থেকে মানুষের সৃষ্টিশীলতার রহস্য উন্মোচিত হয় বাস্তবে দেখার অভিজ্ঞতায় মনের চোখ দিয়ে নতুন মাত্রায় দৃশ্য ও চিত্রকল্প সৃষ্টির মাধ্যমে। যে পূর্ণচন্দ্রের গাঢ় ছায়াকে কারও মনের চোখ দিয়ে চরকা কাটা বুড়ির মতো মনে হয়, সেই চাঁদ ও তার কলঙ্কের মতো চিহ্নকে কারও চোখে পোড়া দাগসহ রুটির মতো দেখায়। সুতরাং একই বাস্তব দৃশ্য একাধিক মনের চোখ দিয়ে উপস্থাপন করা যায় ভিন্ন ভিন্ন রূপে। যে দৃশ্যকে একজন শিল্পী ল্যান্ডস্কেপ দিয়ে উপস্থাপন করেন, সেই দৃশ্যকেই বিমূর্তভাবে আঁকতে পারেন অন্য একজন। চিত্রশিল্পে ল্যান্ডস্কেপ একটি উপস্থাপনের মাধ্যম বটে, তাতে ভিন্নমাত্রা যোগ করতে পারেন শিল্পী তাঁর মনের চোখ দিয়ে।
কিছু প্রতিভাবান মানুষ মনের ভেতর বাড়তি চোখ নিয়ে জন্মায়, শিল্প-সাহিত্যের জগতে এরকম বহু সৃষ্টিশীল মানুষ পাওয়া যাবে, যাঁরা কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই কেবল নিজস্ব প্রতিভা এবং প্রসারিত অন্তর্চক্ষু এবং কল্পনাপ্রতিভা দিয়ে বিশ্ব জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। আমাদের চোখের সামনে রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল–দুই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রবীন্দ্রনাথ জমিদারনন্দন হিসেবে গৃহশিক্ষা লাভ করার সুযোগ পেয়েছিলেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান নজরুলের জীবনে সেই সুযোগ ঘটেনি। সুতরাং উচ্চ বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়ার সুযোগটুকুও পাননি। অথচ আমরা জানি, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন এই দুই কবির রচনা পাঠ করেই আমাদের উচ্চশিক্ষার সনদ পেতে হয়। বিশ্বসাহিত্যে এইচ জি ওয়েলস, চার্লস ডিকেন্স, মার্ক টোয়েন, বার্নার্ড শ কিংবা জ্যাক লন্ডন-এঁদের সবাই স্কুল ছেড়েছিলেন এগারো থেকে চৌদ্দ বছর বয়সে, অথচ কি দোর্দণ্ড প্রতাপে সাহিত্যবিশ্ব শাসন করেছেন তাঁরা, গড়ে গিয়েছেন অসাধারণ সব সাহিত্য কীর্তি। সুতরাং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, কল্পনাপ্রতিভা এবং বিকশিত চিন্তাশক্তিই সৃষ্টি করে মানুষের তৃতীয় নয়ন, যা তার সৃষ্টিশীলতার মূল চাবিকাঠি। সেকারণে রবীন্দ্রনাথ সেই শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, যা দিয়ে মানুষের চিন্তাশক্তিকে বিকশিত করা যায়, সৃষ্টি করা যায় ইতিবাচক কল্পনাশক্তি এবং সৃজনশীল ধারণা। তাই শিক্ষাদানের কৌশল নয় প্রক্রিয়াই তাঁর মূল প্রতিপাদ্য। কারণ প্রচলিত গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় শিক্ষাদান কল্পনাশক্তি তৈরি করে না, বিকাশ ঘটায় না মেধার।
