গল্প

খামচক্র

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আনোয়ারা আল্পনা

পাঁচ হাজার টাকার নোট যেদিন বাজারে প্রথম এলো, তার পর দিনই এই ঘটনা। যে দেশে পাঁচ হাজারি নোট লাগে, সে দেশে টাকার দাম ছেঁড়া লেপের তুলার মতো। এই ব্লাংকেট, কম্ফর্টারের যুগে লেপ তাও আবার ছেঁড়া, উপমা ঠিক যুতসই হলো না। তবু ঘুষের টাকার সাথে তো আর মেঘের তুলোনা চলে না। কিন্তু কথা না ঘুরিয়ে বলে ফেলা ভালো যে, পাঁচ হাজারি নোট হলে ছোট একটা খামে কয়েক লাখ টাকা এঁটে যায়।
এত স্পষ্ট ঘুষ এর আগে আর পায় নাই রবিউল আলম। মোটের উপর ভালো লোকই সে, অস্পষ্ট দুই একটা রেকর্ড অবশ্য আছে। সে সব না ধরলেও চলে। এবারের ঘুষটা একেবারে সিধা তার হাতেই ধরিয়ে দিয়েছে। এমন কিছুই না, শুধু একটা খবর গোপন করার জন্য এতগুলি টাকা। নিজেকে নানাভাবে বুঝ দিচ্ছে সে। নিজের হাতে কোনো অন্যায় তো করে নাই, শুধু একটা খবর গোপন করেছে। কিন্তু এতগুলি টাকা এখন কী করবে সেটাও চিন্তার বিষয়। টাকার পরিমাণ যদিও তেমন কিছুই নয়, এই হাজার কোটির জমানায় সামান্য এক গ্লাস পানি।
কিন্তু খামটা যেহেতু হাতে এসেই গেছে, ক্যাশ বহন করা রিস্কি, আবার ব্যাংকেও রাখা যাবে না। সবচেয়ে ভালো হয় কিছু কিনে ফেললে। কিন্তু কার জন্য কী কেনা যায়। এটা যদি আল্লার দরবারে পাপের টাকা হিসেবে কাউন্ট হয়ে থাকে তাহলে, এই টাকায় এমন কারো জন্য কিছু কিনতে হবে, যার মাথায় ঠাডা পড়লে রবিউলের কিছুই যায় আসে না। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে পুরো সময়টা চিন্তা করল, আসলে দুশ্চিন্তাই, কে সেই লোক যাকে পাপের টাকায় উপহার কিনে দেওয়া যায়।
২।
 বউটা যখন খেয়ে উঠে নিজের প্লেটটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল, রবিউলের মন বিতৃষ্ণায় ঢেকে গেল। দ্রুত নিজের খাওয়া শেষ করে সে, শেষ হলে আর একটুও বসে না। প্রায়ই রবিউল ফোন রেখে, টিভি বন্ধ করে, হাত ধুয়ে রাতের খাবারের টেবিলে আসতে আসতে তার খাওয়া শেষ হয়ে যায়। বউয়ের খাওয়া ও খেয়ে উঠে যাওয়াসহ প্রায় সবকিছুই বিরক্ত লাগে রবিউলের।
 রবিউলের বউ দিলারা, গত দশ বছর ধরে রবিউলের বউ এবং সাত বছর ধরে একটা সুপার শপের ম্যানেজার। কোনো নড়চড় নাই, না রবিউলের বউ থেকে প্রেয়সী না ম্যানেজার থেকে শেয়ারহোল্ডার।
বউকে বিরক্ত লাগে আগেই জানে রবিউল, আজ ভালো করে খেয়াল করছে। মনে মনে হিসাব করছে, দিলারা চলে গেলে বা মরে গেলে বা অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে তার ঠিক কতোটা লস। হিসেবের ফল তার পছন্দসই হলো, মানে কোনো কিছুতে সে দিলারার উপর নির্ভরশীল নয়। আজ বাসায় শুধু তারা দুইজন। রবিউলের ছয় বছরের ছেলে রুশাদ ও ষাট বছরের মা রুবিনা গেছে, রবিউলের বোনের বাসায়। আজ রাতে ওখানেই থাকবে। ফলে আজকেই মোক্ষম দিন, বউ বিষয়ে একটা সীদ্ধান্তে আসার। আসতে পারলেই খামের টাকাটা দিলারার জন্যই খরচ করতে পারে। অবৈধ টাকা কেন মানুষ স্ত্রীর নামে জমা করে, আজ বুঝতে পারল। নাহলে ঘুষের টাকা আপনজনের জন্য খরচ করতে বুক তো কাঁপে। স্ত্রীর নামে থাকলে দুই সুবিধা; এক, পাপের টাকার শাস্তি যদি আল্লা দেয়, যার নামে টাকা তাকেই দেবে। দিলে ক্ষতি নেই তেমন। আর দুই, যদি শাস্তি না দেয় তাহলে একসময় পাপ কেটে গিয়ে সস্পদ গোটা পরিবারের হবে।
