
চট্টগ্রামে মাদ্রাসার শৌচাগারে শিশু শিক্ষার্থীর লাশ
অসময়ে নিভে গেল শাইয়ানের আলো
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৫ মার্চ ২৩ । ০২:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রাম নগরের ওয়াসা মোড় পেরিয়ে পল্টন রোড। বাঘমনিরাম এলাকার কাদের ভবনের পঞ্চমতলার মাঝ বরাবর ফ্ল্যাটটি সুনসান। কোথাও যেন কেউ নেই। খোলা দরজা। ঘরজুড়ে নেমেছে আঁধার। সাঁঝবেলায়ও জ্বলেনি বাতি। উঁকি দিতেই দেখা গেল কারও ছায়া। ঘরের ছোট্ট খাটে মাথা ঝুঁকে আছেন ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। পাশে দুই নারী। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়েই জ্বালালেন ঘরের বাতি। সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে ডেকে নিলেন। ঘরে ঢুকতেই চোখ আটকে গেল পড়ার টেবিলে। থরে থরে সাজানো ছোট-বড় বেশ কিছু ক্রেস্ট সেখানে। লোকটি বললেন, ‘দেখেন, এখানে কত ক্রেস্ট। সব আমার নাতি সাবিব শাইয়ানের। চিত্রাঙ্কন, ছড়া ও কবিতা পাঠের জন্য এসব পুরস্কার পেয়েছে সে। অনেক মেধাবী আর দুরন্ত ছিল শাইয়ান। তবে নিষ্পাপ শিশুটিকে মেরে ফেলা হয়েছে। ১০ বছরের শাইয়ানের এত কী কষ্ট ছিল, সে আত্মহত্যা করবে?’ এভাবে বলতে গিয়ে শাইয়ানের নানা খন্দকার মো. হেলালের চোখের আঙিনায় তখন বেদনার জলধারা।
নগরের চকবাজারের মেহেদীবাগ এলাকার দারুস সুফফাহ তাহফিজুল কোরআন মাদ্রাসার শৌচাগার থেকে সোমবার রাতে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সাবিব শাইয়ানের লাশ মেলে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে দাবি করলেও শাইয়ানের পরিবার বলছে, এটি হত্যাকাণ্ড। কোনো কারণে মাদ্রাসার কেউ তাকে হত্যা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রেখেছে। পুলিশ লাশ উদ্ধার করার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) মর্গে শাইয়ানের ময়নাতদন্ত করা হয়। পল্টন রোড এলাকায় বিকেলে জানাজা শেষে তাকে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের নাথেরপেটুয়া গ্রামে নেওয়া হয়।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে শাইয়ানের বাসায় গেলে সেখান থেকে মোবাইল ফোনে কথা হয় তার বাবা মশিউর রহমানের সঙ্গে। তখন তিনি গ্রামের পথে অ্যাম্বুলেন্সে ছিলেন। ছেলের মৃত্যুর কথা জানতে চাইতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আমার শাইয়ান এখন আমার সঙ্গে। বাবা হয়ে ছেলের লাশ মাটি দিতে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছি।’ তাঁর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন ফোনে চাপা কান্নার আওয়াজ কানে লাগছিল। হতভাগ্য এই বাবা বলেন, ‘শাইয়ানের কতই বা বয়স। এই বয়সের একটি শিশু কি আত্মহত্যা করতে পারে? পারে না। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।’
সিসিটিভি ফুটেজে যা দেখা গেছে: শাইয়ানের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। মাদ্রাসার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সোমবার রাত ৮টা ৪০ মিনিটের দিকে মাদ্রাসার টয়লেটে ঢোকে শাইয়ান। ৮টা ৫৬ মিনিটের দিকে বায়েজিদ নামের এক ছাত্র টয়লেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজা বন্ধ থাকায় অপেক্ষা করতে থাকে সে। এরপর রাত ৯টা ১৩ মিনিটের দিকে মুনতাসীর নামের আরেক শিক্ষার্থী সেখানে যায় এবং দরজা বন্ধ থাকায় সেও অপেক্ষা করতে থাকে। ৯টা ১৭ মিনিটে মুনতাসীর সেখানে গিয়ে দরজা নক করে। ৯টা ২০ মিনিটে মাদ্রাসা ছুটি হয়ে যায়। সর্বশেষ ৯টা ২২ মিনিটে টয়লেটের দরজা ভেঙে শাইয়ানের লাশ পাওয়া যায়। তার গলায় ফাঁস লাগানো ছিল। মো. রিদোয়ান নামের এক শিক্ষক তার লাশ প্রথমে দেখেন।
মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হাফেজ ফোরকান মনসুর বলেন, ‘মাদ্রাসায় সিসিটিভি রয়েছে। শাইয়ানের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, সেটা সেই ফুটেজ দেখলেই বোঝা যাবে। শাইয়ান আত্মহত্যা করেছে।’
দারুস সুফফাহ তাহফিজুল কোরআন মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ২১ নভেম্বর। মাদ্রাসাটিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর অনুমোদন রয়েছে।
সুখের ঘরে আঁধার: আট বছর ধরে কাদের ভবনে পরিবার নিয়ে বাস করছেন মশিউর রহমান। নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজারে সেলাই মেশিনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবসা তাঁর। স্ত্রী, এক মেয়ে ও তিন ছেলে নিয়ে সুখের পৃথিবী। মেয়েটি বড়, সাফিরা মাকারিন। ছেলে শাইয়ান তাঁর দ্বিতীয় সন্তান। বাকি দুই ছেলে সাদিদের বয়স প্রায় ছয় বছর ও সামিমের বয়স মাত্র ছয় থেকে সাত মাস। মাকারিন, শাইয়ান ও সাদিদ– তিনজনই দারুণ মেধাবী। মাদ্রাসায় ভর্তি করার আগে চকবাজার এলাকার সাউথ এশিয়ান স্কুলে লেখাপড়া করত শাইয়ান। গত নভেম্বরে তাকে দারুস সুফফাহ তাহফিজুল কোরআন মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে কোরআনের প্রায় ছয় পারা মুখস্থও করেছে সে। তাকে হাফেজ করার পর আরও লেখাপড়া করানোর ইচ্ছা ছিল মা-বাবার। এর আগেই পরিবারের সবাইকে কাঁদিয়ে, সব স্বপ্ন চুরমার করে চিরবিদায় নিল সে।
শাইয়ানের খালা খোদেজা বেগম বলেন, ‘শাইয়ান চটপটে, দুরন্ত হলেও খুব ভদ্র ছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি চিত্রাঙ্কন নিয়ে পড়ে থাকত। এলাকার এমন কোনো ক্লাব নেই, যেখান থেকে পুরস্কার পায়নি।’ তিনি বলেন, ‘শাইয়ান মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় পরনে পাঞ্জাবি ছিল। টয়লেটে তার লাশ উদ্ধারের সময় তার গায়ে গেঞ্জি (টি-শার্ট) ছিল। তার পাঞ্জাবি কোথায় গেল? তাকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত করলেই বিষয়টি বেরিয়ে আসবে।’
তিনি বলেন, ‘শাইয়ান শুধু ভালো আঁকতই না, সে এ বয়সেই ইলেকট্রিকের ছোটখাটো সমস্যা সমাধান করতে পারত। এসব দেখে তার মা-বাবা তাকে হাফেজ করার পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর স্বপ্ন দেখতেন। তবে হলো না। আমাদের কাঁদিয়ে চলে গেল সে। কোন পাষণ্ড এমন কাজ করল?’
এ সময় শাইয়ানের নানা খন্দকার মো. হেলাল শাইয়ানকে যে মেরে ফেলা হয়েছে, তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন– মাদ্রাসার যে টয়লেট থেকে শাইয়ানের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেটি আমরা দেখেছি। টয়লেটটির উচ্চতা খুব বেশি নয়। বয়স কম হলেও শাইয়ানের উচ্চতা কম নয়। সেখানে শাইয়ানের উচ্চতার কেউ নিজের গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করবে, সেটা কোনো পাগলও বিশ্বাস করবে না। মূলত আমাদের শাইয়ানকে মেরেই ফেলা হয়েছে।’
পুলিশ মৃত্যুর কারণের অপেক্ষায়: পুলিশ এ মৃত্যু নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। নগরীর চকবাজার থানার ওসি মনজুর কাদের বলেন, ‘শাইয়ানের লাশ উদ্ধারের পর চমেক মর্গে ময়নাতদন্ত হয়েছে। এরপর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর বোঝা যাবে মৃত্যুর কারণ। তখন আমরা সেভাবে আইনি ব্যবস্থা নেব।’
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com