
অন্যদৃষ্টি
থ্যাঙ্ক ইউ ড্রাইভার
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৮ মার্চ ২৩ । ০১:৩৩ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলমগীর শাহরিয়ার

সরকারের শিক্ষাবিষয়ক এসইডিপি নামে একটি প্রকল্পে কাজ করতাম। শিক্ষা নিয়ে আরও উচ্চতর পড়াশোনা ও জানার আগ্রহের অংশ হিসেবে নিজ উদ্যোগেই গত বছর সেপ্টেম্বর সেশনে বিলেতে পড়তে আসা। পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত এয়ারপোর্ট হিথরো থেকে বের হয়ে গন্তব্য বন্দরনগরী পোর্টসমাউথ যাওয়ার পথে প্রথম যে বিষয়টি নজর কেড়েছিল– বিলেতের রাস্তাঘাট এবং লেন মেনে যানবাহনের সুশৃঙ্খল চলাচল। কোথাও কোনো হর্ন নেই। ওভারটেকিংয়ের প্রতিযোগিতা নেই। একটি দেশ কেমন সভ্য, সুশৃঙ্খল ও আইনকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তা যাচাই ও দেখার প্রথম মাধ্যম তার পথঘাট ও পরিবহন ব্যবস্থা।
বিলেতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে ট্রেন, বাস, আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো, ট্রাম ইত্যাদি। প্রাইভেটকার ছাড়াও ব্ল্যাক ট্যাক্সি, উবার সেবা ইত্যাদি রয়েছে। কোনো কারসাজি নেই। চাহিদামাফিক সেবা সহজলভ্য। প্রতিটি রাস্তায় পথচারীদের জন্য প্রশস্ত ফুটপাত ছাড়াও আলাদা সাইকেল লেন আছে। হাঁটা পথিকের অগ্রাধিকার। সবচেয়ে সমীহজাগানিয়া বিষয়– পারাপারে গ্রিন সিগন্যাল নেই; এমন জেব্রা ক্রসিং চিহ্নিত স্থানেও রাস্তা পারাপারের সময় পথচারী দেখলে দু’পাশের গাড়িগুলো থেমে যায়। পথচারী নিশ্চিন্তে পার হতে পারেন। কেউ জীবন হাতে নিয়ে ভোঁ-দৌড় দেন না। ঢাকার রাস্তার মতো ফুটপাতে মোটরসাইকেল তুলে দেওয়া কেউ কল্পনাও করতে পারেন না। মোটরসাইকেল এমনিতেও রাস্তায় খুব কম চলে। বাস স্টপেজের নির্ধারিত স্থানে অন্য কোনো গাড়ি থামলে জরিমানা গুনতে হয়। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় বাস এসে স্টপেজে থামবে। এক-দুই মিনিট এদিক-সেদিক হতে পারে। সেটাও গুগল অ্যাপসে জানা যাবে।
যাত্রীরা বাস থেকে নামার সময় বাসের ড্রাইভারকে ‘থ্যাংক ইউ ড্রাইভার’ বলতে বলতে নামেন। বিপরীতে ঢাকায় যাত্রীদের ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা যেমন বিরল নয়; তেমনি চালককে গালাগাল, ঝগড়াঝাঁটি করতে করতে নামার চিত্র খুবই সাধারণ এবং নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
উন্নত বিশ্বের শীর্ষ একটি দেশের সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনিয়ন্ত্রিত, অপরিকল্পিত, জনসংখ্যাবহুল একটি রাজধানী শহরের তুলনা চলে না– এ কথা সত্য। কিন্তু এক সময়ের উদ্যান নগরী ঢাকার পরিবহন নৈরাজ্যে নগরবাসী অতিষ্ঠ। প্রতিদিন মূল্যবান কর্মঘণ্টা ও বিপুল সম্পদের অপচয় হচ্ছে। পরিবহন ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য সহজলভ্য করা উচিত। মেট্রোরেলের মতো জনবান্ধব প্রকল্প, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সহজলভ্য করা জরুরি। একই সঙ্গে ট্রান্সপোর্ট ডিজিটালাইজ করতে হবে। ভাড়া নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি অনেকাংশে কমে যাবে। প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ জলপথের সুবিধারও পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। সবচেয়ে বেশি হেঁটে চলা পথের শহরে ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করতে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। ফুটপাতগুলো পথচারীবান্ধব করা, পাতিনেতাদের চাঁদাবাজিকে প্রশ্রয় না দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাসোহারা সংস্কৃতির লাগাম টেনে নাগরিক জীবন আরও সহজ ও সুন্দর করা যায়। নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাইজিন নলেজ চর্চার বিকল্প নেই। বাসযোগ্য করতে হলে নগর ময়লা-আবর্জনা মুক্ত করে নান্দনিক করা আবশ্যক। নগর যে নাগরিকবান্ধব হতে পারে– তার একটি চমৎকার উদ্যোগ ও উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন ঢাকার ইতিহাসে অন্যতম সফল মেয়র আনিসুল হক। অসংখ্য পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে পাবলিক টয়লেট বানিয়ে আনিসুল হক দেখিয়েছেন– কর্তৃপক্ষ চাইলে কী না পারে! এমন নাগরিকবান্ধব উদ্যোগ উন্নত বিশ্বেও সহসা চোখে পড়ে না। পরিবহন মাফিয়াদের উপেক্ষা করে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ কিংবা গাবতলী বাসস্ট্যান্ড রাস্তা থেকে সরানোর মতো প্রচণ্ড সাহসী উদ্যোগও এ মেয়র নিয়েছিলেন। চাইলেই অনেক কিছু করা সম্ভব।
সরকারের সৃজনশীল উদ্যোগ, সচেতন ও সভ্য নাগরিক সমাজ, সৎ, সাহসী একজন নগরপিতা এবং তাঁর উদ্যমী কর্মী বাহিনীর আন্তরিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।
আলমগীর শাহরিয়ার: কবি ও গবেষক, বিলেতে উচ্চশিক্ষারত
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com