
প্রবন্ধ
বর্ধমান ভবনে বঙ্গবন্ধু
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কাজী জাহিদুল হক

শেখ মুজিবুর রহমান [১৭ মার্চ ১৯২০–১৫ আগস্ট ১৯৭৫]
বাংলা একাডেমির ইতিহাসসহ বিভিন্ন গ্রন্থে এবং বিভিন্ন গুণীজনের বাংলা একাডেমি সংশ্লিষ্ট স্মৃতিকথায় ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এবং ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আগমনের তথ্য উল্লেখ থাকলেও ঐতিহাসিক বর্ধমান ভবনে আগমনের কথা উল্লেখ নেই। অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, বঙ্গবন্ধু একটি অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে ১৯৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির বর্ধমান ভবনে এসেছিলেন। এ লেখা বঙ্গবন্ধুর বর্ধমান ভবনে আগমন নিয়ে।
বাংলা একাডেমির কথা ভাবলেই যে দৃশ্যগুলো আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে, বর্ধমান ভবন তার অন্যতম। বাংলা একাডেমির ঠিকানা ও সামগ্রিক কার্যক্রমে এ ভবনটির নাম ও ছবি ব্যবহার হয়। ‘বর্ধমান হাউস’ ঢাকার এক ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী ভবন। বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনেক পট পরিবর্তনকারী ঘটনার সঙ্গে এ ভবনের রয়েছে গভীর সম্পর্ক।
বর্ধমান ভবন প্রসঙ্গে
বর্ধমান ভবনের নিচতলার দেয়ালে ৩ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে স্থাপিত এক প্রস্তরখণ্ডে লিপিবদ্ধ তথ্য অনুযায়ী, বর্ধমান হাউস (BURDWAN HOUSE) নির্মিত হয় বঙ্গভঙ্গের সময়ে (১৯০৬), মতান্তরে বঙ্গভঙ্গ রদের পরে।
রমেশচন্দ্র মজুমদারসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপকও এখানে নানা সময়ে বাস করেছেন। কাজী মোতাহার হোসেন বর্ধমান হাউসে থাকাকালেই কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৬ সালে এখানে তাঁর অতিথি ছিলেন।
১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৫৪-এর এপ্রিল পর্যন্ত এটি ছিল পূর্ব বাংলা সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন। ১৯৫৪-এর পর থেকে বর্ধমান হাউসে ঢাকার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হতো। এখানে তখন আর্ট কাউন্সিলের কার্যালয় খোলা হয়। ১৯৫৪ সালে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এখানে কয়েক মাস বাস করেন। তা ছাড়া, জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা ও তথ্য বিভাগের কার্যালয়ও এখানে ছিল। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে গুলি চালানোকালে বর্ধমান হাউস তখন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর আবাস থাকায় এটির প্রতি জনরোষ পতিত হয়। একে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে রূপান্তর করার দাবি প্রবল হতে থাকে। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় এ ভবনে বাংলা ভাষার গবেষণাগার স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসের চত্বরে বাংলা একাডেমির উদ্বোধনের মাধ্যমে তার বাস্তবায়ন ঘটে। ৮ ডিসেম্বর এর একটি অংশে বাংলা একাডেমির কার্যক্রম শুরু। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর শেল নিক্ষেপে এ ভবনের সংস্কৃতি বিভাগ ও লোকসাহিত্য সংগ্রহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ভবনে প্রথিতযশা সাহিত্যিক-পণ্ডিতদের মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ড. কাজী দীন মুহম্মদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, আবু জাফর শামসুদ্দীন, ড. মযহারুল ইসলাম প্রমুখ গবেষণা/দাপ্তরিক কাজ করেন।
বর্ধমান ভবনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের কথা কমবেশি সবাই অবহিত। আমাদের রাজনীতির সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির রাজনীতির ক্ষেত্রে বর্ধমান ভবনে প্রতিষ্ঠিত বাংলা একাডেমির গুরুত্ব অসাধারণ।
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফসল বাংলা একাডেমি। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ১৬ নম্বর দফার বাস্তবায়ন হিসেবে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ভাষা আন্দোলন এবং যুক্তফ্রন্টের অগ্রসেনানী।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনে ব্যর্থ বাংলা একাডেমি ১৯৬২ সালে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করে। এটা শুধু রবীন্দ্র-স্মরণের সূচনা ছিল না, ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ভাঙার শুভসূচনার স্মারকও। এর পর থেকে ছায়ানটসহ বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। এ ছাড়া ছিল একাডেমির নিজস্ব আয়োজনে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যা আপাতনিরীহ পরিবেশনার আড়ালে জনমানসে সংগ্রামী আভা ছড়িয়ে যেত। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ একাডেমির পরিচালক (তখন মহাপরিচালকের পদ সৃষ্টি হয়নি, পরিচালকই ছিলেন সংস্থা প্রধান) হিসেবে যোগদান করেন অধ্যাপক কবীর চেীধুরী। যোগদানের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও মিলনায়তন হয়ে ওঠে প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রমের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
