
প্রচ্ছদ
মাধবীর অন্বেষণে
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সালেহীন শিপ্রা

মাধবীকে ফুল বলে জানি। সাদা রঙের ঠিক পাঁচখান পাপড়ি। তাদের একটির গোড়ার দিকে চুপটি করে বসে আছে নরম হলুদ রং। ফুলগুলো সুসংবদ্ধ বিন্যাসে গুচ্ছবদ্ধ। খুব সূক্ষ্ম রোমে ভরা মুকুলগুলো। দেখতে কিছুটা তিল ফুলের মতো লাগে। দারুণ সুগন্ধি। একসময় ময়মনসিংহের প্রাচীন নাম ছিল পুণ্ড্রক, তাতে প্রচুর মাধবীলতা পাওয়া যেত। এজন্য এই ফুলকে পুণ্ড্রক নামেও ডাকা হয়। শীত শেষে বসন্ত এলেই ফোটে বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গান বেঁধেছিলেন–
মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে
এসে হেসেই বলে, “যাই যাই যাই।’
পাতারা ঘিরে দলে দলে তারে কানে কানে বলে,
“না না না।’
নাচে তাই তাই তাই॥
আকাশের তারা বলে তারে, “তুমি এসো গগন-পারে,
তোমায় চাই চাই চাই।’
পাতারা ঘিরে দলে দলে তারে কানে কানে বলে,
“না না না।’
নাচে তাই তাই তাই॥
বাতাস দখিন হতে আসে, ফেরে তারি পাশে পাশে,
বলে, “আয় আয় আয়’॥
বলে, “নীল অতলের কূলে সুদূর অস্তাচলের মূলে
বেলা যায় যায় যায়।
বলে, “পূর্ণশশীর রাতি ক্রমে হবে মলিন-ভাতি,
সময় নাই নাই নাই।’
পাতারা ঘিরে দলে দলে তারে কানে কানে বলে,
“না না না।’
নাচে তাই তাই তাই॥
এই মাধবী কি শুধুই ফুল! নাকি ফুলের অধিক কিছু! আকাশের তারা যাকে আসমানে ডাকে, অথচ বেলা যায়, সময় নাই! আর পাতারা কিছুতেই তাকে যেতে দিতে ইচ্ছুক নয়!
তাহলে রফিক আজাদ থেকে পড়ি–
তুমি সেই লোকশ্রুত পুরাতন অবাস্তব পাখি,
সোনালি নিবিড় ডানা ঝাপটালে ঝরে পড়ে যার
চতুর্দিকে আনন্দ, টাকার থলি, ভীষণ সৌরভ!
রোমশ বালুকা-বেলা খেলা করে রৌদ্রদগ্ধ তটে
অস্তিত্বের দূরতম দ্বীপে এই দুঃসহ নির্জনে
কেবল তোমার জন্যে বসে আছি উন্মুখ আগ্রহে–
সুন্দর সাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে– ‘যাই’।
এখানে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে যে মণ্ডপ, কামী, পুষ্পেন্দ্র, অভীষ্টগন্ধক, অতিমুক্ত, বিমুক্ত, কামুক ও ভ্রমরোৎসব এইসব ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয় যে মাধবী ফুলকে এই কবিতার মাধবী কিছুতেই কেবল সে ফুল নয়। অবশ্যই ফুলের অধিক কিছু।
একদিন অন্বেষণের ডাকবাক্স খুলে মাধবীকে খুঁজে নেব, ভাবি। হঠাৎ জন্মানো শিশুটি যেমন শিখতে থাকে। প্রথমে ঘ্রাণ বোঝা, শব্দ শোনা তারপর চোখে দেখে চেনা। কী দ্রুতই না তারা শিখে নেয় মায়ের স্তন থেকে কীভাবে পান করতে হবে শালদুধ! ঘুম আর জাগরণের অ্যাডজাস্টমেন্ট তারপর শোয়া থেকে বসা, বসা থেকে হামাগুড়ি আর হাঁটতে শেখা। দুনিয়ায় ধাতস্ত হওয়ার কৌশল শেখার নামই তো শিশুকাল। এই কি মাধবী তবে? এই অল্প সময়! ‘যাই’ বলে হঠাৎ ফুরিয়ে আসা, ফেলে যাওয়া কৈশোরের মন্ত্রমাখা উচ্ছল দিনের সীমানায়! কেউ কেউ বলেন যে সাত বছর বয়স থেকে মানুষের স্মৃতি জমা হতে থাকে। কিন্তু দেখা যায় ছয় বছরের শিশুও তার চার বছরের স্মৃতি নিয়ে বলতে পারছে। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, সময়ের খুব স্বল্প পরিসরের মধ্যেও আমাদের ব্রেইন অনেক পরিমাণে তথ্য সঞ্চয় করতে পারে। কিন্তু এই স্মৃতিদের সমস্ত তথ্যই সে জমিয়ে রাখে না। উন্নয়নের অংশ হিসেবে রিকনস্ট্রাকশন করে। ফলে কিছু স্মৃতি রেখে দেয়, বাকিটা অপ্রয়োজনীয় ভেবে মুছে দেয়। এজন্যই প্রাপ্তবয়স্ক হতে হতে ব্রেইন ডেভেলপমেন্টের অংশ হিসেবে বাচ্চাকালের বেশিরভাগ স্মৃতিই হারিয়ে যায়। শুধু আপাত লংটার্ম স্মৃতিগুলো থেকে যায়। আর থেকে যায় বাকি স্মৃতিদের সামান্য নির্যাস। তাই এই সময়টা ক্ষণস্থায়ী হলেও অনেক দামি। এজন্যই জর্জ এলিয়ট বলেছেন, ‘We could never have loved the earth so well if we had had no childhood in it.’
