
রকেট তৈরির কারিগর
প্রকাশ: ১১ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১১ মার্চ ২৩ । ১১:৩৩ | প্রিন্ট সংস্করণ
মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

আজাদুল হক, নাসায় কাজ করেছেন পাঁচ বছর। বাংলাদেশে থ্রিডি অ্যানিমেশন প্রযুক্তির পাশাপাশি বিল বোর্ড, পোস্টার প্রিন্ট প্রযুক্তি তিনি প্রথম নিয়ে আসেন। প্রচণ্ড উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী এই মানুষটি কিছুদিন আগে মডেল রকেট তৈরির ধারণা দিয়ে রকেট্রি ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে পেয়েছেন এক কোটি টাকা।
আজাদুল ছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। বিশ্ববিদ্যালয়টির কম্পিউটার ল্যাব, নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। বর্তমানে তিনি ম্যাক্স গ্রুপের পাওয়ার ডিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। কাজ করছেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। কাজের ফাঁকে মডেল রকেট তৈরি এবং উৎক্ষেপণের কাজ করছেন। এর আগে বাংলাদেশের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ইতিহাসে একসঙ্গে ৫০ হাজারেরও বেশি কিউবিট ফুট সেলফ কম্প্যাক্টিং কংক্রিট কোনো মনোলিথিক স্লাবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢালাই করার রেকর্ড হয়েছে তাঁর নেতৃত্বে।
আজাদুল হকের পৈতৃক বাড়ি বরিশালে। বাবা ফজলুল হক। ছয় বোনের একমাত্র ছোট ভাই তিনি। আজাদুল হক গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নেন সেখান থেকে। ১৯৯২ সালে বিয়ে করেন। দুই ছেলে তাঁর। বড় ছেলে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার, কাজ করছেন বহুজাতিক কোম্পানি অ্যামাজনে। ছোট ছেলের মাস চারেকের মধ্যে গ্র্যাজুয়েশন শেষ হবে। পরিবারের তিন সদস্যই যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
প্রায় পাঁচ বছর আজাদুল নাসায় কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘১৯৯৮ সালের প্রথম দিকে আমি আবার চলে গেলাম আমেরিকায়। ফিরে গেলাম নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে লকহিড মার্টিনের কন্ট্রাক্টে। কাজ করেছি লাইফ সায়েন্স ডাটা সিস্টেমে, টেলিসায়েন্স সাপোর্ট সেন্টারে (টিএসসি)।’ তিনি আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তর এনার্জি কোম্পানি কিন্ডার মর্গানে ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। আজাদুল বলেন, ‘যখন শুরু করেছিলাম, তখন এ কোম্পানি ছিল ২০ বিলিয়ন ডলারের। যখন চলে আসি, তখন সেটা ছিল ১৩৫ বিলিয়ন ডলারের।’ এ ছাড়া ডিস্কটেক নামে এক কোম্পানিতে প্রোগ্রাম ম্যানেজার, হিউস্টনের কম্পিউটার এক্সপোতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
২০১৯ সালে ম্যাক্স গ্রুপের সহায়তায় কনভেনশন অব এনআরবি ইঞ্জিনিয়ার্সের আয়োজন করা হয়। বিশ্বের ৩০০ ইনঞ্জিনিয়ার এই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। এই কনভেনশনের মূল ধারণা ছিল ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরের। তিনি পুরো কনভেনশনের দায়িত্ব দেন কনভেনর হিসেবে আজাদুল হককে।
