
সম্মাননা
হুইলচেয়ারে বসা এক সুপারম্যানের ‘ঘটনা’
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২০ মার্চ ২৩ । ১৩:১৭ | প্রিন্ট সংস্করণ
ফারুক ওয়াসিফ

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, জগতে যোগ্য লোক আছে কিন্তু তাঁকে দেখাবার যোগ্য মঞ্চ পাওয়া যায় না। আমাদের অনেক দেশদরদি মানুষ নিশ্চয়ই আছেন, কিন্তু মঞ্চের সিঁড়ি তাঁদের পা পর্যন্ত যায় না। তাঁরাও যোগ্য মঞ্চ না পেলে যান না সেখানে। সেটা ঠিকই আছে। তবে জাফরুল্লাহ চৌধুরী এসেছিলেন। অসুস্থ মানুষটিকে যাতে তাঁর বন্ধু ও দরদিরা ভালোবাসার অভিবাদন জানাতে পারেন, তার জন্য গুণীজন সম্মাননার আয়োজন করা হয়েছিল। এই দায়টা নিয়েছিল সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোর। ১৮ মার্চ শনিবার; এবং মানুষ এসেছে ভালোবাসার তরঙ্গ বুকে নিয়ে। হয়তো সবারই মনে হয়েছিল, যোগ্যতমের জন্য যোগ্য মঞ্চই এটা।
সত্য নাকি সূর্যের মতো। কিন্তু কিছু সত্য বিজলির মতো। আমাদের সাধারণ সত্য যেমন মানুষ মরণশীল, জীবন দুঃখময়– সূর্যের আলোর মতো এই সত্যগুলো সর্বজনীন। কিন্তু একটা সময়ের সত্য কোনটা; কোন মানুষটা আসলে সময়ের সন্তান; দেশের দুর্দিনে সত্যিই কী করতে হবে– এমন সব সত্য আপনাআপনি মাথায় বৃষ্টির মতো বর্ষে না। সেই সত্য বিশেষ সময়ে বিশেষ পরিস্থিতিতে হঠাৎ চমকানি দিয়ে আমাদের নজর কাড়ে। ডা. জাফরুল্লাহর সংবর্ধনা মঞ্চে যাঁরা কথা বলেছেন; যাঁরা দর্শক সারি থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন; তাঁরা তো কেউ এক পথের বা এক ধাতের মানুষ নন। নিজেরা তাঁরা যে ওই দিনের বক্তব্য নিয়ে কথা বলে নিয়েছেন, তাও না। এটা আসলে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সমগ্র জীবন থেকেই উঠে আসা সত্য। সেই সত্যের নাম আমরা দিয়েছিলাম: দেশের যোদ্ধা, বন্ধু সবার। এই সত্যের কথা আমরা জানতাম নিশ্চয়ই। কিন্তু বলতাম কি খুব একটা?
বলার সেই মঞ্চ, শোনানোর সেই পরিবেশ যখন পাওয়া গেল, তখন দেখা গেল তাঁর এক সময়ের বিরোধী ব্যক্তিও আন্তরিকভাবে তাঁর প্রতি নিজের ভালোবাসার কথা বলছেন। রবীন্দ্রনাথের চাওয়া সেই যোগ্যতমের যোগ্য মঞ্চ পাওয়া গিয়েছিল বলেই হয় তো।