লেখক-কবিদের বেলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যেমন অত্যাবশ্যক নয়, চিত্রশিল্পীদের ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য হলেও এই মাধ্যমে শিল্পকলায় প্রায়োগিক ও কারিগরি জ্ঞানলাভের জন্য কিছু মৌলিক শিক্ষাগ্রহণ করতে হয়। অবশ্য কোনো শিল্পবোদ্ধার মতে আর্ট স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করার পর শিল্পীদের মৌলিকত্ব নষ্ট হয়ে যায়, তখন তাঁরা তাঁদের অন্তর্চক্ষু দিয়ে পরিচালিত হন না, বরং বেশিমাত্রায় মনোযোগী হয়ে পড়েন শিল্পের ফর্ম এবং তাত্ত্বিক উপস্থাপনার প্রতি, যেটিকে স্কুলের জন্য বাড়ির কাজ বলে মনে হয়। অপ্রশিক্ষিত শিল্পীরা কোনো নিয়মের নিগড়ে বাঁধা থাকেন না বলে তাঁদের সৃষ্টিকর্মগুলো হয় অধিকতর মৌলিক এবং নিখুঁত সৃষ্টিশীলতায় অনন্যসাধারণ। এই মৌলিকত্বের মূল নিয়ামক শিল্পীর তৃতীয় নয়ন, যা প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের তত্ত্বে ও কৌশলে আচ্ছন্ন নয়, শিক্ষকের বিতরণ করা জ্ঞানে ঋদ্ধ তবে স্বকীয়তাবিহীন।
মনের চোখ দিয়ে যেমন মানুষ অদেখাকে দেখতে পায়, মানুষের সাধারণ বোধের ভেতর থাকে আরেক বোধ, ‘স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, কোনো এক বোধ,’ চোখের ভেতর যেমন আরেক চোখ, তেমনই কণ্ঠের গভীরে থাকে আরেক স্বর। সেই স্বর আর বোধ একাত্ম হলে একজন হয় শিল্পী, সপ্তসুরের উচ্চমার্গে অবলীলায় অবগাহন করে ঋদ্ধিমান হতে পারেন তাঁরাই। আর যাঁদের এমন হয় না তাঁরা হন কেবলই গায়ক। হৃদয়ের ভেতর জন্ম নেওয়া সেই বোধের সঙ্গে সুরের সঙ্গত ঘটে না বলেই আমাদের সুররাজ্যে রাজত্ব করে অসুর, সুর নিয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে ক্ষান্ত দিয়ে আমাদের গায়কদের আশ্রয় নিতে হয় স্বশিক্ষিত লোকগীতিকবির কাছে।     
প্রচলিত ধারার শিক্ষাব্যবস্থা সনদধারী উচ্চশিক্ষিত মানুষ তৈরি করতে পারে হয়তো, যদি সে শিক্ষার উচ্চব্যয় বহন করার সক্ষমতা রাখে, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষিত সৃষ্টি করতে পারে না। যেখানে কেবলই পাঠ্য বই ও নোট বই গলাধঃকরণ করে পরীক্ষার খাতায় বমন করে দিয়ে আসতে হয়, তার বিনিময়ে পাওয়া যায় একটি সনদ ও অর্থহীন স্বীকৃতি, তাতে জ্ঞান ও কল্পনাশক্তি বাড়ে না, ক্ষয় হয় সৃষ্টিশীলতার ধারালো অস্ত্র। অথচ অনুপ্রেরণার মধ্যে থাকে ইতিবাচক মনোভাবের চালিকাশক্তি, সেটি থেকে তৈরি হয় সদর্থক কল্পনাপ্রতিভার। মানুষের মনের মধ্যে উর্বরতা নির্বিশেষে যে কল্পনাশক্তি থাকে কিংবা তার উন্মেষ ঘটানো যায়, সেটি দিয়ে সৃষ্টি হয় নতুন ধারণা ও মতবাদ, প্রতিমূর্তি ও ভাবমূর্তি, সেটিকে আরও সুপরিসর করতে পারে চিন্তাশক্তিপ্ররোচক শিক্ষা, যা মনের ভেতরের জানালাগুলো খুলে দিয়ে উন্মোচন করতে পারে অন্তরের অক্ষিপুঞ্জ। সেজন্য যে শিক্ষাব্যবস্থার কথা রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে মুক্তচিন্তার মানুষেরা স্বপ্ন দেখেছেন, তার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ কিংবা পরিচালনা করার মতো যোগ্য ব্যক্তি তৈরি করতে পারেনি প্রচলিত এই শিক্ষা ব্যবস্থা। এটি যেন এক দুষ্টচক্রের পাকে পড়ে গেছে। এমন দুঃসময় হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন বলে এক ভবিষ্যতদ্রষ্টা কবি লিখেছিলেন:
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com