রবিউল টিভি দেখতে দেখতে বাঁকা চোখে দেখল, দিলারা ডাইনিঙয়ের বেসিনে দাঁত ব্রাশ করল। আবারও বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো, কী বিরক্তিকর একটা মহিলা! রাজ্যের ঢিলাঢালা, বিচ্ছিরি রঙয়ের কী একটা জামা পরেছে, জঘন্য লাগছে। স্যান্ডেলে শব্দ করে এ ঘর ও ঘর খানিক হেঁটে এসে টিভির সামনে বসল। রবিউল যা দেখছে, তা-ই খানিক দেখল। একবার মৃদুস্বরে প্রায় শোন যায় না এমনভাবে বলল, ‘ছেলেটা না জানি কী করতেছে!’ রবিউল ঝংকার দিয়ে বলল, ‘ঢং কইরো না, ও বাসায় খুশিতেই থাকে।’ দিলারা তবু বলল, ‘একটা ভিডিও কল দেই? দেখি কী করে?’ রবিউল রীতিমত রেগে বলল, ‘গেছে তো ফুপুর বাসায়, দাদী সাথে তবু তোমার ঢং না করলে চলতেছে না?’ দিলারা আর কথা বলল না। রবিউল মনে মনে বলল, এই মহিলা না থাকলে আমার ছেলেরও কিস্যু হবে না।
দিলারা উঠে আবার কতক্ষণ এ ঘর ও ঘর করল। এক সময় আর সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চিত হয়ে টিভি বন্ধ করে উঠল রবিউল। রোজকার মতো মায়ের ঘরে উঁকি দিল, বুকে একটা ধাক্কার মতো লাগল। ছেলে দাদির সাথে ঘুমায়, আজ দিলারা শুয়ে আছে ছেলের বালিশে, কেমন রুশাদের মতোই কুন্ডুলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ডাকবে কিনা ভাবল একবার। না ডেকে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
৩।
 সকালে উঠে রবিউলের মনে হলো, ঘুম খুব ভালো হয়েছে। বহুদিন পর একা পুরো বিছানায় নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম হয়েছে। দিলারা না থাকলে রোজই এমন আরামের ঘুম হবে। আবারো রাতের চিন্তাই চলে এলো- কী কেনা যায়? সোনার গয়না? মাথা ভালই নড়ে উঠল, গয়নাই ভালো, দিলারা তো করে দোকানদারি, পরবে আর কি, থাকবে, ছেলের বউ পরবে। ছেলের বউ আসতে আসতে গয়নার পাপ কাটা যাবে। না কাটা গেলেও পরের মেয়ের উপর দিয়েই যাবে। তাহলে টাকা আজ নিয়েই অফিসে যাবে, ফেরার পথে গয়নার দোকান হয়ে আসবে। কিন্তু দিলারাকে দিলে কত জোরে চমকাবে, সেটা এখনই দেখতে পেল রবিউল।
 দিলারা উঠেছে আগেই, আজ মঙ্গলবার দিলারার সাপ্তাহিক ছুটি, অন্য ছুটির দিনে আরো পরে ওঠে সে। রবিউল অফিসের জন্য রেডি হয়ে টেবিলে গিয়ে দেখল প্রচুর নাস্তা, রুশাদের পছন্দের অনেক কিছু। রবিউল বলল, ‘ওরা তো বিকালে আসবে, এখনই এসব বানাইছ কেন?’ বলতে বলতেই বেল বাজল।
