গোলটেবিলে বক্তারা

নারীর ক্ষমতায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা বাড়াতে হবে

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২২ মার্চ ২৩ । ০১:৩৪ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমকাল প্রতিবেদক

সমকালের সভাকক্ষে মঙ্গলবার ‘স্বাধীনতার পাঁচ দশক : নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিলে অতিথিরা -সমকাল

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্তের পর এখনও নারীরা পিছিয়ে। সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও তাঁর ক্ষমতায়ন হয়নি। সংবিধানের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের নির্দেশনা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলে এখনও নিশ্চিত হয়নি ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব। নারীদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে সদস্য, উপজেলা পরিষদে ভাইস চেয়ারম্যান আর সংসদে সংরক্ষিত আসন রাখা হলেও তাঁদের কার্যত ক্ষমতা নেই। বিভিন্ন কমিটিতে রাখা হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তাঁদের রাখা হয় না। তাই নারীর ক্ষমতায়নে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করতে হবে। সংরক্ষিত আসনের বাইরে জাতীয় সংসদ থেকে সব প্রতিনিধিত্বমূলক মূল পদে পুরুষের পাশাপাশি নারীর যোগ্যতায় নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নে তৃণমূল থেকেই কাজ শুরু করতে হবে।

গতকাল মঙ্গলবার সমকালের সভাকক্ষে ‘স্বাধীনতার পাঁচ দশক : নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিলে বক্তারা এসব কথা বলেন। অপরাজিতা-সমকাল আয়োজিত গোলটেবিল সঞ্চালনা করেন দৈনিক সমকালের সহযোগী সম্পাদক শেখ রোকন। সারাদেশ থেকে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জাতীয় সংসদের জনপ্রতিনিধি আর নারী আন্দোলনের কর্মীরা আলোচনায় অংশ নেন।

ডেমক্রেসিওয়াচের নির্বাহী পরিচালক ওয়াজেদ ফিরোজ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, ২০১১ সাল থেকে অপরাজিতা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা তথা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পরিসর এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণের হার ও কার্যকারিতা বাড়াতে কাজ করে আসছে। তারা সারাদেশে বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা তথা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের পক্ষে কথা বলে। ইউনিয়ন পরিষদে নারী সদস্যদের নেতৃত্বাধীন স্থায়ী কমিটিকে সক্রিয় করে নারীদের স্বার্থ ও অধিকার-সংশ্লিষ্ট বিষয় উত্থাপনের পাশাপাশি পরিষদের নারী বাজেট বাড়াতে কাজ করছে। তারা বাধারও সম্মুখীন হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে নারীদের দলীয় মনোনয়নের হার অনেক কম। সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধিরা অনেকে মূলত অলঙ্কার হিসেবেই গণ্য হচ্ছেন। ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন করতে নারীরা যথাযথ সমর্থন ও সহায়তা পান না।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেই সংগ্রামটা নারীকে একটু বেশি মাত্রায় করতে হবে। নারী আর পুরুষ আমরা উভয়েই সমান। কিন্তু নারীদের এ অবস্থা থেকে উঠে আসতে পুরুষের খুব কাছাকাছি থেকে একটু বেশি হাঁটতে হবে। পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতি আর সংসদে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। নারীদের রাজনীতি করার সময় পুরুষদের চেয়ে বেশি নির্যাতিত হতে হয়। কথার আঘাতে তাঁদের বেশি অসুস্থ হতে হয়। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সন্ত্রাসে নারীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ সন্ত্রাস মোকাবিলা করতে নারীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীকে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে।

সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বলেন, ১৯৯৭ সালের শুরুর দিকে ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত নারী সদস্যদের পরিষদের কক্ষেও বসার জায়গা হয়নি। তাঁদের জায়গা ছিল পরিষদের রান্নাঘরে। নারীরা এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এখন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সব জায়গায় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কাজ করছেন। সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীদের কাজ করতে হবে। এ তিনটি সমানভাবে না এগোলে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব না। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংসদীয় আসনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য নারীদের কৌশল নিয়ে কাজ করতে হবে। নির্বাচনে নমিনেশন জমা দিতে হবে, যাতে আমরাও রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী বোর্ডে বলতে পারি– কেন নারীকে নমিনেশন দেওয়া হবে না?

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন আর নারীর অধিকার শুরু হতে হবে তৃণমূল থেকে। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ের নারীরা অনেক পিছিয়ে। তাঁদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা সবচেয়ে বড় কাজ। নারী-পুরুষের সাম্য সৃষ্টি করতে হবে। নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বাইরে সব নির্বাচনে প্রতিনিধিত্বমূলক পদে মনোনয়ন সংগ্রহ করতে হবে। নারীদেরকেও রাজনীতিতে জনগণের পাশে বেশি করে দাঁড়াতে হবে।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি বা মনোনয়ন দেওয়ার সময় অনেক ক্ষেত্রে নারীদের পাওয়া যায় না। অনেক কমিটি করার সময় দলের মহিলাবিষয়ক পদটি পূরণ করার জন্যও নারী পাওয়া যায় না। অষ্টম ও নবম জাতীয় নির্বাচনের সময় তাঁদের দলে এক হাজার মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। কিন্তু সেখানে নারীর সংখ্যা ছিল খুব কম। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা নির্বাচনের জন্য অর্থ পান না। সরাসরি নির্বাচন করার জন্য নারীরা তেমনভাবে এগিয়েও আসেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নারীরা কাজ করছেন। তাঁরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছেন। কিন্তু নারীর কাজকে নারী হিসেবে মূল্যায়নের মানসিকতার জন্য তাঁরা পিছিয়ে পড়ছেন। স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণ নেই। জাতীয় নির্বাচনেও তাঁদেরকে নমিনেশন দেওয়া হয় না। মেধা- মনন ও শিক্ষায় নারীরা এগিয়ে থাকলেও তাঁদেরকে পিছিয়ে রাখা হচ্ছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা আরও বেশি পিছিয়ে।

অপরাজিতার নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, দেশের সংবিধান অনুযায়ী ‎২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারীকে রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু তারা এ সময়ের মধ্যেও তা পারেনি। এখনও নারীদেরকে শুধু গৃহপালিত পশুপালন আর ক্ষুদ্রশিল্প করার কথা বলা হচ্ছে। ডিজিটাল আর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। 

খান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা খন্দকার বলেন, ১৯৯৩ সাল থেকে তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের নিয়ে কাজ করছি। সময়ের সঙ্গে অনেক বাধার মধ্যে আমরা এগিয়ে গেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত নারীদের বিভিন্ন অজুহাতে পিছিয়ে রাখা হচ্ছে। নারী প্রার্থী খুঁজে না পাওয়া, তাঁরা পরাজিত হবেন বা নির্বাচনের খরচ জোগাতে পারবেন না– এ অজুহাতে রাজনৈতিক দলগুলো নমিনেশন দিচ্ছে না। কিন্তু তাদের এ অজুহাত সবই ভুল। আমাদের দেশে অনেক যোগ্য নারী আছেন। রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে তাঁদেরকে এগিয়ে নিতে হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারীকে নমিনেশন দিতে হবে।

সমকালের সহযোগী সম্পাদক শেখ রোকন বলেন, পুরুষদের মনুষ্যত্বের মহিমা ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা না হবে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com