সাক্ষাৎকার : আবুল মোমেন, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ

উচ্চশিক্ষার মৌলিক জায়গায় দরকার আরও মনোযোগ

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

---

একুশে পদকে ভূষিত ব্যক্তিত্ব আবুল মোমেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। একাধারে সাংবাদিক, কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ। তিনি উচ্চশিক্ষার মূল সংকট তুলে ধরেছেন সমকালের কাছে।

গত এক দশকে বিবিএতে উল্লেখযোগ্য হারে যেমন শিক্ষার্থী কমেছে, তেমনি বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের বিষয়গুলোতে বেড়েছে। বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়া প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন বলেন, ‘যদি বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার জন্য শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে আগ্রহী হয় তাহলে ভালো। তবে সেটা তারা ভাবছে বলে মনে হয় না। তারা ভবিষ্যৎ চাকরির কথা ভাবছে। এখন কম্পিউটার সায়েন্স ও তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ বেড়েছে; তাই বিবিএ-এমবিএ ছেড়ে সেগুলোতে আসছে। মাঝখানে কিছুদিন আইন পড়েছে। এখন সেখানেও জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সে জন্য এখন সবার টার্গেট হচ্ছে কম্পিউটার সায়েন্স। এগুলোর এখন মার্কেট ভালো। আবার বিদেশে যাওয়ার সুযোগ বা স্বাধীনভাবে কিছু করার সুযোগ আছে।’

চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাণিজ্য বিষয়ে এক দশকে শিক্ষার্থী কমেছে ৬৯ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিবিএ-এমবিএ মানুষ জ্ঞানের জন্য নয়, চাকরির জন্য পড়ে। শুধু ক্যারিয়ার গঠন করার জন্য পড়ে। ক্যারিয়ারের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে, বাজারদর কমে গেছে; সে জন্য এটাতে আকর্ষণ কমে গেছে। বাজারে বিবিএ-এমবিএর চাহিদা পূরণ হয়ে গেছে। তারা চাকরিতে আর ভালো বেতন পাচ্ছে না। এটাই বিবিএ-এমবিএর প্রতি অনাগ্রহী হওয়ার মূল কারণ।’

তাঁর মতে, উচ্চশিক্ষার পরিসর বাড়লেও মান সেভাবে বাড়ছে না। ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্ররা যেমন বিপৎগামী, তেমনি শিক্ষকরাও গবেষণা ছেড়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে লিপ্ত। গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির যে বৈশিষ্ট্য, তা হারিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
আবুল মোমেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ও সেখানে বিভাগ বাড়ছে। কিন্তু পরীক্ষা ও ফলাফলমুখী শিক্ষা হওয়ায় গবেষণাবিমুখ হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে গবেষণায় মুখ্য হওয়া প্রয়োজন ছিল, সেখানে এখন সেটা গৌণ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় তার আসল ফোকাসের জায়গা হারিয়ে ফেলেছে। শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতির নামে বিপৎগামী হয়ে গেছে। শিক্ষকরা জ্ঞানচর্চার চেয়ে দলীয় রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে মনোযোগী বেশি।’

তিনি বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার মৌলিক জায়গায় আলো ফেলতে হবে। মূলধারার উচ্চশিক্ষা যেভাবে চলছে, তাতে ছাত্রদের বড় অংশ নিজের পছন্দের বিষয় পড়ার সুযোগ পায় না। ফলে তারা গোড়া থেকেই অনিচ্ছুক ও উদাসীন ছাত্র। তাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকে কোনোভাবে এমএ পাস করে সর্বোচ্চ ডিগ্রির সনদ অর্জন। তাদের লেখাপড়া সীমাবদ্ধ থাকে আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য পাঁচ-ছয়টি প্রশ্ন জানা ও সেগুলোর উত্তর মুখস্থ করার মধ্যে। এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে উচ্চশিক্ষার যে উদ্দেশ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা, বিশ্লেষণ করতে শেখা এবং নতুন ধারণা ও ভাবনা উপস্থাপন– তার কোনো অবকাশ এখানে থাকে না।’
শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন বলেন, ‘জ্ঞান বা জ্ঞানী সৃষ্টি নয়, ডিগ্রি-সনদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবেই সমাজে  বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেবল জ্ঞানের বোঝা বইছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্রমেই প্রাণ হারাচ্ছে। আর এভাবে আমাদের অজান্তে জনসংখ্যার সবচেয়ে প্রাণবন্ত অংশটির সহজাত প্রাণশক্তি, কৌতূহল, অনুসন্ধিৎসা, জিজ্ঞাসার অপমৃত্যু ঘটতে থাকে। উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে হলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারকে নজর বাড়াতে হবে। এখানেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ভিত তৈরি হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় দুর্বলতা হলো এর পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা। পরীক্ষা ঘিরেই পড়াশোনার আয়োজন চলতে থাকায় ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সবাই মিলে পরীক্ষা-উপযোগী বা পরীক্ষাবান্ধব একটা ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে। পরীক্ষামুখী ও ফলাফলকেন্দ্রিক নয়, জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা চর্চা করতে হবে।’

একুশে পদক পাওয়া এই সাংবাদিক বলেন, ‘প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব কোন অভিজ্ঞ শিক্ষক নেই। তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর নির্ভরশীল। অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী কোন ক্যাম্পাসও নেই। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ডিগ্রি ও সনদ বিক্রির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।’

আবুল মোমেন বলেন, ‘নতুন নতুন যে স্কুলগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলোতে খেলাধুলার ব্যবস্থা নেই, মাঠ নেই, মিলনায়তন নেই। এখন একটা ভবনে দুইটা বিশ্ববিদ্যালয়ও হচ্ছে। ফলে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে আমরা একটা হ-য-ব-র-ল লাগিয়ে ফেলেছি। এখন আবার মানসম্পন শিক্ষার জন্য সংগ্রাম করছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা লার্নিং প্রোভার্টি নিয়ে বড় হচ্ছে। সরকারি একটা জরিপে দেখা যাচ্ছে, আমাদের যারা প্রাথমিক শেষ করছে তাদের বাংলা, ইংরেজি, গণিতে ৬০ শতাংশ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এই ঘাটতি নিয়ে তারা মাধ্যমিকে যাচ্ছে। সেখানে আরো কিছু ঘাটতি যোগ হয়। সেসব ঘাটতি নিয়ে তারা উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। ফলে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বা পড়ান তাদের কারোরই সন্তুষ্টি নেই। কারণ শিক্ষার অপুষ্টি।’

তিনি বলেন, ‘গোড়া ঠিক না করে আগায় পানি দিয়ে কোন লাভ নেই। প্রাথমিক থেকে ঠিক করে আসতে হবে। সে জায়গাটা কিভাবে আমাদের হাতের বাইরে চলে গেল সেটাও স্টাডি করা উচিত ছিল। আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে করে দেখেছি, আমাদের দেশে ৬০ সালের পর থেকে শিক্ষার্থী বেড়েছে। সেটা ৮০’তে গিয়ে আরো দ্রুততর হয়েছে। কিন্তু অবকাঠামো সেভাবে হয়নি।’

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com