অধিকার

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পর্যালোচনা প্রয়োজন

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৯ মার্চ ২৩ । ০৫:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ফিলিপ গাইন

বাংলাদেশে সব নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করে না এবং সবাই সমানভাবে উন্নয়নের সুযোগ পায় না। এখানে আয়বৈষম্যও দিন দিন বাড়ছে। ফলে দেশের প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলো উন্নয়নের সুফল থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত থাকছে। এদের প্রতি রাষ্ট্রের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বেগবান করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ ২০১৫ সালে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র অনুমোদন করে। এ কৌশলপত্রের উদ্দেশ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক নিরাপত্তা গড়ে তোলা; যার মাধ্যমে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করে মানবিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে সবার কল্যাণ সাধন।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য বাজেট বরাদ্দ ও উপকারভোগীর সংখ্যা ক্রমে বাড়লেও, বাজেটের একটা বড় অংশ যাচ্ছে দরিদ্র নয়, এমন মানুষের কাছে। ২০২১-২২ সালে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাজেটের ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ ৭ লাখ ৫০ হাজার সরকারি কর্মচারীর অবসর ভাতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা, সম্মানী ও চিকিৎসা বাবদ দেওয়া হয়েছে। একই অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাজেটের ৯ শতাংশ ব্যয় হয়েছে সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (কুটির শিল্পসহ) ভর্তুকি দিতে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাজেট থেকেই শিক্ষা বৃত্তি ও কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া হয় (বাইরন এবং হাবিব ২০২১)। বিশ্বব্যাপী অবসর ভাতা ও সঞ্চয়পত্রের মুনাফার মতো সুবিধা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা বাজেট বিশ্লেষণের সময় এ ধরনের ভাতা তাদের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে না। সামাজিক নিরাপত্তার জন্য মোট বাজেট থেকে দরিদ্র নয়, এমন মানুষের হাতে যেসব সুবিধা যাচ্ছে, তা যদি বাদ দেওয়া হয়, তবে জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ যায় দরিদ্রদের কাছে। যদিও কাগজে-কলমে জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ (সংশোধিত বাজেট অনুসারে ২ দশমিক ৮ শতাংশ) সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য নিবেদিত (বাইরন এবং হাবিব ২০২১)।

এ ছাড়া আরও বেশ কিছু উদ্বেগের বিষয় আছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এক গবেষণা ফলাফল বলছে– স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং উপকারভোগী নির্বাচনে রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাজেটের ৬৫ শতাংশ গিয়েছে দরিদ্র নয় এমন মানুষের হাতে। এ গবেষণা অনুসারে দেশের মাত্র ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ দরিদ্র পরিবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে কিছু সাহায্য পেয়েছে।

শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং জীবন-জীবিকার জন্য ব্যাপক হারে বাজেট কমে যাওয়া আরেকটি উদ্বেগের বিষয়। সিপিডির গবেষণা অনুসারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তি কমেছে ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ এবং মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাজেট কমেছে ৩৫ শতাংশ। আশ্রয়ণ প্রকল্প, খাদ্যনিরাপত্তা, ঋণ সহায়তা, জন্মশাসন ও পরিবার পরিকল্পনা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (কুটির শিল্পসহ) জন্য ভর্তুকি ইত্যাদির জন্য বাজেট কমে যাওয়াও একটি উদ্বেগের বিষয় (দ্য ডেইলি স্টার, ২০২১)।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ভাতা গ্রহণের জন্য আবেদন করতে গিয়ে উপকারভোগীরা নানা সমস্যার মুখোমুখি হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: (ক) জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুলের কারণে অনেক উপকারভোগী বয়স্ক ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন; (খ) বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের রেষারেষি ও তাদের দুর্নীতির কারণে ভাতা থেকে বঞ্চিত হন অনেকে; (গ) উপকারভোগীর তালিকা তৈরিতে নিয়োজিত কর্মচারীরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ভাতা পাওয়ার যোগ্য নন– এমন অনেক মানুষকে তালিকাভুক্ত করেন। ফলে প্রকৃত দরিদ্র উপকারভোগী বাদ পড়ে যান; (ঘ) অনেক যোগ্য প্রার্থী সঠিক তথ্য ও সচেতনতার অভাবে তালিকাভুক্ত হন না, আবার অনেকে ঝামেলা এড়াতে আবেদন করতে আগ্রহী হন না; (ঙ) অনেকেই অনলাইনে আবেদন করার সম্পর্কে জ্ঞাত বা দক্ষ না হওয়ায় আবেদন করতে পারেন না, আবার অনেকে আবেদন করার নির্দিষ্ট সময়সীমা সম্পর্কে অবহিত নন; (চ) সাধারণ দরিদ্র মানুষের মাঝে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগে ভীতি কাজ করে বিধায় অনেক যোগ্য প্রার্থীর নাম তালিকায় আসে না; (ছ) পুরো প্রক্রিয়া কিছুটা দীর্ঘ হওয়ায় অনেকেই বারবার গিয়ে সাহায্যের আবেদন করতে লজ্জা পান। পাশাপাশি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলতেও দ্বিধা বোধ করেন; (জ) অনেক ভাতাই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হয় এবং উপকারভোগী অনেকের নিজস্ব মোবাইল নম্বর না থাকায় অন্যের নম্বর দিয়ে আবেদন করতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভাতার টাকা তাঁর হাতে পৌঁছায় না।

এদিকে, তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা নয় অথচ তালিকায় নাম আছে ও সাহায্য পাচ্ছে– এমন ভুলের কারণে অনেক অযোগ্য প্রার্থী অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেক যোগ্য প্রার্থী সাহায্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মূলত এই দুই ভুলের কারণেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সঠিক উপকারভোগী জনসংখ্যা টার্গেটিংয়ে ভুল হয়ে থাকে এবং যোগ্য উপকারভোগীরা সাহায্য পান না। রাজনৈতিক বিবেচনা, পক্ষপাতিত্ব, দুর্নীতি, যথাযথ শাসন, দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতার অভাব, জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল বয়স ইত্যাদি কারণে সাধারণত এসব ভুল হয়ে থাকে। 

বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তার ইতিহাস অনেক পুরোনো– ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আগে থেকেই নানাভাবে দরিদ্র মানুষ সাহায্য পেয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ১ জুন জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল অনুমোদিত হয়। ওই কৌশলপত্র বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল ও কর্মসূচিকে সহজ করে এবং দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনে। তবে কভিড মহামারি ও অন্যান্য কারণে দারিদ্র্য হ্রাসের প্রণোদনা উল্লেখযোগ্য হারে ব্যাহত হয়েছে এবং যাঁরা দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে আবার দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে গিয়ে ‘নতুন দরিদ্র’ হিসেবে আবির্ভূত হন। কাজেই কভিড মহামারির পরে দরিদ্র, চরম দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। তাঁরা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে কিছু সাহায্য পান বটে, তবে তা খুবই কম। এ রকম পরিস্থিতিতে সরকারি সংস্থাগুলোকে যত্ন-সহকারে এবং সঠিক নিয়ত নিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি তৈরি করতে হবে।

ফিলিপ গাইন : গবেষক ও পরিচালক, সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ইিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড)

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com