গ্রন্থ আলোচনা

হিরণ্ময় অভিজ্ঞতা ও নিদারুণ যন্ত্রণার উপাখ্যান

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৭ মার্চ ২৩ । ০০:০৩ | প্রিন্ট সংস্করণ

এম. এ. সাত্তার মণ্ডল

প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম রচিত ‘জীবনের জয়রথ: মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি ও জেলজীবন’ গ্রন্থটি আসলে তাঁর ‘Chariot of Life: Liberation War, Politics and Sojourn in Jail’ শীর্ষক গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ। মোট চার অধ্যায়ে ৩৬৫ পৃষ্ঠার এই বই আমাদের ইতিহাসের বিরল সব উপকরণের সঙ্গে ব্যক্তি, পরিবার ও পেশাগত জীবনের এক দারুণ মিশেল। একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধে লেখকের হিরণ্ময় অভিজ্ঞতার বর্ণনা; অন্যদিকে রয়েছে এক-এগারো সরকারের আমলে কারাবাসের নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার উপাখ্যান। সাড়ে তিন দশকের বর্ণাঢ্য জীবনস্মৃতিটি গোগ্রাসে পড়ে ফেলা যায়। ঝকঝকে ছাপা, প্রচ্ছদও আকর্ষণীয়।

বইয়ের সূচনা পর্বে সুখময় পারিবারিক পরিমণ্ডল, তার সঙ্গে নগরের গৃহাঙ্গনে পাখপাখালি, বৃক্ষরাজি, পত্রপুষ্পের মিঠেল বর্ণনা। সেই সঙ্গে ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায়…’ গানের কলিতে কবিগুরুকে টেনে আনা। গল্প বলার ঢংই আলাদা। অবসর জীবনের শুরুতে অভ্যস্ত ছন্দের বিচ্যুতিকে প্রাধান্য না দিয়ে কর্মকে বেছে নিয়েছেন তিনি। প্রকৃতির রং-রসের স্বাভাবিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করেছেন। যেমন জীবনের অভিজ্ঞতাকে ‘কুড়িয়ে পাওয়া মূল্যবান পাথরের মতো’ তুলনা করে ‘যা দিয়ে আমার সিন্দুক ভরে উঠেছিল’ বলেছেন। মেটাফোর ব্যবহারে লেখক দক্ষতা দেখিয়েছেন। যেমন ‘কাবা শরিফে অসুস্থ শিরীষ গাছটির জন্য দোয়া’ করার বিষয়টি মানব জাতিসহ প্রকৃতি ও প্রাণী জগতের প্রতি লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তোলে।  

বইটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও তার আগে-পরের বিস্তারিত বর্ণনা। কীভাবে লেখক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মেহেরপুরের এসডিও পদ বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলেন; কীভাবে সরকারি কোষাগার থেকে ট্রাংকভর্তি টাকা, অস্ত্রশস্ত্রসহ সীমান্তের ওপারে চলে গেলেন এবং কীভাবে মেহেরপুর আম্রকাননে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন– এসবের চিত্তাকর্ষক বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া কী কায়দায় সহযোদ্ধাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ ও যুদ্ধকৌশল ঠিক করে গ্রামগঞ্জ-খানাখন্দে জীবন বাজি রেখে গেরিলা যুদ্ধ করেছিলেন এবং দু-একবার সম্মুখযুদ্ধে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলেন, তার রোমহর্ষক অভিজ্ঞতাও ফুটিয়ে তুলেছেন বইটিতে। এমনকি বেসামরিক ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর নির্ভীক কথোপকথন ও রণকৌশল বিষয়ে মতান্তরেরও উল্লেখ করেছেন।

রাজনীতির আলোচনায়ও লেখক পরিমিতিবোধের প্রমাণ দিতে পেরেছেন। এক-এগারো পূর্ববর্তী সরকারের আমলে সামাজিক দ্বিধাবিভক্তি, আমলাতন্ত্র ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর দলীয়করণ, ‘লুণ্ঠনমূলক উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ’ করা এবং দুর্নীতির বিস্তারকে এক-এগারো সরকারের উত্থানের প্রেক্ষাপট হিসেবে যথার্থ চিহ্নিত করা হয়েছে। এক পর্যায়ে লেখকের গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গও অজানা তথ্যসমৃদ্ধ।