দিলারা দরজা খুলতেই হুরমুড়িয়ে বাসায় ঢুকল রুশাদ আর রুশাদের ফুপু রুমা। রবিউল বলল, ‘কী রে তোরা এত সকালে! আম্মা কই?’ রুমা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমার ছেলের নাকি চিনচিন করে।’ নিজের পিঠ থেকে ব্যাগ খুলে বাবাকে গাড়ি দেখালো রুশাদ, ‘দেখো বাবা, কত্ত বড় গাড়ি, ফুপি দিয়েছে, দাদি বিকালে আসবে।’ রবিউল খেয়াল করল, মায়ের দিকে তাকাচ্ছে না রুশাদ। দিলারাও রুশাদের দিকে না তাকিয়ে রুমাকে বলল, ‘বসো রুমা নাস্তা করো।’
পিঠে ব্যাথা বলে ছেলেকে কোলে নিতে পারে না দিলারা। খুব বুঝতে পারছে, দাঁড়িয়ে আছে বা খাওয়ার টেবিলের ছোট চেয়ারে বসে আছে বলে কোলে ঝাপিয়ে পড়ছে না রুশাদ। অপেক্ষা করছে, কখন বসার ঘরের বড় সোফাটায় গিয়ে বসবে মা। যেকোনো ভাবে মাকে বড় কোনো জায়গায় বসিয়ে দিতে হবে।  এদিকে রুশাদের কান্না পেয়ে যাচ্ছে। সবার সামনে মায়ের কোলে উঠে কেদে ফেললে প্রেস্টিস একটুও থাকবে না। ফুপিই খ্যাপাবে, কী খুব নাকি বড় হইছিস! ওহ কোনো একটা বুদ্ধি কেন আসছে না মাথায়! সামনেই গাজরের হালুয়া দেখে মনে পড়ল, গাজর খেলে বুদ্ধি খোলে! হালুয়া এক চামচ তুলে মুখে দিয়ে বলল, আমিও চা খাবো। দিলারা মনে মনে হাসল, দেখো কেমন বুদ্ধি, চা খেলে বসার ঘরে গিয়ে মায়ের পাশে বসা যায়। চারজনের চা নিয়ে দিলারা বসার ঘরের গিয়ে ডাবল সোফায়ই বসল। রুমা আর রবিউলও গিয়ে চা নিল। রুশাদ এবার মায়ের পাশে গিয়ে বসল। এক চুমুক দিয়েই চা নামিয়ে রাখল রুশাদ, দিলারাও এক চুমুক দিয়ে চা নামিয়ে রেখে রুশাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফুপ্পিবাসায় অন্নেক মজা হয়েছে বাবা?’
এতক্ষণের সব বাঁধ ভেঙে পড়ল, রুশাদ মায়ের কোলে ঝাপ দিল। ফোপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘অনেক মজা হয়েছে আম্মু, শুধু তোমার জন্য চিনচিন!’ দম নিয়ে বলল, ‘চিনচিন না করলে আরো থাকতাম।’ রুমা হো হো করে হেসে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার ছেলে ভোরবেলা আমাকে ঘুম থেকে তুলে বলছে, ‘ফুপ্পি, আম্মুর জন্য চিনচিন।’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে মায়ের কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল রুশাদ। দেখে মনেই হচ্ছে, রাতে ঘুমায় নি। রবিউলের হিসেবে গণ্ডগোল লেগে গেল। এই যদি হয় ছেলের অবস্থা, তাহলে ঘুষের টাকায় কিছুতেই দিলারার জন্য কিছু কেনা যাবে না। এত চিন্তাভাবনা করে নেওয়া সীদ্ধান্ত এভাবে ধ্বসে পড়তে দেখে হতাশ লাগল। উফ আবার শুরু থেকে ভাবতে হবে।  
৪।
 রবিউলের শান্তি মান্তি সব নষ্ট হওয়ার যোগাড়। আজকাল খবরই সবচেয়ে দামী জিনিস। খবর প্রকাশ অথবা গোপনের উপরেই দুনিয়া টিকে আছে। নাকি আসলে টিকে নাই, এইটাই ধ্বংস? কিন্তু টাকাগুলি দিয়ে কী আসলে করা যায়, সেই সীদ্ধান্ত আজকেই নিতে হবে। টাকা বিদায় করে তবে কাজে মন দেওয়া যাবে। যে খবরটা গোপন করার জন্য এই বিপদ ঘাড়ে চেপেছে, সেই খবর যদি কখনও ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে ঘুষদাতা টাকা ফেরত চাইতে পারে। খরচ এমনভাবে করতে হবে যেন, ফের বিক্রি করা যায়। ফলে দান করা যাবে না। জ্ঞান কেনাও যাবে না। একসময় খুব বইয়ের নেশা ছিল। টাকা হাতে পেয়ে একবার মনে হয়েছিল, অনেক বই আর বুকশেলফ কিনে ফেলা যায়। কিন্তু এসব আবার বিক্রি করতে গেলে মূল আর ফেরত আসবে না।
