কূটনীতি

প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প হিমাগারে গেছে?

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৫ মার্চ ২৩ । ০০:৫৩ | প্রিন্ট সংস্করণ

মইনুল ইসলাম

চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে ভারত আবার আপত্তি জানিয়েছে? ২০২৩ সালের শুষ্ক মৌসুমেও প্রকল্প প্রস্তাবটি একনেকে উপস্থাপিত না হওয়ার আর কী কারণ থাকতে পারে? এর মানে, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে আর কোনো পদক্ষেপ নেবে না।

মনে আছে, প্রায় পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের সময় এ ধরনের একটি প্রকল্প প্রণয়ন বিষয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল। ‘চীনের দুঃখ’ হিসেবে একদা বিশ্বে বহুল পরিচিত হোয়াংহো নদী বা ইয়েলো রিভারকে চীন যেভাবে চীনের আশীর্বাদে পরিণত করেছে; একই কায়দায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের জন্য প্রতি বছর সর্বনাশ ডেকে আনা তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাকেও একটি বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা যায় কিনা? শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ চীনা অর্থায়নে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পর প্রকল্প প্রস্তাবটি চীনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। একই সঙ্গে চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানের প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশও ওই প্রস্তাব গ্রহণ করে বলে বিভিন্ন মহলে আলোচনা রয়েছে।

প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন চালিয়ে নদীর মাঝখানের গভীরতাকে ১০ মিটারে বাড়িয়ে ফেলা হবে এবং নদীর প্রশস্ততাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা হবে। একই সঙ্গে রিভার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। উপযুক্ত স্থানে বেশ কয়েকটি ব্যারাজ-কাম রোড নির্মাণ করে নদীর দুই তীরের যোগাযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণ জলাধার সৃষ্টি করে সেচ খাল খননের মাধ্যমে নদীর উভয় তীরে চাষযোগ্য জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। উপরন্তু নদীর উভয় তীরের সড়কের পাশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ণ সুবিধাদি গড়ে তোলা হবে।

বিভিন্ন সূত্রে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বর্ণনা জেনে আমার মনে হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সত্যি সত্যিই তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনজীবনে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হবে। আমি প্রকল্প প্রস্তাবের অনুমোদন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সে জন্যই অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। কিন্তু খবর নিয়ে জানা গিয়েছিল, এ প্রকল্পে বাগড়া দিচ্ছে ভারত। ভারত নাকি এ প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণকে তাদের দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক ঘোষণা করে প্রকল্পটি বাতিলের ‘অনুরোধ’ জানায়। কারণ তাদের শিলিগুড়ি করিডোরের ‘চিকেন নেক’ থেকে এত কাছাকাছি তিস্তা প্রকল্পে কয়েকশ বা হাজারের বেশি চীনা নাগরিকের অবস্থান তারা মেনে নিতে পারে না।

বাস্তবে যে এলাকা দিয়ে তিস্তা নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে ‘শিলিগুড়ি করিডোর’ অনেক দূরে। তিস্তা নদীর দক্ষিণ-পূর্বদিকের ভাটিতে যতই প্রকল্পের কাজ এগোবে, ততই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে প্রকল্প এলাকার দূরত্ব বাড়তে থাকবে। একবার শোনা গিয়েছিল, ভারতের নিরাপত্তা সম্পর্কিত উদ্বেগকে আমলে নিয়ে সীমান্ত-নিকটবর্তী ১৬ কিলোমিটার নদীর খনন বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে করবে। এখন সবই যে হিমাগারে চলে গেছে, তা স্পষ্ট।


ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র– সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার কোনো অধিকার দেশটির থাকতে পারে না। আমরা দেখছি, প্রবল উত্তেজনাকর এমনকি প্রাণঘাতী সীমান্ত বিরোধ সত্ত্বেও চীনের সঙ্গে ২০২২ সালে ১৩৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক বাণিজ্য চালিয়েছে ভারত। তাহলে বাংলাদেশ নিজের অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নে চীন থেকে সহজ শর্তে ঋণ বা কারিগরি সহায়তা নিতে পারবে না কেন? শুধু দিল্লি- বেইজিং বিরোধের জের ঢাকা বহন করবে কেন? অথচ প্রায় সব চীনা প্রকল্পেই ভারত বারবার নানা অজুহাতে বাগড়া দিয়ে চলেছে।

তিস্তা ঐতিহাসিকভাবেই অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং খামখেয়ালি আচরণের নদী। যার বন্যার কবলে পড়ে প্রায় প্রতি বছর বর্ষায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল একাধিকবার বিধ্বস্ত হয়ে চলেছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে তুলনামূলক খরাগ্রস্ত এই এলাকার মানুষ তিস্তা নদীর পানিস্বল্পতা হেতু সেচ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। তিস্তা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় ভারত একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়ার পর তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশ বছরের বেশির ভাগ সময় প্রায় পানিশূন্য থাকছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেও তিস্তার পানিস্বল্পতার ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। বলা হয়, এলাকার জনগণের জীবন-জীবিকার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ তিস্তা নদী।

বাংলাদেশ বন্ধুরাষ্ট্র হলেও একটি আন্তর্জাতিক নদীর উজানে এমন একতরফা বাঁধ নির্মাণের আগে ভারত একবারও বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং দীর্ঘ তিন দশকের কূটনৈতিক আলোচনার পথ ধরে যখন ২০১১ সালে দুই দেশ তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অন্যায় আবদারের কাছে নতি স্বীকার করে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং চুক্তি স্বাক্ষর থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। অথচ দুটো সার্বভৌম দেশের সম্পর্ক একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিলতার কাছে জিম্মি হতে পারে না। কিন্তু ভারত এই অজুহাতে এক যুগ ধরে এ ইস্যুতে বাংলাদেশকে বঞ্চিত রেখেছে। এমনকি প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প ভণ্ডুল করার জন্য তারা মাঝেমধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের মুলাও ঝোলাচ্ছে!

তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হোক– আমরাও চাই। কিন্তু তিস্তা চুক্তি আর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প মোটেও সাংঘর্ষিক নয়। ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি হোক বা না হোক; চীনা অর্থায়নে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প ওই অঞ্চলের জনগণের জীবন-জীবিকায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। পানি বণ্টন চুক্তি হলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহ খানিকটা হয়তো বাড়বে, কিন্তু বর্ষায় গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেওয়ায় এ অঞ্চলের জনগণ যে একাধিকবার বন্যায় ডুবছে, তার তো কোনো সমাধান হবে না! প্রস্তাবিত প্রকল্পের জলাধারগুলোর সংরক্ষিত পানি পরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হলে এই সমস্যার টেকসই সমাধান মিলবে।

প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পটি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক নানা সূত্র উদ্ধৃত করে অনেকে বলছিলেন, দিল্লির আপত্তি সত্ত্বেও ২০২৩ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হতে পারে। এখন মনে হচ্ছে, বিষয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে গেল। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা ওঠার পর তিস্তা অববাহিকার জনসাধারণের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনাও দেখা দিয়েছিল। প্রকল্পটির আশু বাস্তবায়নে গত কয়েক বছরে বেশকিছু মানববন্ধন ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, তাদের অপেক্ষা সহজে ফুরাবে না!

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com