আনুষ্ঠানিকভাবে এসব কার্যক্রমে একাডেমি সংশ্লিষ্ট না হলেও মর্মগতভাবে একাডেমি এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। অবাধে একাডেমিকে কেন্দ্র করে বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রাম এগিয়ে চলে। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির ২২ বছর পর ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তানি কণ্ঠশিল্পীদের রবীন্দ্রসংগীতের মৌলিক রেকর্ড বের করে পাকিস্তান গ্রামোফোন কোম্পনি।
বঙ্গবন্ধুর আগমন
পূর্ব পাকিস্তানের কণ্ঠশিল্পীদের গাওয়া পাকিস্তানে প্রস্তুত রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম মৌলিক রেকর্ডের সেট প্রকাশ ও বঙ্গবন্ধুকে উপহার প্রদান উপলক্ষে ‘গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইস্ট পাকিস্তান’ ১৯৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বর্ধমান ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে (বর্তমানে যেখানে বাংলা একাডেমির লোকঐতিহ্য জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে) আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন এবং বক্তৃতা দেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বর্ধমান ভবনে বঙ্গবন্ধু এই একবারই এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর রবীন্দ্র-প্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। এদিনের দীর্ঘ বক্তৃতায়ও তা প্রতিফলিত হয়। ঢাকা এবং করাচি থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় এ অনুষ্ঠানের খবর গুরুত্বসহকারে সচিত্র ছাপা হয়।
লক্ষণীয় বিষয় অনুসন্ধানে প্রাপ্ত সবক’টি বাংলা পত্রিকায়ই শেখ মুজিবুর রহমান নামটি ‘মুজিবর’ লেখা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু যে সময়ে বর্ধমান ভবনের আসেন, তা ছিল বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল পর্ব। ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে তাঁকে কারাবন্দি করে। তাঁর মুক্তির দাবিতে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের চাপে সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বন্দি আসামিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব কারামুক্ত হন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে [সোহরাওয়ার্দী উদ্যান] শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা প্রদান করে এবং তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। এর কয়েক মাস পর তিনি বর্ধমান ভবনে আসেন।
সেই অনুষ্ঠান উপলক্ষে সেদিন বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে তিল ধারণের স্থান ছিল না। বহু লোক স্থানাভাবে ফিরে যায়। এই অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের পক্ষ হতে ‘ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার, রবীন্দ্র বিরোধিতা চলবে না, রবীন্দ্র সাহিত্য প্রকাশ কর’, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হউক’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়।
রবীন্দ্রসংগীতের মৌলিক রেকর্ড প্রকাশের প্রধান উদ্যোক্তা প্রখ্যাত রবীন্দ্র-সংগীতশিল্পী কলিম শরাফী অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তৃতা প্রদান করেন। তিনি বলেন, রবীন্দ্রসংগীত গাইলে বিপদ হবে এমন কথা শুনেও তাঁরা নেতৃবৃন্দ ও জনসাধারণের ভালোবাসা সম্বল করে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করতেন। কলিম শরাফী রবীন্দ্রসংগীত প্রকাশে গ্রামোফোন কোম্পানি বিশেষ করে এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর বেগম রোজি লতিফের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
কবি বেগম সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বিশ্বভারতীর অনুমোদন নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র রচনাবলি প্রকাশের জন্য অবিলম্বে উদ্যোগ গ্রহণ করতে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের [তৎকালীন; সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠানটি বাংলা একাডেমির সাথে একীভূত হয়] প্রতি আহ্বান জানান। তিনি শাহজাদপুরে অবস্থিত রবীন্দ্রনাথের ‘কুঠিবাড়ী’ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানান।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলা উন্নয়ন বোর্ড নজরুল রচনাবলি প্রকাশ করিতেছে ইহা আনন্দের কাজ। কিন্তু সেই সঙ্গে রবীন্দ্র রচনাবলি প্রকাশের ব্যবস্থাও করিতে হইবে। বাংলা ভাষার সেবার জন্যই বাংলা উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে; কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নহে।’ পশ্চিমবঙ্গের বইপুস্তক পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধের নিন্দা করে তিনি বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানে এইসব বইয়ের প্রবেশ নিষিদ্ধ নয়। সেখানে এইসব বইয়ের অবাধে প্রমাদে পরিপূর্ণ পুনর্মুদ্রণ হইতেছে।’
