সাত হলে ২২ ছাত্রলীগ নেতার শাসন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৫ মার্চ ২৩ । ০২:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সারোয়ার সুমন ও মারজান আক্তার, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সাতটি ছাত্রাবাসে থাকা ২ হাজার ৭২৫টি সিটের প্রতিটিরই নিয়ন্ত্রণ এখন ছাত্রলীগের হাতে। তাদের কথায় (আইনে) চলে ছাত্রাবাস। ছয় বছর ধরে হলগুলোর কোনোটিতেই বৈধভাবে আসন বরাদ্দ পাননি সাধারণ কোনো শিক্ষার্থী। বরাদ্দ নিয়ে আগে থেকে যেসব সাধারণ শিক্ষার্থী ছাত্রাবাসে ছিলেন, তাঁদের বের করে দিয়ে হলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতারা। তাঁদের অনুসারীদের কে কোথায় থাকবেন, কীভাবে থাকবেন– এসব নির্ধারণ করে দেন ‘বড় নেতা’। সমকালের অনুসন্ধানে এমন ২২ বড় নেতার নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে বহিষ্কৃত, খুনের মামলার আসামি ও ছাত্রত্ব নেই– এমন নেতাও রয়েছেন।

বেশ কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়েও হলে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আসন বরাদ্দ দিতে সর্বশেষ ২২ সেপ্টেম্বর তারা উদ্যোগ নেয়। তবে এবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কঠোর হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। হলে অবস্থান করা বহিষ্কৃত ও অছাত্রদের আজ বুধবারের মধ্যে ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে যাওয়ার আলটিমেটামও দিয়েছে প্রশাসন। কিন্তু প্রশাসনের এ ঘোষণাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না দখলদাররা।

নবনির্মিত তিনটি হলসহ চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যালয়ে আবাসিক হল আছে মোট ১৪টি। নতুন দুটি ছাত্র ও একটি ছাত্রী হলে এখনও কোনো শিক্ষার্থীকে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। যে ১১টি হলে শিক্ষার্থী থাকার সুযোগ আছে, সেখানেও আছে সংকট। এসব হলে ২০১৭ সালের জুন মাসে সর্বশেষ আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়। নানা সমালোচনার মুখে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর আসন বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি দিলেও পাঁচ মাস পরও শুরু হয়নি আসন বণ্টন। অথচ প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ৪ হাজার ৯২৬ শিক্ষার্থী নতুন করে যুক্ত হন। প্রশাসন হলে আসন বরাদ্দ না দেওয়ায় হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে এখন ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে।

ছাত্রলীগের ১২ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ৭ আবাসিক হল: চবিতে ছাত্রদের হল রয়েছে সাতটি। সেগুলো হলো– শাহ আমানত, আলাওল, শাহজালাল, শহীদ আবদুর রব, মাস্টারদা সূর্য সেন, এএফ রহমান ও সোহরাওয়ার্দী হল। এই হলগুলোতে ১ হাজার ৮০টি কক্ষে আসন আছে ২ হাজার ৭২৫টি। ছাত্রলীগের তৈরি নিয়মেই চলছে এই সাতটি হল।

চবিতে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে দুটি পক্ষ রয়েছে; একটি সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী, আরেকটি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। এ দুটি পক্ষ আবার ১২টি গ্রুপে বিভক্ত। গ্রুপগুলো মূলত শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক হলেও পুরো ক্যাম্পাসে দাপিয়ে বেড়ায়। সেগুলো হলো– সিএফসি, বিজয়, সিপটি নাইন, ভার্সিটি এক্সপ্রেস, বাংলার মুখ, কনকর্ড, একাকার, রেড সিগন্যাল, এপিটাফ, উল্কা, সংগ্রাম ও স্বাধীনতা। ২০১৬ সালে দফায় দফায় সংঘাতের কারণে বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। তবু বগির গ্রুপগুলোর নামে হল দখল করে রেখেছেন ছাত্রলীগ নেতারা। একেকটি হলের দখল এখন ছাত্রলীগের একেকটি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। এই গ্রুপগুলোর প্রধান যে নেতা, তাঁদের ইচ্ছাতেই হলে উঠছেন শিক্ষার্থীরা।