দুপুর পর্যন্ত এটুকুই চিন্তা করতে পারল রবিউল। কোনোটাই কাজের না, সব বাজে চিন্তা। আজ খিদাও পেল না। ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ চা নিয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন বাজল। ছোটবেলার বন্ধু হারুন ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘কেমন আছিস দোস্ত?’ রবিউল উদাস হয়ে বলল, ‘আর থাকা! তুই কেমন? ব্যবসাপাতি কেমন চলতেছে?’ হারুন থাকে গ্রামে, মুরগির খামার, মাছের খামার এসব করে। খুব অনেস্ট ছেলে, দেশি মুরগি, দেশি মাছ ফলানোর চেষ্টা করে। আজেবাজে জিনিস খাইয়ে মোটাতাজা করে না। বাড়ি গেলেই দেখা করতে আসে মাছ, মুরগি নিয়ে। শিশুর মতো বলে, ‘মানুষের খাওনে কি বিষ দেওয়া যায়; ক?’ বেছে বেছে আজকেই হারুনের ফোন আসতে হলো! ঘুষ পকেটে নিয়ে সবচেয়ে অনেস্ট বন্ধুর ফোন ধরতে হলো! হারুন বলল, ‘হ্যালো শুনতেছিস?’ রবিউলের হুঁশ ফিরল, ‘হু বল।’ হারুন অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘একটা জমি বেচব, কিনবি? খুব দরকার!’ এক মুহূর্ত রবিউলের মনে হলো, এটা ভালই, জমি কিনলে ফের বিক্রিও করা যাবে, মূলের চেয়ে বেশি দামেই যাবে। জমির দাম রোজ বাড়ে। আর গ্রামের জমির দাম এখনও ঢাকার মতো মাত্রাছাড়া নয়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো- হায়রে সবচেয়ে অনেস্ট বন্ধুর কাছে যাবে ঘুষের টাকা! বন্ধু সেই টাকায় না জানি কী কী অনেস্ট কাজ করবে। বন্ধুরে শাস্তি দিতে গিয়ে, শাস্তির ফেরেশতা ফিরে এসে যে দিয়েছে আর যে নিয়েছে তাদেরই খুঁজে বের করবে। রবিউল বলল, ‘নারে দোস্ত আমার কি অত টাকা আছে?’
৫।
 বিকালের দিকে রুবিনার ফোন পেয়ে অবাক হয়ে বলল, ‘কী হইছে আম্মা? বাসায় আসছো?’ রোবিনা আমতা আমতা করে বলল, ‘হু আসছি।’ রবিউল উতলা হয়ে বলল, ‘কিছু বলবা?’ রুবিনা বলল, ‘তোর হাতে টাকা পয়সা আছে?’ রবিউলের গলা শুকিয়ে গেল। আম্মা কি মনে মনে জেনে গেছে ঘুষের টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরছে সে? চোরের মতো বলল, ‘কেন আম্মা?’ রুবিনাও চোরের মতো বলল, ‘জাহিদের কিছু টাকা দরকার, ব্যবসার কী একটা কাজ আটকে গেছে, ধারই চায়, পরে শোধ করে দিবে।’ জাহিদ, রবিউলের বোন সুমার স্বামী। রবিউলের মনে উল্লাসের মাইক বেজে উঠল- ইউরেকা! যৌতুক! এই তো ঘুষের টাকার উপযুক্ত ব্যবহার! খুশি মনে বলল, ‘দশে হবে?’ রুবিনাও খুশি হয়ে বলল, ‘হবে। রাতে আসতে বলব?’ রবিউল নাচতে নাচতে বলল, ‘বলো’। কমোডে গিয়ে আরাম করে বসল, কে আর কান পাতবে এখানে? বিড়বিড় করে বলল, ‘শালার পরের ছেলে জাহিদ, যা হবে ওর হবে, সুমাও মনেহয় ভালো টালো বাসে না, বাচ্চাও নাই যে এতিম হবে। কী জানি বালছালের ব্যবসা করে, শালা টেনশনে হাগা বন্ধ হয়ে গেছিল। ঘুষের টাকা কেমনে হজম করে মানুষ, ওফ!’
