বিদেশি কর্মী

শিক্ষার উন্নয়ন হচ্ছে কোথায়, কীভাবে? 

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৬ মার্চ ২৩ । ০০:২৫ | প্রিন্ট সংস্করণ

মঞ্জুরে খোদা

ছাত্রজীবনে স্লোগান দিয়েছি– পরিকল্পিত শিক্ষা চাই/ বিকশিত জীবন চাই। আমাদের সেই চাওয়া শুধু স্লোগানেই ছিল। শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কি শুধু আয়-উপার্জন, নাকি জ্ঞান-বিজ্ঞান, মনুষ্যত্ব? এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও কেউ অস্বীকার করতে পারেন না– শিক্ষার সঙ্গে কর্মদক্ষতা, পেশা নির্বাচন ও উন্নয়নের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। যে কারণে প্রকৌশল-প্রযুক্তিতে লেখাপড়া করে কাজ করছে ব্যাংক বা প্রশাসনে। বিজ্ঞান-বাণিজ্য-চিকিৎসায় পড়ে চাকরি করছে কাস্টমস, পুলিশ বিভাগ বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। আবার অনেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে ঠিকই, কিন্তু প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাবে শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারছে না।
একটি দেশের শিক্ষা কাঠামোর সঙ্গে শ্রমবাজারের সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং বাজারের চাহিদা-জোগানের বিষয়টি বিবেচনা করা দেশের বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। এভাবেই শিক্ষার সঙ্গে শ্রমবাজারের বাস্তব সংযোগ তৈরি হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক দুর্বলতা, সুশাসনের নানা সংকট এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। যার অর্থনৈতিক আকৃতি ও বাণিজ্যিক পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংগতভাবেই এ কর্মের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমশক্তি দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা পদ্ধতি বা কাঠামো সে ধরনের শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে পারছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুসারে, দেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা ৩ কোটি ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৮১১, যা মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। প্রতিবছর যে সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে, সেই অনুপাতে চাকরির বাজার তৈরি হচ্ছে না। ফলে শিক্ষিত তরুণরা বেকারই থেকে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিবছর আরও নতুন শিক্ষিত বেকার যুক্ত হচ্ছে। এর মানে, বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
একদিকে বাংলাদেশে লাখো-কোটি যুবক বেকার, অন্যদিকে দেশের শ্রমবাজারে বছরের পর বছর লাখ লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করছে। টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ২১টি খাতে ৪৪ দেশের ২ লাখ ৫০ হাজার বিদেশি নাগরিক কাজ করছে। এর মধ্যে করদাতার সংখ্যা মাত্র ৯ হাজার ৫০০। বাকি ২ লাখ ৪১ হাজার অবৈধ। তারা দেশ থেকে বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে, যা প্রায় পদ্মা সেতুর মোট ব্যয়ের সমান। এর ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি নাগরিকদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ১ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। সব মিলিয়ে বিদেশি কর্মীদের মোট বার্ষিক আয় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার; দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে সরকার যে পরিমাণ অর্থ আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে।

টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ভারতের নাগরিক। সরকারি হিসাবেই দেশটির ৩০ হাজারের বেশি নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করে। এর পর চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, নরওয়ে ও নাইজেরিয়া উল্লেখযোগ্য। তাদের ন্যূনতম মাসিক বেতন দেড় হাজার মার্কিন ডলার। আর বিদেশি কর্মীদের মোট বার্ষিক আয় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে দেশে নিয়ে যায় ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। তবে বৈধভাবে নিয়ে যাচ্ছে ৩৯১ কোটি টাকা এবং অবৈধভাবে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি। এর ফলে বছরে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ১২ হাজার কোটি টাকা।

যেসব খাতে বিদেশি শ্রমিক কাজ করছে সেগুলো হচ্ছে– তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, বায়িং হাউস, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎকেন্দ্র, মোবাইল ফোন কোম্পানি, তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়া শিল্প, চিকিৎসাসেবা, কার্গো সেবা, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডস, আন্তর্জাতিক এনজিও প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান। এসব খাতে দক্ষ শ্রমশক্তি কি আমাদের দেশে গড়ে তোলা সম্ভব নয়? খুব সম্ভব। কিন্তু এত দিনেও কেন হয়ে ওঠেনি– সেটিই একটি বড় প্রশ্ন। আশির দশকে যখন এই শিল্প গড়ে ওঠে তখন হয়তো তাৎক্ষণিক এমন শ্রমশক্তি গড়ে তোলা যায়নি। কিন্তু এর তিন-চার দশক পরও সে অবস্থা বজায় থাকবে– তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র সাতটি, শিক্ষার হারও ছিল কম। এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৫০টির ওপর।

শ্রমবাজারের এ অবস্থা প্রমাণ করে– দেশে মানসম্পন্ন প্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষায়তনিক প্রস্ততি নেওয়া হয়নি! সেটি না হয়ে থাকলে প্রয়োজনীয় কারিগরি ও পেশাগত জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরির সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি। দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এ জন্য এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে যা করা যেতে পারে–

১. দেশে যদি উপযুক্ত মানের শিক্ষক, প্রশিক্ষক, প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি না থাকে তার দ্রুত বন্দোবস্ত করা। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনে সে কাজ করানো এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে উপযুক্ত কর্মী তৈরিতে বাধ্যবাধকতা তৈরি করা।

২. সেটি না করা গেলে এমনও করা যেতে পারে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী বাছাই করে তাঁদের বৃত্তির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করে সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ করিয়ে এনে এই চাহিদা পূরণ করা। প্রয়োজনে এ জন্য একটি আলাদা তহবিল গঠন করা যেতে পারে।

৩. যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিদেশি শ্রমশক্তি নিয়োজিত; তাদের মধ্যেও এই চাপ বা বাধ্যবাধকতা তৈরি করা, যাতে তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেসব স্থানে দেশীয় শ্রমশক্তির নিয়োগ নিশ্চিত করতে পারে।

৪. বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এই প্রতিষ্ঠানের সেই সক্ষমতা তৈরিতে কাজ করা। প্রয়োজনে দেশে কর্মরত বিদেশিদের দিয়ে দেশীয় কর্মীদের শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সে প্রচেষ্টা এগিয়ে নেওয়া।

৫. শিল্প খাতের সম্প্রসারণ ঘটলে শ্রমশক্তির চাহিদা বাড়বে। বৈশ্বিক মানদণ্ডের উপযোগী কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত, কারিগরি ও প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ তরুণ-যুব জনগোষ্ঠী প্রস্তুত করতে না পারলে দেশে বেকারত্ব যেমন বাড়বে, তেমনি আর্থিক দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

বাংলাদেশে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি মানে দেশীয় বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হওয়া। বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম প্রধান শ্রমশক্তি রপ্তানিকারক দেশ। আর সেই দেশেই কিনা লাখ লাখ বিদেশি কর্মী যুগ যুগ ধরে কাজ করছে। বিষয়টি খুবই স্ববিরোধী।

ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক; শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com