চার বছর ধরে ব্যাংকের লকারে ভারতীয় শহীদদের ১৬৪৯ ক্রেস্ট

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৩ মার্চ ২৩ । ০১:৪১ | প্রিন্ট সংস্করণ

আবু সালেহ রনি

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিশ্বের যে কয়টি দেশ প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়েছিল, তার মধ্যে ভারতের অবদান সবচেয়ে বেশি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার মুখে এক কোটি বাঙালি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র জোগানো, জোরালো কূটনীতি; সেই সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে দুই সহস্রাধিক ভারতীয় সৈন্যের আত্মদান অনন্য নজির। 

এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সম্মাননা দিতে উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ জন্য প্রতিটি ৭০ গ্রাম রুপা দিয়ে ১৬৬৮টি জাতীয় স্মৃতিসৌধের ক্রেস্ট এবং তাঁদের নামে পৃথক সনদ তৈরি করা হয়। সনদগুলো বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় লেখা হয়েছে। এ ছাড়াও সম্মাননাপ্রাপ্ত পরিবারগুলোর জন্য উত্তরীয়সহ আরও ৫ ধরনের উপহার রয়েছে। কিন্তু ১৬৪৯ জন শহীদের ক্রেস্ট ও সনদ বাংলাদেশ ব্যাংকের লকারে পড়ে রয়েছে প্রায় ৪ বছর ধরে। অবশ্য দুই দফায় ২০১৭ সালে ৭ জন এবং ২০১৮ সালে ১২ জন শহীদ পরিবারের হাতে সম্মাননা স্মারকসহ উপহার সামগ্রী তুলে দিয়েছে সরকার।

কবে নাগাদ বাংলাদেশ ব্যাংকের লকারে থাকা ক্রেস্ট ও সনদগুলো শহীদদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে– এ প্রশ্নে মন্ত্রণালয়ের কারও কাছেই সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এ কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।


তিনি সমকালকে জানান, ইতোমধ্যে ১৯ জন শহীদের পরিবরাকে ক্রেস্ট ও সনদ দেওয়া হয়েছে। বাকি পরিবারগুলোর কাছে এসব পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ চলছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ডাক বিভাগের মাধ্যমে পার্সেলে ক্রেস্ট, সনদসহ উপহার সামগ্রী ভারতের দিল্লি হাইকমিশনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুল্ক সংক্রান্ত কিছু কাজ আছে। এসব সামগ্রী বাণিজ্যিকভাবে পাঠানো হচ্ছে না। এ জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কার্যালয় (সিএজি) থেকে বিনা শুল্কে পাঠানোর বিষয়ে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। এখন বাংলাদেশস্থ দিল্লি হাইকমিশনের মাধ্যমে ক্রেস্ট ও উপহার সামগ্রীর ওপর ভারত সরকার যাতে শুল্ক আরোপ না করে, সেই অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। সেটা হলে উপহার সামগ্রী দিল্লি হাইকমিশনে পাঠানো হবে। এর পর ভারত সরকারের কাছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পরিবারের কাছে উপহার সামগ্রী হস্তান্তরের জন্য সময় চাইবে বাংলাদেশ সরকার।

ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর শহীদদের সম্মাননা দিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি করা হয়েছে। জানতে চাইলে কমিটির সদস্য লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির সমকালকে বলেন, কিছু প্রক্রিয়াগত জটিলতা আছে। বাংলাদেশের দিক থেকে সম্প্রতি সেগুলো নিষ্পন্ন করা হয়েছে। শিগগিরই ভারত সরকারের কাছে ক্রেস্টসহ উপহার সামগ্রী হস্তান্তরের জন্য সময়সূচি চাওয়া হবে।

জানা যায়, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বিভিন্ন বাহিনীর ১ হাজার ৯৮৪ জন সদস্যের নাম সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১ হাজার ৭৬৯ জন, নৌবাহিনীর ২০৪ জন এবং বিমানবাহিনীর ১১ জন শহীদ। তবে সবার আত্মীয়স্বজনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এখন পর্যন্ত এক হাজার ৬৬৮ জনের পরিবারকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদেরই পর্যায়ক্রমে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা ক্রেস্ট হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

পরমাণু শক্তি কমিশনে পরীক্ষা : মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা ক্রেস্টগুলো আগে সোনা দিয়ে তৈরি করা হলেও এখন তা রুপা দিয়ে তৈরি হয়েছে। মান যাচাইয়ে ক্রেস্টগুলো পরমাণু শক্তি কমিশনে একাধিকবার পরীক্ষা করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ থেকে ’১২ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৪৫ জনকে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ দেওয়া হয়। এসব সম্মাননা ক্রেস্টে তখন ৩০ ভরি জার্মান সিলভারের (রুপা) তৈরি জাতীয় স্মৃতিসৌধের নকশার ওপর ২২ ক্যারেটের ১৪ গ্রাম সোনার কোট ও লোগো; লক ও কবজায় ৮ দশমিক ৫ গ্রাম সোনার কোটসহ ২২ দশমিক ৫ গ্রাম সোনা ব্যবহার করা হতো। ২০১৪ সালে সম্মাননা ক্রেস্টে সোনা ও রুপা কম দেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর থেকে ক্রেস্টে সোনার ব্যবহার বন্ধ করেছে সরকার।

অবশ্য ইতোমধ্যে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি ও কানাডার প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোকে পৃথক সম্মাননা ক্রেস্ট যা দেওয়া হয়েছে, তাতে ১৯৪ দশমিক ৭৬ গ্রাম ওজনের ২১ ক্যারেট মানের সোনা ব্যবহৃত হয়েছে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া ক্রেস্ট তৈরিতে সোনার ব্যবহার নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে রুপার ক্রেস্ট তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগে সোনা ও রুপার সমন্বয়ে ক্রেস্ট তৈরি করা হতো, যার মূল উপাদান থাকত সোনা। এখন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দেওয়া ক্রেস্টের মূল উপাদান থাকছে রুপা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরমাণু শক্তি কমিশনে ক্রেস্টগুলো পরীক্ষা প্রক্রিয়া তদারকির দায়িত্বে ছিলেন মুখ্য সচিবসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

সম্মাননা পেলেন যাঁরা : স্বাধীনতার ৪০ বছর পর সর্বপ্রথম বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানানোর প্রথম পর্যায়ে ২০১১ সালের ২৫ জুলাই ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা সম্মাননা’ দেওয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধীর হয়ে তাঁর পুত্রবধূ কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় পর্বে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা ৮৩ জন বিদেশিকে ২০১২ সালের মার্চে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’; একই বছরের অক্টোবরে ৬১ জনকে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ৭ জুন মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দেওয়া হয় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীকে। তাঁর পক্ষে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সম্মাননা গ্রহণ করেন। ঢাকায় বঙ্গবভনে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই সম্মাননা তুলে দেন। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ভারতসহ চারটি দেশের ৩৬০ জনকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন ভারতের ২৩৯ ব্যক্তি ও ৯টি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ২৯, পাকিস্তানের ১৭, যুক্তরাজ্যের ১৩ ও  নেপালের ৯ জনকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। সম্মাননাপ্রাপ্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতীয় ব্যক্তিরা হলেন– ভারতের লে. জেনারেল (অব.) প্রয়াত জে এফ আর জ্যাকব, ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ জগজিৎ সিং অরোরা এবং ফিল্ড মার্শাল মানেকশ। বিদেশি বন্ধুদের এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা– এই তিন ক্যাটাগরিতে ক্রেস্ট দেওয়া হয়েছে।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com