কারও জীবনের অর্থটা এক লহমায় সবার সামনে যদি ধরা দেয়; সবাই যদি সেই অর্থের মহিমা টের পান; তখন সেটা এক মুহূর্ত হয়ে ওঠে। আপনাআপনি তা হয় না। জাফরুল্লাহ চৌধুরী তো সব সময়ই আমাদের নজরের সামনে ছিলেন। তাঁর বাঁচা ছিল প্রবল বাঁচা। তাঁর কাজ ছিল অপ্রতিরোধ্য। তাঁর অবদান এমনই; যে চায় না সেও তা ভোগ করতে বাধ্য। তারপরও তিনি যে সবার বন্ধু এবং দেশের যোদ্ধা; নিজের জীবনটা তিনি যে মানুষের সেবাতেই খরচ করতে চেয়েছেন; এ ছাড়া যে তাঁর আর কোনো মোহ ছিল না– সেটা কি আমরা সবাই একভাবে মানতাম? এর জন্য দরকার ছিল একটা মুহূর্ত, যেখানে উপস্থিত সবাই একসঙ্গেই অনুভব করবেন সত্যটা। এ রকম মুহূর্তেই কোনো কিছু ‘ঘটনা’ বা ইভেন্ট হয়ে ওঠে। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সংবর্ধনা মঞ্চ এবং তার বাইরে উপস্থিত থাকা সবাই মিলেই এই ইভেন্টটা ঘটে গেছে। কেউ জানত না যে, একই সঙ্গে এটা আনন্দ-বেদনা-ভালোবাসায় ভরে উঠবে। এভাবে বাস্তবে জানা ছিল না যে, সম্মান জানানোর মধ্যে আমরা নিজেরাই সম্মানিত হই।
মুহূর্তটা শুরু হয়েছিল তখন, যখন ডা. জাফরুল্লাহকে নিয়ে তাঁর সাদা রঙের অতীব পুরোনো গাড়িটা তেজগাঁওয়ে টাইমস মিডিয়া লিমিটেডের চত্বরে প্রবেশ করল। শীর্ণ হয়ে গেছেন মানুষটা। চালকের বামের আসনে বসা। পেছনে একজন সহকারী ও দুইজন নার্স। তাঁর গাড়ির ঠিক পেছনেই তিনটি জমকালো গাড়ির বহর নিয়ে ঢুকলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী। তাঁর বীরসুলভ লম্বা চেহারার সামনে লুঙ্গি পরে হুইলচেয়ারে বসা শীর্ণ জাফর ভাই। কী মনে করে কাদের সিদ্দিকী সভায় না ঢুকে ঘুরে এসে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর হাত ছুঁলেন, সালাম দিলেন।
মিলনায়তনে ঢোকার সময়েও একই অবস্থা। একদিকে গণমাধ্যমের ক্যামেরার সারি, অন্যদিকে ভক্ত-বন্ধুর ভিড়। পুরো সভার ভরকেন্দ্র নিমেষেই চলে এলো জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ওপর। একটা বহু পুরোনো মায়া, একটা শ্রদ্ধার চাদরে যেন ঢাকা পড়ল সব। যিনি হয়তো অন্য সময়ে তাঁকে ততটা পছন্দও করতেন না, তিনিও মঞ্চে হুইলচেয়ারে আসীন, চোখ বুজে থাকা মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে গলে গেলেন। যার হৃদয় পাথরের মতো, সেখানেও টোকা পড়লে প্রতিধ্বনি ওঠে। তেমনি ভালোবাসার প্রতিধ্বনিতে ভরে গেল বিশাল ঘরটা।
একে একে উপস্থিত ড. কামাল হোসেন ও হামিদা হোসেন, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিনায়ক সেন, মোস্তাফিজুর রহমান, আইনজীবী শাহ্দীন মালিক, শিল্পোদ্যোক্তা তপন চৌধুরী, মাহবুবুর রহমান, কমরেড খালেকুজ্জামান, মাহমুদুর রহমান মান্না, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, অধ্যাপক আবরার চৌধুরী, অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী, অধ্যাপক আসিফ নজরুল। কে ছিলেন না সেখানে!