চবি ছাত্রলীগ সভাপতি ও সিএফসি গ্রুপের নেতা রেজাউল হক রুবেল। তাঁর দখলেই আছে শাহ আমানত হলের অধিকাংশ কক্ষ। সিএফসি গ্রুপের অন্য নেতারা হলেন– নাছির উদ্দীন সুমন, সাদাফ কবির ও খালেদ মাসুদ। সাধারণ সম্পাদক ও সিক্সটি নাইন গ্রুপের নেতা ইকবাল হোসেন টিপু দখল করে আছেন শাহজালাল হল। আধিপত্য বিস্তারে সহযোগী নেতারা হলেন– রাজু মুন্সি, শামসুজ্জামান সম্রাট ও সাইদুল ইসলাম। আবদুর রব হলের দখলে আছে ভার্সিটি এক্সপ্রেস ও সিএফসি গ্রুপ। ভার্সিটি এক্সপ্রেসের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে আরও কয়েকটি হলে অবস্থান আছে এই গ্রুপের। প্রদীপের পর এই গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন মুজিবুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল ও এএফ রহমান হলের অধিকাংশ কক্ষের দখলে আছে বিজয় গ্রুপ। এই গ্রুপের নেতা চবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াছ। গত বছরের ৩১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণার পর বিজয় গ্রুপটির দুই ভাগ প্রকাশ্যে আসে। ইলিয়াছবিরোধী আরেক গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন নজরুল ইসলাম ও দেলোয়ার হোসেন। এই নেতারা আবার আধিপত্য বিস্তার করছেন সোহরাওয়ার্দী হলে।

এ ছাড়া অন্য হলগুলো এভাবেই দখল করে আছেন বাকি গ্রুপের নেতারা। তাঁরা হলেন– রেড সিগন্যাল গ্রুপের নেতা রাকিবুল হাসান দিনার, বাংলার মুখ গ্রুপের নেতা আবু বকর তোহা, কনকর্ড গ্রুপের নেতা আবরার শাহরিয়ার, একাকার গ্রুপের নেতা মঈনুল ইসলাম, এপিটাফ গ্রুপের নেতা ও সহসভাপতি সাজ্জাদ হোসেন পিনন এবং উল্কা গ্রুপের নেতা ফাহিম শান্ত। নারী ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ হলো সংগ্রাম ও স্বাধীনতা। সংগ্রামের নেতৃত্বে আছেন শামীমা সীমা এবং স্বাধীনতা গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন রুম্পা সরকার।

হল দখলে থাকা নেতাদের ছাত্রত্ব নেই: বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ছয় বছরে স্নাতক এবং দুই বছরে স্নাতকোত্তর কোর্স শেষ করতে হবে। এর পর তাঁদের ছাত্রত্ব বাতিল হবে এবং হলেও তাঁরা অবস্থান করতে পারবেন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতারা পড়ছেন ১০ থেকে ১৩ বছর ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেল পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হন ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে। ১৭ বছর ধরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছেন। তাঁর দাবি, তিনি জাপানিজ ভাষা কোর্সে ভর্তি থাকার সুবাদে তাঁর ছাত্রত্ব এখনও আছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুও বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন ১৩ বছর ধরে। তিনি ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে মার্কেটিং বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর দাবি, ইন্টার্ন পেপার জমা না দেওয়ায় তাঁর স্নাতকোত্তর এখনও শেষ হয়নি। স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি সাত বছর আগে। শুধু এই দুই মূল নেতা নন, অন্য নেতারাও ১০ থেকে ১২ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। হলের কক্ষও দখল করে রেখেছেন তাঁরা। সহসভাপতি নাছির উদ্দিন, রকিবুল হাসান, প্রদীপ চক্রবর্তী ও যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াছ ১৩ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। এ ছাড়া ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদে থাকা সাইদুল ইসলাম, রাজু মুন্সী ও শামসুজ্জামান সম্রাট, মঈনুল ইসলাম এবং আবু বকর আছেন ১২ বছর ধরে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সহসভাপতি ড. মুহাম্মদ আলা উদ্দীন বলেন, নিয়ম অনুযায়ী মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর হলে থাকার নিয়ম নেই। অনেকে রাজনৈতিক কারণে নির্ধারিত সময়ের পরও বিশেষ সুযোগ নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। এই বিশেষ সুযোগটাও নির্ধারিত সময়ের পর অবৈধ। সে ক্ষেত্রে হলে থাকাটাও প্রশ্নবিদ্ধ।

