
শিল্পকলা
বিমূর্ত ছাপচিত্রে নন্দন ভুবন
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
হামিম কামাল

ঢাকার মোহাম্মদপুরে স্টুডিও ৬/৬-এ চলছে শিল্পী নাজিব তারেকের একক চিত্র প্রদর্শনী : স্টুডিও শো বাই নাজিব তারেক। ৯ মার্চ শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে আগামী ২৫ মার্চ পর্যন্ত। দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
নব্বইয়ের দশকে ভিন্নধারার শিল্পকর্ম সৃষ্টির মাধ্যমে আপন শৈলী প্রতিষ্ঠিত করে যাঁরা আগামীর পথিকৃৎ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, নাজিব তারেক তাঁদের অন্যতম। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের দুই দীক্ষাগুরু আমিনুল ইসলাম ও মুর্তজা বশীরের প্রিয় ছাত্রদের অন্যতম নাজিব তারেক। শিল্পী জীবনের শুরুতেই ফরাসি চিত্রকর ওনোরে দ্যুমিয়ের, কলম্বিয়ার শিল্পী ফার্নান্দো বতেরোসহ তৎকালীন সোভিয়েত ও জার্মান ছাপচিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বাঙালি শিল্পীদের মধ্যে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন চিত্ত প্রসাদ ও সোমনাথ হোড়।
রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য আশ্রয় করে আনন্দের জন্য শিল্পনীতিতে বিশ্বাসী নাজিব তারেকের চিত্রকর্মে বরাবরই চেনা আকৃতির অচেনা সমন্বয়ে সৃষ্ট হয়েছে নান্দনিক বিমূর্ততা; বিমূর্ততার এমন ধারার নামজাদা শিল্পীদের পাবলো পিকাসো ছিলেন অন্যতম।
স্টুডিও ৬/৬-এ স্থান পাওয়া মূলত ছাপচিত্রভিত্তিক চিত্রকর্মগুলোর কিছু সংখ্যক এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর গ্যালারি কায়ায় অনুষ্ঠিত একটি প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল। এবার সেসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছাপ ও অ্যাক্রেলিকে করা কিছু নতুন শিল্পকর্ম।
শিল্পকর্মগুলোর পেছনের গল্প খানিকটা উঠে এসেছে শিল্পীর কথায়। পেশাগত জীবনের আহ্বানে প্রথমে পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও নাজিব তারেক পরে কিছুকাল ব্র্যান্ড মার্কেটিংয়ের জগতে প্রবেশ করেন। এখানে ভেন্ডর বা পার্টনার পণ্যের বিভিন্ন রকম স্যাম্পল জমা দিতেন তাঁর কাছে। স্যাম্পলগুলোর ভিড়ে কিছু পিভিসি (পলিভিনাইল ক্লোরাইড) নির্মিত বোর্ড ছিল। সেসবে অ্যান্টিকাটার চালিয়ে শিল্পী ছাপচিত্রের জন্য উপযুক্ত আকৃতি তৈরি করেন। শিল্পকর্মগুলো দেখে গ্যালারি কায়ার স্বত্বাধিকারী শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী আকৃষ্ট হন এবং প্রথমে গ্যালারি কায়া ও পরে স্টুডিও ৬/৬-এর প্রদর্শনীতে স্থান পায়।
প্রদর্শনীতে অর্ধশতাধিক শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। এদের ভেতর শিরোনামহীন সিরিজের ছবি সর্বাধিক। এ ছাড়া আছে দেবাসুর সিরিজ, কালীঘাট, চন্দ্রাহত প্রভৃতি।
নাজিব তারেকের চিত্রকর্মে বিমূর্ততার সিংহভাগ মানবাকৃতিমূলক। তবে এতেই সীমায়িত থাকেনি। আমাদের চেনা জগতের প্রাণিজ আকৃতির আশ্রয়ও নিয়েছে বিচিত্র জ্যামিতিক ও জৈবিক আকার ও সজ্জায়। তাঁর চিত্রকর্মগুলোয় চরিত্র সৃষ্টির প্রবণতা লক্ষণীয়।
শিল্পী হিসেবে তাঁর একটি বিশেষ অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেন নাজিব তারেক। তিনি বলেন, শিল্প সাধারণত দুই রকম কাজ করে। এক, দর্শকের চেনা বাস্তবতার স্বীকৃতি দেয়। দুই, চেনা পরিবেশকে অচেনা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখায়।
সাধারণ দর্শকের অবস্থান থেকে আমরা দেখতে পাই, দুটি দিকই মানুষকে ঋদ্ধ করে। যখন দর্শক তার চেনা বাস্তবতাকে শিল্পে অনুরণিত হতে দেখে, তখন শিল্পের সঙ্গে আত্মীয়তা বোধ করে এবং এই বোধ তার সংঘ ও ব্যক্তিত্বকে দৃঢ় করে। মানুষ যখন অচেনা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, তখন তা তার অভিজ্ঞতায় যুক্ত হয়। শিল্পী নাজিব তারেক জানান, মানুষের চেতনা বিস্তৃত হলেও তার যাতায়াতের অবকাশ সীমাবদ্ধ বিধায়, পৃথিবীতে মানুষের অভিজ্ঞতার জগতের একটি বড় অংশ শিল্পীদের নির্মিত। নাজিব ব্যাখ্যা করেন, শিশুদের অভিজ্ঞতা সংগ্রহের যাত্রা সবেমাত্র শুরু বলেই তাদের বইয়ে এত ছবি থাকে।
একেকটি ছবিকে বহুদিকগামী করে তুলতে চান শিল্পী। যেন একেক দর্শক তার নিজ ভুবন থেকে অর্থ আহরণ করে তাঁর শিল্পের ওপর আরোপ করতে পারেন। যে আনন্দ শিল্পী নিজে পেয়েছেন, সৃষ্টকর্মের মাধ্যমে তা দর্শকের ভেতর সঞ্চারিত হয়েছে দেখতে চান।
স্টুডিও ৬/৬-এর ঠিকানা : ৬/৬ আজিজ মহল্লা, জয়েন্ট কোয়ার্টার, ব্লক এফ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা ১২০৭। উল্লেখ্য, প্রদর্শনী ২২ মার্চ বন্ধ থাকবে।
শিল্পীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :
পুরো নাম আবু নাজিব মোহাম্মদ তারেক। জন্ম: ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭০, দিনাজপুরে। ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ছাপচিত্র বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৯৪ সালে স্নাতক ও ২০০০ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর কর্মজীবন শুরু করেন। কাজ করেছেন যুগান্তর, জনকণ্ঠ, একুশে টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে। ছিলেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক লিমিটেডের ব্র্যান্ড মার্কেটিং কনসালট্যান্ট। বাংলাদেশের শিল্পচর্চার ভুবনে তিনি প্রথম অনলাইন গ্যালারির উদ্যোক্তা। নাজিব মূলত ছাপচিত্রী হলেও তেলরং, জলরং, অ্যাক্রেলিকসহ বিভিন্ন প্রচলিত-অপ্রচলিত মাধ্যমে চিত্র রচনা করেছেন। তিনি ১৯৮৭ সাল থেকে এযাবৎকাল পর্যন্ত দেশি-বিদেশি বহু একক ও দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। ১৯৯৫ জাতিসংঘের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত তরুণ শিল্পীদের প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়েছিলেন। এ যাবৎ দেশি-বিদেশি একাধিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com