জেলখানার ভেতরের পরিবেশ, খাওয়াদাওয়া, ভিআইপি ও সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে সজ্জন ব্যবহার এবং ইমারতের গা ঘেঁষে বনবীথির নির্জনতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্য-তারা, আলো-আঁধারির প্রাঞ্জল বর্ণনায় যে কেউ মনের অজান্তে জেলখানায় ঢুকে যেতে পারেন। গল্পের গতি ধরে রাখতে জেলখানার সহবন্দি নিখিল ও জাফরকে শ্রোতা চরিত্রে দাঁড় করিয়েছেন। এখানেই লেখকের গল্প বলার মুনশিয়ানা। তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলার অসারতা বোঝাতে তিনি শেকসপিয়রের হ্যামলেট থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন– ‘সামথিং ইজ রটেন ইন দ্য স্টেট অব ডেনমার্ক’। কোথায় যেন পচন ধরেছে।  

লেখকের কারাজীবনের বেদনার্ত বর্ণনার মধ্যে রয়েছে জেলখানায় আপনজনের সঙ্গে কড়া পাহারায় ঘড়িমাপা সাক্ষাৎ; নির্জন প্রকোষ্ঠে একাকিত্বের যন্ত্রণা; জামিন পেয়েও পরক্ষণে তা অদৃশ্য হাতের ঈশারায় বাতিল;  হাজিরার দিন আদালতে আসা-যাওয়ার পথে দু’পাশে উৎসুক মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি; প্রিজন ভ্যানের ক্ষুদ্র অলিন্দ গলে বাইরের পৃথিবীর আলো-বাতাসের স্বাদ– এসব ইতিবৃত্ত।

একই মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে আসা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথোপকথনের অংশটি কৌতূহলোদ্দীপক। তাঁর মাঝে লেখক দেখেছেন একজন মমতাময়ী, সংবেদনশীল নারী এবং একজন সাহসী জননেত্রীকে। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিষয়ও এসেছে তাঁদের আলাপনে। দেশের উন্নয়ন ভাবনা, দারিদ্র্য, ক্ষুধা নিবারণ, অর্থনীতি ও রাজনীতি, সোনার বাংলা গড়া ইত্যাদি বিষয়ে শেখ হাসিনার ভাবনা ও আগ্রহ তিনি তুলে ধরেছেন। ইতিকথায় লেখকের তাক লাগানো উক্তি– ‘বাংলাদেশের নবযাত্রার পরিকল্পনা তৈরিতে মগ্ন থেকে শেখ হাসিনা তাঁর পীড়নকারীদেরও মুগ্ধ করেছেন।’

বইটি শেষ হয়েছে কারাগার থেকে মুক্তির আশা-নিরাশার দুলুনিতে। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পাওয়ায় তাঁর কৃতজ্ঞতার সুরের সঙ্গে আশাবাদের পরিচয় মেলে বইয়ের সর্বশেষ উক্তিতে– ‘কোনো ভালো কাজের শেষ নেই।’ ‘জীবনের জয়রথ’ শিরোনামটিও চমৎকার।

পাঠকহৃদয়ে কতটা অতৃপ্তি সৃষ্টি করতে পেরেছে, বইয়ের সার্থকতা থাকে সেখানে। এ বইয়েও অতৃপ্তি সৃষ্টি হয় যখন লেখক গল্প বলার মধ্যে প্রধানত শুধু ইতিহাস ও দর্শনকে টেনে এনেছেন নানা আঙ্গিকে। সত্য যে, গল্পের শৃঙ্খলার স্বার্থে তিনি সীমাবদ্ধ থাকতে চেয়েছেন রণাঙ্গন, জেলজীবন-আড্ডা, আদালতে আসা-যাওয়া, শীর্ষ নেতৃত্বের সান্নিধ্য ও কথোপকথনের মাঝে। তবুও গল্পের চিত্রপট পরিস্ফুটনে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ আরও শিক্ষণীয় নিজস্ব কিছু আলাপচারিতার বর্ণনা দিতে পারতেন বলে অতৃপ্তি রয়ে যায়। বইটি আরও প্রচারিত ও পাঠকনন্দিত হোক– এ কামনা করি। (প্রকাশক: শ্রাবণ প্রকাশনী; প্রথম প্রকাশ: জুন ২০২০; মূল্য: ৮০০ টাকা)   

এম. এ. সাত্তার মণ্ডল: ইমেরিটাস প্রফেসর ও প্রাক্তন উপাচার্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় 

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com