
মতামত
উচ্চশিক্ষা : বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২৩ । ১৯:৩৫ | আপডেট: ১১ মার্চ ২৩ । ২১:৫০
বিমল সরকার

বহুল প্রচলিত একটি প্রবচন: ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।’ আরও একটি কথা: ‘বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট।’ আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার বাস্তব পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে ভাবলে এবং বলতে চাইলে এমনই কিছু ভাবতে ও বলতে হয়। যদিও বিষয়টি আমাদের জন্য কোনো দিক থেকেই সুখকর নয়।
কলেজে আমাদের শিক্ষক মিলনায়তনে অধ্যক্ষ স্বাক্ষরিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নির্দেশনা বেশ কিছুদিন ধরে পড়ে আছে। শিক্ষকদের স্বাক্ষর করতে বলা হলেও, এতদিন কেউ এতে স্বাক্ষর করেননি। যথারীতি বিষয়টি আমারও দৃষ্টিতে পড়েছে।
একদিন কী উপলক্ষে শিক্ষক পরিষদের একটি সভা ডাকা হয়েছে। উপস্থিত শিক্ষকরা মিলনায়তনে অপেক্ষমাণ। সভা শুরুর আগে অধ্যক্ষ সবার উদ্দেশে বলে চলেন– ‘একটি নোটিশ দেওয়া হলো অথচ আপনারা একজন শিক্ষকও এতে স্বাক্ষর করেননি।’ আমি অধ্যক্ষের পাশের আসনটিতে বসা। তিনি খুব আক্ষেপের সঙ্গে বিশেষ করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে চলেন– ‘দেখুন ১৫-২০ দিন হয়ে গেল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নির্দেশনা জানিয়ে নোটিশটি পরিবেশন করা হলো অথচ একজন শিক্ষকও এ পর্যন্ত সাড়া দেননি তাতে।’ অধ্যক্ষের মুখ থেকে এসব অনুযোগ শুনে সাধারণ শিক্ষকদের মধ্য থেকে কেউ কিছু বলার আগে আমিই নীরবতা ভঙ্গ করি। অবশ্য এর একটি কারণ আছে। শিক্ষকদের মধ্যে আমি জ্যেষ্ঠতম; তাছাড়া কমবেশি সবারই জানা যে, অধ্যক্ষের সঙ্গে ব্যক্তিগত খানিকটা সম্পর্কও রয়েছে আমার।
ফাঁকে দুটি কথা বলে নিই। কী আছে ১৫-২০ পৃষ্ঠাজুড়ে লেখা বড় কলেবরের ওই নোটিশটিতে? দেখে আমারই পিলে চমকে যাওয়ার মতো অবস্থা। প্রথমত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ডিগ্রি (পাস ও অনার্স) স্তরে ১০০ নম্বরের ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ নামে একটি কোর্সের সংযোজন করা হয়। দ্বিতীয়ত, পাস কোর্সে ১০০ নম্বর করে বাংলা (আবশ্যিক) ও ইংরেজি (আবশ্যিক) ছাড়া ঐচ্ছিক তিনটি বিষয় চার পত্রের স্থলে এখন থেকে ছয় পত্রবিশিষ্ট হবে। এভাবে পাস কোর্সের শিক্ষার্থীদের পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত তিন বছরে মোট ২১০০ নম্বরের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে (যা ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছিল ১৪০০ নম্বরের)। নোটিশে উল্লেখ রয়েছে অনার্সে ‘মেজর ও নন-মেজর’ বিষয়, প্রশ্নপত্রের ধরন ও নম্বর বণ্টন এবং ‘সিজিপিএ’র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। আরও আছে ক্লাসের হিসাব-নিকাশ (ক্রেডিট)সহ নানা খুঁটিনাটি বিষয়; সর্বোপরি তিন বা চার বছরে ইনকোর্সসহ অনুষ্ঠেয় বিভিন্ন পরীক্ষাসংক্রান্ত নির্দেশনা।
বাস্তবে আমাদের কলেজ শিক্ষকদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা। ইত্যবসরে নোটিশটির যতটুকু পড়েছি তাতে আমার একেবারে পিলে চমকে যাওয়ার উপক্রম। বিশেষ করে উল্লিখিত কিছু কিছু বিষয়, শব্দ বা টার্ম আমি এর আগে কখনও শুনিনি। আমার বিশ্বাস, অধ্যক্ষ মহোদয়ের অবস্থাও তথৈবচ। কিন্তু অন্যরা যেভাবে বলতে পারেন, বলতে পেরেছেন তিনি তা পারেন না, বলতে পারেননি।
শিক্ষক পরিষদের সভা চলাকালে এমন একটি বিষয়ে সেদিন আমি কী বলেছি বা কতটুকু বলতে পেরেছিলাম, তা এখানে আর ব্যক্ত করতে চাই না। তবে অভাজনের কথাগুলো বেশ মনোযোগ সহকারে সবাই শুনেছেন, লক্ষ্য করলাম। যাক, প্রসঙ্গটা আজ আমি এখানেই রাখি।
প্রিয় পাঠক, আমার আর্তি : উচ্চশিক্ষার হালহকিকত নিয়ে আপনারা নতুন করে একটু ভাবুন। উপযুক্ত মান নেই, চারদিকে শুধু প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি। ক্লাসের নামে খবর নেই; শুধু ভর্তি, ফরম পূরণ আর পরীক্ষা। সারা বছর বা সেশনের পরিক্রমা; শিক্ষার্থী শিক্ষককে চেনে না আর শিক্ষক শিক্ষার্থীকে। প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে সবখানে কী এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি! বাস্তবে কী লাভ হলো ডিগ্রি পাস কোর্সে এবং অনার্সে পত্র ও নম্বর বাড়িয়ে? পড়াশোনায় মনোযোগী না হয়ে, ক্লাস না করেও পরীক্ষায় অংশ নেওয়া যায় এবং ভালো ফলাফলও করা যায়! কী এক অদ্ভুত বন্দোবস্ত! অতএব ১৯৯২ সালের ১০০০ নম্বরের স্থলে পাস কোর্সে ২১০০ নম্বর আর অনার্সে ১৫০০ নম্বরের স্থলে ৩২০০ নম্বরে উন্নীত করা হলেও, এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কিংবা ভাবনা-দুর্ভাবনা নেই! তবে এমন শিক্ষার সনদপত্র নিয়ে ঘরে ঘরে রয়েছে হাহাকার।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com