রবিউলের মন থেকে দশমণি পাথর নেমে গেল। বাসায় ফেরার পথে নিজের বেতনের টাকায় ছেলের জন্য আর মায়ের জন্য ফল কিনলো, দিলারার জন্য ফুল। ঘুষের টাকায় গয়না কিনে দিতে চেয়ে, বেচারীর উপর খুব অবিচার করা হয়েছে, সেই অপরাধবোধ থেকে ফুল। মনে মনে ঠিক করল, আজ একেবারে সিনেমার মতো করে চুমু খেতে হবে। দুই এক লাইন কবিতাও শোনাতে হবে।
বাসার দিকে যেতে যেতে একবার হারুনের কথাও মনে হল, কী না জানি দরকার। হারুন তো জমি বেচার ছেলে না। কারো অসুখ বিসুখ নাতো। কীভাবে এসব বিস্তারিত জিজ্ঞেস না করে শুধু  টাকা নাই বলেছে! সর্দি লেগে জ্বরের মতো এখন অবাক হতে গিয়ে খারাপ লাগা প্রবল হয়ে উঠল। ফোন করল হারুনকে- দুপুরেই কথা হয়েছে, তবু এই সন্ধ্যাবেলা আবারও জিজ্ঞেস করল- ‘কেমন আছিস? টাকা কেন দরকার? কোনো বিপদাপদ, কারো অসুখ বিসুখ? বউবাচ্চা ভালো? খালাম্মা খালু?’ এতগুলো কথা এক দমে বলে কেমন হাপাতে লাগল রবিউল। হারুণ বলল, ‘সবাই ভালো, টাকা একটা গোপন কাজে দরকার, তোকে বলবোনে একসময়, এখন রাখলাম দোস্ত।’ মনে মনে কাকে যে গালি দিল, একটা খারাপ গালি- তারপর প্রায় শব্দ করেই বলল, শালা হারুনেরও গোপন কাজ আছে!
মেইন রোডে নামিয়ে দিয়ে গেছে অফিসের গাড়ি। বাসা পর্যন্ত শাখা রাস্তায় দশ মিনিটের হাটা পথ তারপর গলিতে এক মিনিট। এতক্ষণে হয়তো জাহিদ এসে গেছে, সুমাও হয়তো এসেছে। বাসায় হয়তো আজ রাতে বিশেষ খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। রবিউল মনে মনে ভাবল, আম্মার জামাইয়েরা এলে আম্মা পুরা একশন কুইন! দিলারাও আজ বাসায়, হয়তো ওকে পাঠিয়েই এলাহী বাজার করিয়েছে। পেট পুরে খেয়ে দেয়ে যৌতুক নিয়ে ফিরে যাবে জামাই। বেল বাজাতে সুমাই দরজা খুলল- আহ্লাদ করে বলল, ‘কেমন আছ ভাইয়া?’ রবিউল ধুম করে বলল, ‘জাহিদ আসে নাই?’ এক মিনিটে তার মনে হল, যদি জাহিদ না এসে সুমাকে পাঠিয়ে থাকে, তাহলে টাকা দিতে হবে সুমার হাতে! গজব তাহলে আদরের বোনের মাথায় পড়বে! কিন্তু সুমা হেসে বলল, হ্যা আসছে। ওহ যাক! মনে মনে হাঁপ ছাড়ল রবিউল।
খেতে বসে ঠিকই দেখল, এলাহী কারবার। রুশাদ হেসে বলল, আমি আর আম্মু আজ বাজার করেছি। রুশাদের খাবার আর রুশাদকে নিয়ে দিলারা টিভির সামনে গিয়ে বসল। হয়তো বুঝতেই পেরেছে, খাওয়ার টেবিল আজ বিশেষ আলোচনা হতে যাচ্ছে। জাহিদ খেতে খেতে বলে ফেলল, বসের ছেলে কী নাকি এক আকাম করেছে, খবর আটকাতে তাকেই টাকা খরচ করতে হয়েছে, এখন নিজের মাল খালাশের ঘুষের টাকায় টান পড়েছে! রবিউল মনে মনে বলল, ‘ওহ হলি জিসাস!’ ড্রয়িং ডাইনিঙয়ের মাