কুম্ভকর্ণের নিদ্রা

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৮ মার্চ ২৩ । ০১:৩৩ | প্রিন্ট সংস্করণ

সম্পাদকীয়

বিলম্বে হইলেও জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ভুয়া টিকা কারবারি চক্রের সন্ধান দিয়া পুলিশের গোয়েন্দা শাখা জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা প্রশ্নে একটা গুরুত্বপূর্ণ কার্য করিয়াছে বলিয়া আমরা মনে করি। তজ্জন্য বাহিনীটির সংশ্লিষ্ট সদস্যদের অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু প্রশ্ন হইল, দেশে নকল ও ভেজাল ঔষধ নিয়ন্ত্রণে আইন শুধু নহে; উহা কার্যকরে একটা স্বতন্ত্র সংস্থা থাকিবার পরও এত বড় জালিয়াতি এতদিন চলিল কীরূপে? শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদনে যেমন বলা হইয়াছে, ভারত হইতে অবৈধ পথে হেপাটাইটিস-বির আমদানি-নিষিদ্ধ টিকা আনিয়া একটা অ্যাম্পুলের ঔষধকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ১০টা নকল অ্যাম্পুলে ভরিয়া জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধী টিকা হিসাবে নারীদের শরীরে পুশ করা হইত। শুধু উহাই নহে; মাত্র ৩৫০ টাকায় ক্রয়কৃত অ্যাম্পুল ১০ জনের শরীরে পুশ করিয়া মোট ২৫ সহস্র টাকা লওয়া হইত। আরও বিস্ময়কর, এই অবৈধ টিকার কারবারিরা রাজধানীর অদূরে ইহা তৈরির জন্য রীতিমতো কারখানা বসাইয়াছে। ঢাকা ও গাজীপুরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া প্রকাশ্যে মাইকযোগে এবং স্কুল-কলেজে গিয়া ছাত্রীদের মধ্যে উহার প্রচার চালাইয়াছে। তৎসত্ত্বেও অন্য কোনো সরকারি সংস্থা তো দূর স্থান; নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কুম্ভকর্ণের ন্যায় নিদ্রামগ্ন। প্রতিবেদন মতে, গত দুই বৎসরে এই চক্র শিক্ষার্থীসহ প্রায় ছয় সহস্র নারীকে নকল টিকা দিয়াছে। ইহা বুঝিতে কাহারও বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা তো বটেই, আরও অনেকেই উক্ত জালিয়াত চক্রের সহিত যুক্ত। কারণ শুধু ঐ ভুয়া টিকা প্রস্তুত বা বিপণনের সহিত জড়িত লোকদের পক্ষে এত বড় জালিয়াতি অসম্ভব।

অবশ্য এই দেশে প্রায়শ নকল, ভেজাল ঔষধ প্রস্তুত ও বিক্রয়কার্য উন্মোচিত হইলেও উল্লিখিত ভুয়া টিকার কারবার দেখিয়া বিস্মিত হইবার কারণ অতি সামান্যই। আমরা ইহাও দেখিয়া থাকি, যখনই এই প্রকার জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে তখনই ঔষধ প্রশাসনের জনবল সংকট, তৎসহিত প্রযুক্তিগত দুর্বলতার বিষয়ও আলোচনায় আসে। জনবল সংকটের অর্থ, মানহীন ঔষধের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাইতে যে সংখ্যক দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী তথায় থাকা আবশ্যক, তাহা ঔষধ প্রশাসনে নাই। আবার বিশেষত আমদানিকৃত ঔষধ বা উহার কাঁচামালের মান যাচাই কিংবা নকল ও ভেজাল ঔষধ পরীক্ষায় উপযুক্ত প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলও প্রতিষ্ঠানটিতে নাই। এই দিক হইতে এমনটা বলিলে ভুল হইবে না, সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যের প্রতি সরকারের মধ্যে এখনও যতটুকু উদাসীনতা রহিয়াছে, উক্ত ঘটনা তাহারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। হয়তো বলা হইবে, নকল ও ভেজাল ঔষধ বিষয়ে যথেষ্ট জনসচেতনতা থাকিলে এহেন প্রতারণা সম্ভবপর হইত না। কিন্তু ইহাও তো অস্বীকার করা যাইবে না– জরায়ুমুখ ক্যান্সার অত্যন্ত প্রাণঘাতী রোগ হইলেও বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উহা প্রতিরোধে যথেষ্ট তৎপরতা নাই। ফলস্বরূপ আতংকিত নারীদের মধ্যে যে কোনো উপায়ে উক্ত ভয়ঙ্কর রোগ প্রতিরোধের প্রবণতা জন্মিয়াছে। মনে রাখিতে হইবে, প্রতারকচক্র উক্ত ভুয়া টিকার প্রচারণায় বেশ কয়েকটা পরিচিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে ব্যবহার করিয়াছে। যাহার ফলে ভুক্তভোগী নারীদের ফাঁদে ফেলা সহজ হইয়াছে।

আমরা প্রত্যাশা করি, পুলিশ অনতিবিলম্বে উক্ত ভুয়া টিকা চক্রের সকল সদস্যকে গ্রেপ্তারে মনোযোগী এবং যথাযথ তদন্তপূর্বক দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করা হইবে। একই সঙ্গে যে সকল নারীর উপর উক্ত টিকা প্রয়োগ করা হইয়াছে, তাঁহাদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়টা দূর করিবার লক্ষ্যে জরুরি উদ্যোগ গ্রহণের গুরুত্ব অস্বীকার করিলে চলিবে না। সর্বোপরি, ঔষধ লইয়া এহেন জালিয়াতি চিরতরে বন্ধের লক্ষ্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে প্রয়োজনে ঢালিয়া সাজাইবার পাশাপাশি উহাকে পর্যাপ্ত জনবল ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ করা জরুরি।  


© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com