হ্যাঁ, আমাদের মনে পড়বে, একদা তিনি বিলেতের সেরা প্রতিষ্ঠানে সার্জনের ডিগ্রি হওয়ার সুযোগ ছেড়ে রণাঙ্গনে ছুটে গিয়েছিলেন। প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন পাকিস্তানের পাসপোর্ট। তিনি বলতেন, যুদ্ধে পেছনে যাওয়ার রাস্তা পুড়িয়ে ফেলতে হয়; নইলে বিজয়ী হওয়া যায় না। মায়ের তিন পুত্র মিলে প্রথমে হাতে অস্ত্র তুলে নিলেন। শিগগিরই বুঝলেন, রণাঙ্গনের পেছনে যদি সহায়-সমর্থন না থাকে, তাহলে বেশি দিন যুদ্ধ চালানো যাবে না। ত্রিপুরা সীমান্তে গড়ে তুললেন যুদ্ধাহতদের জন্য বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। বেড়ার ওপর ছনের ছাউনির সেই হাসপাতালে একসঙ্গে ৫০০ রোগী থাকতে পারত। সেটাই প্রথম কোনো হাসপাতালের নামে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা যুক্ত হলো। সেই যুদ্ধ হাসপাতালই স্বাধীন বাংলাদেশে নাম নিল গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল। অনেক অর্জন রয়েছে এর।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী আশির দশকে নামলেন ঔষধ শিল্পে নয়ছয় ঠেকাতে জাতীয় ঔষধনীতি প্রণয়ন করতে। অনেক হামলা ও বাধা ডিঙিয়ে তা পাস করালেন। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিও সরকারকে নিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা আর বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ঔষধনীতির কল্যাণে ওষুধের দাম গরিবের নাগালে এসেছিল। ঔষধ শিল্প দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধকালে তাঁর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও প্যারামেডিকের ধারণা পরে বিশ্বায়িত হয়। ঔষধ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি শুধু লড়াই-ই করেননি; অসাধারণ একটা বই লিখেছেন: দি পলিটিকস অব এসেনসিয়াল ড্রাগ্স। জনস্বাস্থ্য যে গণরাজনীতির কেন্দ্রে থাকা উচিত– সেই প্রশ্নটা তিনি শেখালেন। এগুলো তাঁর অবদানের একেকটি মাইলফলক। বিদ্যাসাগর নিয়ে যেমন গল্প আছে– তিনি সড়কের মাইলফলক দেখে দেখে অঙ্ক শিখেছিলেন। দেশপ্রেম নামের কোনো বস্তুকে যদি আমরা শিখতে চাই, তাহলে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একেকটি অবদান সেই শিক্ষার একেকটা মাইলফলক।
ইতিহাস মানুষই তৈরি করে। তবে কোনো কোনো ব্যক্তি সেই ইতিহাসের খাত কাটেন; পথ গড়ে দেন। এভাবে হয়ে ওঠেন পথিকৃৎ বা দিশারি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত নয় শুধু; আরও অনেক ব্যাপারেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন দিশারি মানুষ। ভারতীয় শাস্ত্রে একটা কথা আছে ‘পুরুষকার’। অভিধানে এর অর্থ দেওয়া আছে এমন: পৌরুষ, দৈবের উপর নির্ভর না করে নিজ উদ্যম বা প্রচেষ্টা। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পৌরুষ ছিল অফুরান। কিন্তু তার চেয়েও বড় দৈব বা নিয়তির ওপর নির্ভর না করে নিজের প্রচেষ্টায় বাধা ডিঙানো। কিন্তু এই দুই মিলে হয় আরও বড় কিছু। সেটা হলো নিজের আদর্শ এবং জনগণের জন্য যে কোনো ঝুঁকি নেওয়ার সাহস। পশ্চিমারা এরই নাম দিয়েছে ‘সুপারম্যান’।
সে জন্যই তাঁর সংবর্ধনা বক্তৃতায় তাঁর ক্লান্ত, অসুস্থ গলা; যে গলা ঠিক শোনা যায় না; শুনলেও সব শব্দ পরিষ্কার হয় না; সেই অবস্থায়ও তিনি বললেন, আপনাদের আমাদের সবাইকে এক হয়ে বাংলাদেশের দায়িত্ব নিতে হবে। অবিচারের বিচার হতেই হবে। মানুষকে পরিত্যাগ করা চলবে না আপনাদের। তিনি বলছিলেন, ছাত্রকালে মা-ই তাঁকে সাহসী হতে বলেছিলেন। মানুষের জন্য কিছু করার কথা বলেছিলেন। অন্তিম সময়ে এসে জাফরুল্লাহ চৌধুরী যখন মায়ের সেই আদেশের কথা স্মরণ করছিলেন, তখন মনে হলো, কী রকম সরল সত্যে পৌঁছালে একজন ৮২ বছর বয়সী মানুষ সেই আদেশ পালন করে যেতে পারেন। এভাবেই গরিমা থেকে তিনি মহিমায় পৌঁছে গেলেন। অভিবাদন– আমাদের কালের বীর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
একটা দেশ শুধু রাষ্ট্রের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। তা দাঁড়িয়ে থাকে তার সেরা কর্মনায়ক, ভাবুক ও দেশদরদিদেরও ওপর। রাষ্ট্রের উচিত নিজের স্বার্থেই এঁদের চিনে নেওয়া। এঁদের কাজের মঞ্চকে বড় করতে না পারুক, অন্তত ভেঙে না দেওয়া।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক; সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
farukwasif0@gmail.com
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : মোজাম্মেল হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com