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘যে জাতি তাহার কবি-সাহিত্যিককে সম্মান করে না, সে জাতি কখনও সমৃদ্ধ হইতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনাবলিতে কোটি কোটি বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাইয়াছেন। বিগত ২২ বৎসর যাবৎ বাংলার সংস্কৃতি ও ভাষাকে দমিয়ে রাখার বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে; সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর বারবার আঘাত আসিয়াছে। কিন্তু পূর্ব বাংলার জাগ্রত জনগণ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে সেই প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করিয়াছে। শোষক চক্র ভাবিয়াছিল যে, জনসাধারণকে দাবাইয়া রাখিতে হইলে উহার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করিতে হইবে। এতদুদ্দেশ্যেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর বিভিন্ন পর্যায়ে হামলা নামিয়া আসে। … অত্যাচার আর নিপীড়ন দ্বারা কোনো জাতিকে কোনোদিন দাবাইয়া রাখা যায় না। বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতি চিরদিন বাঁচিয়া থাকিবে। ইহার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রই আর সহ্য করা হইবে না।’ এ প্রসঙ্গে তিনি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আনুপূর্বিক ব্যাখ্যাদান করেন।
‘সংস্কৃতির উপর হামলার কারণেই রবীন্দ্রসংগীতের উপর হামলা আসে’ উল্লেখ করে শেখ মুজিব বলেন, ‘রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া বাংলা সংগীতই অসম্পূর্ণ।’ রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য বাঙালির জীবন এবং বাংলা সাহিত্যের ন্যায় তাঁর জীবনেও বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে– উল্লেখ করে শেখ মুজিব জানান, জেলখানার নির্জনে রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ তাঁকে প্রেরণা জোগাত। জেলে ‘সঞ্চয়িতা’ হইতে ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা’ কবিতা পাঠ করিয়া তিনি প্রেরণা লাভ করতেন।
শাহজাদপুরে এবং শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ীর যথাযথ সংরক্ষণ না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে শেখ মুজিবুর রহমান জানান, সাম্প্রতিক এক সফরকালে তিনি শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ব্যবহৃত পালকি ও অন্যান্য জিনিসপত্র সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে দেখেছেন। এইসব স্মৃতি তিনি যথাযথভাবে সংরক্ষণের দাবি জানান।
শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের নদনদী, আবহাওয়া, জলবায়ু, মানুষ ও প্রকৃতি এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করার জন্য শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতি আহ্বান জানান। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদেরও ওই ধরনের রবীন্দ্রসংগীত বেশি বেশি পরিবেশন করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘স্বাধীনতার ২২ বৎসর পর রবীন্দ্রসংগীতের মৌলিক রেকর্ড প্রকাশ নিতান্ত লজ্জার বিষয়। …বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আর কোনো হামলা হইতে দেওয়া হইবে না এবং এখন হইতে পূর্ব পাকিস্তান অবশ্যই বাংলাদেশ নামে পরিচিত হইবে।’
সেদিনের অনুষ্ঠানে গ্রামোফোন কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর বেগম রোজি লতিফের হাত থেকে প্রথম সেটটি নিয়ে বেগম সুফিয়া কামাল শেখ মুজিবকে উপহার দেন।
অনুষ্ঠানে শিল্পী আফসারী খানম, বিলকিস নাসিরুদ্দিন, রাখী চক্রবর্তী, কলিম শরাফী, জাহেদুর রহিম এবং ওয়াহিদুল হক রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী এবং ছাত্রগণ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর আগমনের প্রতিক্রিয়া
২২শে ডিসেম্বর ১৯৬৯ তারিখে অনুষ্ঠিত বাংলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদের ৫২তম সভায় রচনাবলী প্রকাশের ও তার জন্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনাটি শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার [৬ই পৌষ, ১৩৭৬/ ২২ শে ডিসেম্বর ১৯৬৯ সোমবার] ‘বাংলা বই-পুস্তক’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়–
‘শেখ মুজিবর রহমান বিশ্বভারতীর অনুমোদন লইয়া রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশ করার জন্য কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। পাকিস্তানে প্রথম প্রস্তুত রবীন্দ্রসংগীতের মৌলিক রেকর্ড সেট তাঁহাকে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি উপরোক্ত আহ্বান জানান। নানা কারণে শেখ সাহেবের আহ্বানটি প্রদেশবাসীর– বিশেষতঃ সুধী সমাজের সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। সকলেই ইহার অপরিহার্যতা স্বীকার করিতেছেন। ... আমাদের দেশে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কলা বিভাগের বিভিন্ন বিষয়ক বই-পুস্তক বিদেশ হইতে আমদানী করা হয়। পার্লামেন্টারি শাসনামলে, এমনকি বিগত শাসনকালের প্রথম দিকেও পশ্চিমবঙ্গ হইতে বাংলা বইপত্র আমদানী নিষিদ্ধ ছিল না। মাত্র স্বল্প কয়েক বছর পূর্বে সাত-পাঁচ চিন্তা না করিয়া বাংলা বই আমদানী সর্বতোভাবে বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। তখন রবীন্দ্রনাথকেও গ্রাম-বাংলার মৃত্তিকা হইতে নির্বাসন দেওয়ার অচিন্ত্যপূর্ব প্রচেষ্টা পরিচালিত হইতে দেখা যায়। অথচ এই অচিন্ত্যনীয় প্রচেষ্টা পরিচালনাকারীরা ভাবিয়াও দেখেন নাই যে, গ্রাম-বাংলার বুক হইতে নদী-নালার চিহ্ন সর্বতোভাবে নিশ্চিহ্ন করিয়া ফেলা যেমন সম্ভবপর নয়, তেমনি বাংলা সাহিত্য হইতেও রবীন্দ্রনাথের বিতাড়ন অসম্ভব।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com