নকল ভ্যাকসিন বাণিজ্য

কারখানা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা হিমেলের

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৮ মার্চ ২৩ । ০১:৫৮ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইন্দ্রজিৎ সরকার

জরায়ু ক্যান্সারের নকল ভ্যাকসিন (টিকা) নিয়ে ভয়ংকর বাণিজ্যের নাটাই ছিল স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা হিমেল সিদ্দিকের হাতে। তিনি ঢাকার কেরানীগঞ্জে দখল করা জমিতে কারখানা বানিয়ে চালিয়ে আসছিলেন এই কারবার। এ কাজে তাঁর প্রধান সহযোগী ছিলেন গ্রেপ্তার হওয়া সাইফুল ইসলাম শিপন। তবে ভ্যাকসিন তৈরি থেকে শুরু করে প্রচারণা, বাজারজাত সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন অভিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা হিমেল। এভাবে আয় করা কোটি কোটি টাকার বড় অংশই যেত তাঁর পকেটে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হিমেল সিদ্দিক দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সহসভাপতি এবং বর্তমান কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য। নকল ভ্যাকসিন কারবারে জড়িত শিপনসহ পাঁচজন গ্রেপ্তারের পর থেকে তিনি একেবারেই হাওয়া। তাঁর মোবাইল ফোন নম্বরও বন্ধ। তবে তাঁর বাবা কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মীর মোহাম্মদ দাবি করেন, আলট্রাসনোগ্রাম ও থেরাপি দেওয়ার সময় ব্যবহৃত এক ধরনের জেল তৈরির কারখানা চালু করেছিল হিমেল। ভ্যাকসিন তৈরির কথা কখনও শোনেননি। সোহাগ নামে এক যুবক ছিল তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার। তাঁর সঙ্গে টাকার ভাগ নিয়ে কিছু ঝামেলা হয়েছিল। সর্বশেষ শুভাঢ্যা পূর্বপাড়া এলাকার ওই কারখানা থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র জব্দ করে ডিবি। ছেলের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে যোগাযোগ নেই বলেও জানান মীর মোহাম্মদ।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার গোলাম সবুর সমকালকে বলেন, ভ্যাকসিন প্রতারণার ঘটনায় সংঘবদ্ধ চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে।

তারা শুধু ঢাকাতেই ১৪০ স্কুলের শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের নকল ভ্যাকসিন দিয়েছে। ভুক্তভোগীরা কেউই প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেননি। এখন জানার পর তাঁরা স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে শঙ্কিত। এই চক্রের বিরুদ্ধে রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়েছে। সেই মামলায় তাদের দু’দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে আবারও তাদের রিমান্ডে আনা হবে। চক্রে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে ডিবি।

ভারত থেকে অবৈধ পথে হেপাটাইটিস-বি’র আমদানিনিষিদ্ধ ভ্যাকসিন ‘জেনেভ্যাক-বি’ এনে তা দিয়ে জরায়ু ক্যান্সারের নকল ভ্যাকসিন বানিয়ে আসছিল হিমেল-শিপনের চক্র। ৩৫০ টাকায় কেনা একটি জেনেভ্যাক অ্যাম্পুল ভেঙে ১০টি নকল অ্যাম্পুলে ভরা হতো। সেগুলো সরবরাহ করা হতো জরায়ু ক্যান্সারের ভ্যাকসিন ‘সারভারিক্স’ হিসেবে। এভাবে দুই বছরে তারা অন্তত ৬ হাজার নারীকে নকল ভ্যাকসিন দিয়ে হাতিয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে এই চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। শিপন ছাড়া অপর চারজন হলো– ফয়সাল আহমেদ, আল আমিন, নুরুজ্জামান সাগর ও আতিকুল ইসলাম।

ডিবির তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার আনিচ উদ্দীন বলেন, সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন ছাড়াই ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল চক্রটি। ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টার্গেট করে প্রচারণা চালাত তারা। ঢাকার রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় তাদের কার্যক্রম ছিল বেশি। সম্প্রতি তাদের নকল ভ্যাকসিন নিয়ে কয়েক নারী অসুস্থ হয়ে পড়েন।

তদন্ত সূত্র জানায়, চক্রটির কার্যক্রম এখনও পুরোপুরি জানা সম্ভব হয়নি। তারা অন্তত দুই বছর ধরে এসব চালিয়ে আসছিল বলে স্বীকার করেছে। সেইসঙ্গে বিগত কয়েক মাসের নথিপত্র পেয়েছে ডিবি। সেখানে কবে, কোথায়, কতজনকে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে তারা কত টাকা পেয়েছে– এসব তথ্য রয়েছে। ভ্যাকসিন নেওয়া বিভিন্ন বয়সী নারীর নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর সংরক্ষণ করত তারা। এসব তথ্যের অপব্যবহার হয়েছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই চক্রের সঙ্গে টিকাদান কার্যক্রমে যুক্ত ব্যক্তিদের যোগসাজশ থাকতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, চক্রটি করোনার ভ্যাকসিন নিয়েও প্রতারণা করে থাকতে পারে।

ডিবি জানায়, নকল ভ্যাকসিনের প্রচারণা ও বাজারজাতকরণে ডা. এ আর খান ফাউন্ডেশন, আল নূর ফাউন্ডেশন ও পপুলার ভ্যাকসিনেশন সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের কী ভূমিকা ছিল, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অবশ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর তরফ থেকে সমকালের কাছে দাবি করা হয়, প্রতারকদের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

এদিকে নকল ভ্যাকসিনকাণ্ডের নেপথ্যে থাকা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা হিমেল সিদ্দিকের বিরুদ্ধে মাদক কারবারে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও পাওয়া গেছে। তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নানারকম অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন। গতকাল শুক্রবার তাঁর ব্যাপারে জানতে চাইলে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মিরাজুর রহমান সুমন পরে কথা বলবেন জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। আর সাধারণ সম্পাদক হাজী রমজান আলী সমকালকে বলেন, ‘আমি বিয়ের অনুষ্ঠানে আছি, এখন কথা বলতে পারছি না।’ তবে তিনি হিমেলের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করেন।





 

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com