এই মাধবী হতে পারে মানুষের কিশোরবেলাও। খাদ্যগুদামের পাশে মফস্বলের ধুলো রাস্তায় চলা সাইকেলের মতো যার গতি। আপাত ধীর কিন্তু ঘূর্ণায়মান। একদিন ফুরিয়ে গেলেও কাঁচা আমের টক স্বাদের মতো জীবনের জিভে যা স্মৃতিস্বাদের অংশ হয়ে থাকে। সেই স্মৃতি-পরবর্তী জীবনে যে কোনো মনে করায় জিভে জল আসার মতো শারীরিক অনুভূতিও যেন সাথে করে আনতে পারে। এজন্যই কি এলিজাবেথ লরেন্স বলেছিলেন, ‘There is a garden in every childhood, an enchanted place where colors are brighter, the air softer, and the morning more fragrant than ever again.’
প্রত্যেকের জীবনের ফুরিয়ে যাওয়া কৈশোরের আছে আলাদা ঘ্রাণ, রং, এমনকি নিজস্ব বাহনও। কোনো এক ত্রিমোহনী রাস্তার মোড়ের পাশ কেটে হয়তো চলে গেছে মরচে রঙা ট্রেনের বগি, ইঞ্জিনসমেত। সেও কি মাধবী নয়!
কিংবা জীবনের সবচেয়ে দামি সময় কোনটি? মনীষীরা বলেন জীবনের সবচেয়ে দামি সময় হলো যৌবনকাল। ধর্মগুলোতে যে কারণে যৌবনকালকে বিশেষ নজরে দেখা হয়। মুসলিমরা বিশ্বাস করে যৌবনের ইবাদতই শ্রেষ্ঠ ইবাদত।
নবীজি (স.) বলেছেন, পাঁচটি বিষয়কে অন্য পাঁচটি বিষয়ের আগে মূল্যবান ভেবে কাজ সেরে নাও। তা হলো– ‘বার্ধক্য আসার আগে যৌবনকালকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতার সময়কে, দারিদ্র্যে পড়ার আগে প্রাচুর্যকে, ব্যস্ততার আগে অবসরকে আর মৃত্যু আসার আগে তোমার জীবনকে মর্যাদা দাও।’ (মুসতাদরাকে হাকেম)। অন্যদিকে সনাতন ধর্মেও যৌবনকে বিশেষ ভাবা হয়।
‘ঋগ্বেদ - (৩/৮/৪)
য়ুব সুবাসাঃ পরিবীত আগাৎস উ শ্রেয়ান ভবতি জায়মানঃ/
তং ধীরাসঃ কবয় উন্নয়ন্তি স্বাধ্যো মনসা দেবয়ন্ত।’
–ব্রাহ্মচর্যপূর্বক বিদ্যালাভ করিয়া, উত্তম বস্ত্র পরিধান করিয়া যৌবনকালে যিনি গার্হস্থ্য আশ্রমে উপনীত হন তিনিই দ্বিজত্ব লাভে খ্যাতি অর্জন করিয়া মহৎ হন। ধ্যানপরায়ণ, মননশীল, জ্ঞান প্রচারক, ধৈর্যবান বিদ্বানেরা সেই পুরুষকে উন্নতি লাভে সহায়তা প্রদান করে থাকেন।
আর বাইবেল বলছে, ‘তোমার যৌবন কাহাকেও তুচ্ছ করিতে দিও না; কিন্তু বাক্যে, আচার ব্যবহারে, প্রেমে, বিশ্বাসে ও শুদ্ধতায় বিশ্বাসীগণের আদর্শ হও।’
কখনও কখনও মনে হতেই পারে যে, জীবনে যৌবনই হলো সেই মাধবীতুল্য সময়কাল; যা নির্ধারণ করে দেয় মানুষের বাকি জীবনের সফলতা ও বিফলতা। যার সোনালি ডানা ঝাপটালে চতুর্দিকে আনন্দ পড়ে থাকে সে তো যৌবনই, মাধবীর মতোই আসে আর ক্ষণকাল পরেই বলে, যাই। আসলে মানবশক্তির সর্বোচ্চ প্রকাশকাল। বৃদ্ধ হতে হতে তার মানসিক ও শারীরিক শক্তি কমে যেতে থাকে, শরীর ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে, রোগব্যাধি পেয়ে বসতে থাকে। যৌবন নিয়ে তাই কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন–
মানে না বারণ, ভরা যৌবন-শক্তিপ্রবাহ ধায়
আনন্দ তার মরণ-ছন্দে কূলে কূলে উথলায়।
জানে না সে ঘর আত্মীয় পর, চলাই ধর্ম তার
দেখে না তাহার প্রাণতরঙ্গে ডুবিল তরণি কার।
বণিকের দুটো জাহাজ ডুবিবে, তা বলে সিন্ধু-ঢেউ
শান্ত হইয়া ঘুমায়ে রহিবে– শুনিয়াছ কভু কেউ।
ঐরাবত কি চলিবে না, পথে পিপীলিকা মরে বলে?
