পুতিন কি কখনও বিচারের মুখোমুখি হবেন

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ১৯ মার্চ ২৩ । ০৫:১৯ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমকাল ডেস্ক

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) সাধারণত মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করে থাকেন। নজির ভেঙে এবার বিশ্বের অন্যতম বড় শক্তি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধেই সরাসরি পরোয়ানা জারি করে বসেছেন জাতিসংঘের এ আদালতটি। তবে তিনি কি সত্যিই বিচারের মুখোমুখি হবেন– সেই প্রশ্ন উঠছে চারদিকে।

তাঁকে ধরার ক্ষমতা আইসিসির নেই। তবে তিনি সারাজীবন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবেন– এক বাক্যে এমন কথা বলার সুযোগও নেই।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাস্তবতা হচ্ছে, পুতিন এখন পরোয়ানাভুক্ত আসামি। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় তাঁর দুনিয়া সংকীর্ণ হয়ে এসেছিল। শুক্রবার আইসিসির জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তাঁকে আরও বেশি একঘরে করবে। চাইলেই তিনি এখন আর বহু দেশ সফর করতে পারবেন না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তাঁকে বাকি জীবন হয় পরোয়ানাভুক্ত আসামি হিসেবেই বেঁচে থাকতে হবে, নয়তো হেগের আদালতে উপস্থিত হয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। আরও একটি সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে কিংবা তাঁর পতন হলে তাঁকে আইসিসির কাছে সোপর্দ করা হতে পারে।  ফলে পুতিনের বাকি জীবন নানা অনিশ্চয়তার মধ্যেই কাটবে।

তবে এই মুহূর্তে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে একটি বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে যে, ইউক্রেনে যা হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, এ পরোয়ানা যথেষ্ট ‘প্রতীকী পদক্ষেপ’ যা তাঁর বিচ্ছিন্নতাকে আরও গভীর করেছে এবং এক বছর আগে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে তিনি যে দায়মুক্তি পেয়ে আসছিলেন, সেই আভাকে ভেঙে দিয়েছে।

আদালতের পদক্ষেপ অপরিসীম নৈতিক ভার বহন করে। এ পরোয়ানা পুতিনকে দারফুরে নৃশংসতার দায়ে অভিযুক্ত সুদানের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ওমর হাসান আল-বশির,  লিবিয়ার সাবেক নেতা  মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং বলকান যুদ্ধে গণহত্যায় দায়ী সার্বিয়ার নেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচের কাতারে ফেলেছে ।

এমন সময় এ পরোয়ানা জারি করা হলো, যখন পুতিন তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে মস্কোতে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে, জিনপিং ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে পুতিনকে রাজি করাতে চেষ্টা করবেন।  চীনের শান্তি পরিকল্পনা মেনে ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধ করতে রাজি হলে তা হবে বেইজিংয়ের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক বিজয়। আইসিসির পরোয়ানা চীনের এ উদ্যোগে একটি বড় ধাক্কা। 

বিবিসি জানায়, আইসিসির পরোয়ানা জারি দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ। তবে এই ধরনের একটি মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবহারিক এবং যৌক্তিক সমস্যা অপরিসীম।

বর্তমানে রুশ নেতা তাঁর জন্মভূমিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা উপভোগ করছেন। তাই ক্রেমলিন তাঁকে আইসিসির কাছে হস্তান্তর করবে– এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। যতদিন তিনি রাশিয়ায় থাকবেন, ততদিন তাঁর গ্রেপ্তর হওয়ার ঝুঁকি নেই। তবে দেশ ছেড়ে গেলে পুতিনকে আটক করা হতে পারে।

তবে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে তাঁর চলাফেরার স্বাধীনতা ইতোমধ্যেই ব্যাপকভাবে সীমিত হয়ে এসেছে।  তাঁর এমন কোনো দেশে সফরের সম্ভাবনা কম, যেখানে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।  গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রুশ সেনারা ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে তিনি মাত্র আটটি দেশ সফর করেছেন। এর মধ্যে সাতটি দেশই  ১৯৯১ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার অংশ ছিল। তার একমাত্র ব্যতিক্রমী গন্তব্য ছিল ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ ইরানে। গত বছরের জুলাই দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির সঙ্গে বৈঠক করতে তেহরান গিয়েছিলেন তিনি।

পুতিনকে গ্রেপ্তারে অন্তত দুটি বড় বাধা রয়েছে। প্রথমত, রাশিয়া আইসিসির এখতিয়ারকে স্বীকৃতি দেয় না। আদালতটি ২০০২ সালে রোম সংবিধি নামে পরিচিত একটি চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আইনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর তাঁর নিজস্ব ফৌজদারি এখতিয়ার প্রয়োগ করা প্রতিটি রাষ্ট্রের কর্তব্য। আইসিসি কেবল তখনই হস্তক্ষেপ করতে পারে, যেখানে একটি দেশ তদন্ত করতে এবং অপরাধীদের বিচার করতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক। সব মিলিয়ে ১২৩টি দেশ এ আইন মেনে চলতে সম্মত হয়েছে। প্রায় সব ইউরোপীয় দেশ এবং আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বেশ রাষ্ট্র আইসিসি সনদ স্বাক্ষর করেছে। তবে রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এ আইন অনুমোদন করেনি। 

দ্বিতীয়ত, আসামিকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ছাড়া এ আদালত বিচার পরিচালনা করেন না। ফলে সেই পথটিও বন্ধ।

যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য বিচার করার ধারণাটি আইসিসির অস্তিত্বের আগে থেকেই রয়েছে। এটি ১৯৪৫ সালে নুরেমবার্গ ট্রায়ালে নাৎসি জার্মানির কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া হয়। এর মধ্যে নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের সহকারী রুডলফ হেসও ছিলেন। যাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।  ১৯৮৭ সালে তিনি আত্মহত্যা করেন।

আইসিসি এখন পর্যন্ত পুতিন ছাড়াও ৪০ জনকে অভিযুক্ত করেছেন, সবাই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। এর মধ্যে ১৭ জনকে হেগে আটক করা, ১০ জনকে অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত এবং চারজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। তবে দণ্ডিতরা কেউই শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন না।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গ্লোবাল ক্রিমিনাল জাস্টিস অফিসের সাবেক প্রধান রাষ্ট্রদূত স্টেফেন র‍্যাপ নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, এটি পুতিনকে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। তিনি ভ্রমণ করলে গ্রেপ্তারের ঝুঁকি থাকবে। এটি কখনও দূর হবে না।  তাছাড়া আদালতের ওয়ারেন্ট তামিল না করলে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে না। র‍্যাপ বিশ্বাস করেন,  পুতিনকে শেষ পর্যন্ত  হেগের আদালতে দাঁড়াতে অথবা মাথায় পরোয়ান নিয়ে মরতে হবে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com