এ ছাড়া খুনের মামলার আসামিরাও হল দখল করে আছেন। তাঁদের মধ্যে সিআরবি জোড়া খুনের মামলার আসামি রাজু মুন্সী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাপস সরকার হত্যা মামলার আসামি প্রদীপ চক্রবর্তী। সংঘর্ষ, ছাত্রী হেনস্তাসহ নানা ঘটনায় বহিষ্কৃত ১৮ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীও আছেন বিভিন্ন হলে। তাঁরা হলেন– জুনায়েদ আহমেদ, জান্নাতুল ইসলাম রুবেল, মো. ইমন আহম্মেদ, রাকিব হাসান রাজু, হাসান মাহমুদ, অনিক দাশ, তনয় কান্তি সরকার, সিফাতুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম, ইকরামুল হক, নয়ন দেবনাথ, আরশিল আজীম, শোয়েব মোহাম্মদ, নাহিদুল ইসলাম, আমিরুল হক চৌধুরী, মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন, মাহমুদুল ইলিয়াস ও তাসফিয়া জান্নাত।

এ ছাড়া একটি করে কক্ষ দখল করে আছেন পাঁচ নেতা।  রেজাউল হক রুবেল শাহ আমানত হলের ৩১১ নম্বর কক্ষ, ইকবাল হোসেন টিপু আছেন শাহজালাল হলের ৩০৬ নম্বর কক্ষে। এ ছাড়াও একক কক্ষ নিয়ে থাকেন নাসির উদ্দিন, শামসুজ্জামান চৌধুরী ও রাজু মুন্সী।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার আকবর হোসেন বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি কোনো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতে পারবেন না। মাস্টার্সের ইন্টার্ন পেপারের নিয়ম বিভাগ অনুযায়ী আলাদা হয়ে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সহসভাপতি ড. মুহাম্মদ আলা উদ্দীন বলেন, মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর হলে থাকার নিয়ম নেই। অনেকে রাজনৈতিক কারণে নির্ধারিত সময়ের পরও বিশেষ সুযোগ নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে থাকে। এই বিশেষ সুযোগটাও নির্ধারিত সময়ের পর অবৈধ।

অভিযুক্তদের ভাষ্য: ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাধারণ নিয়মেই আসন পেয়েছিলাম। এখন যদি নতুন বরাদ্দের প্রক্রিয়ায় আমি আসন না পাই, তাহলে হল ছেড়ে  দেব। নেতাদের আশ্রয়েই বহিষ্কৃত হলে থাকার অভিযোগ প্রসঙ্গে সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, ছাত্রলীগ থেকে এ ধরনের কোনো আশ্রয়ের সুযোগ নেই। এখানে বহিষ্কারের কাজ করে থাকে প্রশাসন।

অভিযুক্ত সহসভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয় বলেন, বর্তমানে যাঁরা হলে আছেন, তাঁরাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কিন্তু আসন বরাদ্দ নেই বলে সবাই অবৈধভাবে থাকছেন। নতুন বরাদ্দ দেওয়া হলে ছাত্রলীগ থেকে কোনো প্রভাব আসবে না। তবে জামায়াত-শিবিরের অনুসারীদের আমরা হলে উঠতে বাধা প্রয়োগ করব।

বিজয় গ্রুপের নেতা মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, বহিষ্কৃতদের হলে থাকতে নেতারা কোনো সহযোগিতা করেন না। যাঁরা হলে আছেন, তাঁদের দায় প্রশাসনের।

হল প্রভোস্টরা যা বলেন: এএফ রহমান হলেই অবস্থান করছেন ৫ বহিষ্কৃত ছাত্র। এ বিষয়ে এ হলের প্রভোস্ট ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী বলেন, তাঁদের বহিষ্কারের চিঠি শিগগিরই হলে জানানো হবে। সোহরাওয়ার্দী হলের প্রভোস্ট ড. শিপক কৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, খুব দ্রুতই হলে আসন বণ্টন প্রক্রিয়া শুরু হবে। আবাসিক হলগুলোতে যারা অবৈধভাবে থাকছে, তাদের বের করার কাজ রমজানের বন্ধে শুরু হবে। এর পরই নতুন আসন বরাদ্দ।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: চবি উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার সমকালকে বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের যে কোনো মূল্যে আসন বরাদ্দের জন্য আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। প্রক্টর ড. নূরুল আজিম সিকদার বলেন, অবৈধ ছাত্রদের হল থেকে বের করতে যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেটি প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com