ঘর পোড়ে বলে প্রবল বহ্নিশিখা উঠিবে না জ্বলে?
অঙ্ক কষে না, হিসাব করে না, বেহিসাবি যৌবন,
ভাঙা চাল দেখে নামিবে না কি রে শ্রাবণের বর্ষণ?
(দুর্বার যৌবন, কাজী নজরুল ইসলাম)
কেবল শক্তির জন্য নয়। যৌবন বিশেষ তার প্রেমের জন্যও। মাধবীর পাঁচ পাপড়ির এক পাপড়ির গোড়ায় যে নরম হলুদ রং। প্রেম যেন যৌবনের সেই হলুদ, এক সোনালি সময়। যার ঝোড়ো আগমন জীবনকে ভেঙেচুরে একই সাথে আবার গড়েও দিয়ে যায়। অপরের আকর্ষণে যেন নিজেকেই আবিষ্কার করা। এ এক অপার আনন্দ।
জীবনানন্দ তার প্রেম কবিতায় বলেছেন–
“সকল ক্ষুধার আগে তোমার ক্ষুধায় ভরে মন!
সকল শক্তির আগে প্রেম তুমি, তোমার আসন
সকল স্থলের ’পরে, সকল জলের ’পরে আছে!
যেইখানে কিছু নাই সেখানেও ছায়া পড়িয়াছে ...”
নতুন কবিতার– নতুন গানের– নতুন সুরের– নতুন প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে আসা একেকটা প্রেমও একদিন চিরপ্রস্থানের সুরে মিশে যায়। দলীয় জীবনযাপনের জন্য পৃথিবীতে আসা মানুষদের যুক্ত করে রাখে ভিন্ন ভিন্ন প্রেম, তারপর মৃত্যু এসে নিয়ে যায় মানুষদের। চেনা গলি, রাস্তাপাশের বিদ্যুৎলাইন, রিকশার টুংটাং, ময়লাগাড়ির বাঁশি একইরকম থাকে।
তবে মাধবী কি কেবল এই বিলাপের সুরে নিভে যাওয়ার আগের সময়টুকু? এই ক্ষুদ্র মানবজীবন? বাস্তবিকভাবে ভেবে দেখলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের লক্ষ-নিযুত-হাজার তারকারাশির জন্মমৃত্যু, আলোকবর্ষের হিসেবনিকেষের তুলনায় কত ক্ষুদ্রই-না একেকটি মানবজীবন! এই ক্ষুদ্র জীবনেরও আবার ব্যর্থতা-সফলতা দিয়ে বিচার করতে চায় লোকে! অথচ জীবন নিজেই এক সফলতা কেবল। জাইগোটকাল থেকে যেন এক তুলকালাম শুরু তারপর জন্মাবার মুহূর্ত হয়ে শিশুকাল, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে বৃদ্ধকালে মৃত্যুর অপেক্ষা করাকেই তো সাধারণভাবে জীবন বলে জানি আমরা। জীবন আসলে কী? অচেতনের সাথে চেতনের সমন্বয় শুধু? নাকি তেমন কিছু, যেমন হেলেন কেলার বলেন, Life is either a daring adventure or nothing at all.
জীবন তো শেষ পর্যন্ত অ্যাডভেঞ্চারাস যাত্রাই এক। মাধবী যেমন করে ফাল্গুনে আসে, তেমনি হঠাৎ এর আসা। শিশুকাল, কৈশোর, যৌবন, প্রেম, আনন্দ– এই পাঁচ পাপড়ির এক ফুল। পৃথিবীতে থেকে যাওয়ার টান আর মায়া কী দারুণ তীব্র ঘ্রাণ, ঠিক এই মাধবীর মতোই। স্বল্পায়ু জীবন শেষে মিলিয়ে যেতে হয় না চাইলেও। বলার ইচ্ছে না হলেও বলতে হয়, যাই।
জ্ঞানীরা বলেন, বৃদ্ধ হওয়ার আগে দিনগুলো খুব ছোট মনে হয় আর বছরগুলোকে লাগে দীর্ঘ। আর অন্যদিকে বৃদ্ধ হওয়ার পরে, দিনগুলোকেই দীর্ঘ লাগে, কিন্তু বছর যেন দ্রুতই শেষ হতে থাকে। এইসকল মনে দীর্ঘ-ক্ষুদ্রের হওয়াহওয়ি দিয়েও আসলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় জীবনের তুচ্ছ সময়কালকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ কেবল অনুভবযোগ্য মাধবীফুলের মঞ্জরিই যেন। যাকে আসতেও হয় আর এসে ফিরেও যেতে হয়।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com