এখন আজাদুল যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করছেন, ছোটবেলায় তিনি তা-ই স্বপ্ন দেখতেন। তিনি বলেন, ‘দেশে রকেট্রি ইকোসিস্টেম তৈরি করতে হবে। মডেল রকেট তৈরি করা তারই একটি ধাপ। দেশে রকেট তৈরি, উৎক্ষেপণ ইত্যাদির কোনো নীতিমালা নেই। এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছি। জৌলুসপূর্ণ জীবন নয়, শুধু দেশের জন্য এখানে আছি। বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে চাই।’
হানিফ সংকেতের সঙ্গে প্রথম সেল অ্যানিমেশন করেন আজাদুল। যেটি বিটিভিতে আনন্দ মেলা অনুষ্ঠানে দেখানো হয়। এই থ্রিডি অ্যানিমেশন একসময় পর্দা কাঁপিয়েছে। বাংলাদেশে থ্রিডি অ্যানিমেশনের প্রযুক্তির পাশাপাশি বিলবোর্ড, পোস্টার প্রিন্ট প্রযুক্তি তিনি প্রথম নিয়ে আসেন। তিনি তখন স্টার অ্যাডভার্টাইজার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
সপ্তাহে সাত দিনই তাঁকে কাজ করতে হয়। দিনে প্রায় ১৮ ঘণ্টা কর্মব্যস্ত থাকতে হয়। এরই মধ্যে তিনি সময় বের করে রকেট নিয়ে কাজ করেন। এটা তাঁর আবেগ। ছোটবেলা থেকে স্পেস নিয়ে কাজের প্রতি আগ্রহ তো ছিলই। আজাদুল বলেন, ‘২০২৪ সালে নাসা থেকে একজন অ্যাস্ট্রোনেট নিয়ে আসব, যিনি স্পেস থেকে ঘুরে এসেছেন। শিক্ষার্থীরা তাঁর সঙ্গে কথা বলবে। স্পেসের অভিজ্ঞতা জানতে পারবে। আমি শিক্ষার্থীদের দিয়ে মডেল রকেট তৈরি করব। তাঁদের যন্ত্রাংশ কিনে দেব। লালমনিরহাটে প্রায় ৭০০ একর জমির ওপর বঙ্গবন্ধু এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। আমি সেখানকার স্টুডেন্টদের সাহায্য করব। রকেট্রি নিয়ে উদ্ভাবনের জন্য পুরস্কারের টাকা আমার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নয়। পুরস্কারের সব অর্থ দিয়ে মডেল রকেটের গবেষণা, উন্নয়নের পাশাপাশি যন্ত্রাংশ কেনা হবে।’
মডেল রকেট উৎক্ষেপণের জন্য প্রয়োজন ফ্লাইট কম্পিউটার। এটা কিনে আনলে হবে না। আজাদুল চান, বাংলাদেশিরা এটি ডিজাইন করবে। ফ্লাইট কম্পিউটারের পেছনে তাঁর অনেক টাকা চলে যাবে। ইতোমধ্যে তিনি ল্যাবে ছোট ছোট টেস্ট রকেট তৈরি করেছেন নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। আজাদুলের ইচ্ছা, রকেট উৎক্ষেপণ প্যাড তৈরি করবেন। অন্যরা এটি ব্যবহার করতে পারবে। এ জন্য রকেট তৈরি করে সাবমিট করার পর কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলেই তবে ব্যবহার করা যাবে।
আজাদুলের মতে, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে রকেট তৈরি, উৎক্ষেপণের সাহস দেখাতেই পারে। এই অধিকার, সাহস বাঙালির আছে। আমাদের চিন্তার স্বাধীনতা আছে। দেশে বসেই কাজ করা সম্ভব স্পেস ইকোনমি নিয়ে। সেই সাহসটাই তরুণদের মধ্যে গেঁথে দিচ্ছেন আজাদুল। তিনি বলেন, ‘ইকো সিস্টেম তৈরি করার সায়েন্টিফিক গাটস আমাদের আছে। এখনকার বাংলাদেশ নয়। ৫০ বা ১০০ বছর পরের বাংলাদেশের কথা ভাবতে হবে। পরিকল্পনা হোক ১০০ বছর পরের বাংলাদেশের। এই ভাবনা-চিন্তার স্বাধীনতা, সাহস আমাদের আছে। এটাই নতুনদের বোঝাতে হবে। স্পেস ইকোনমিতে বাংলাদেশ গোছানোভাবে কিছু কাজ করতে যাচ্ছে। সব ঠিকঠাকমতো এগোলে বাংলাদেশ অগ্রসর হতে পারবে। আর তা হবে বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।’
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com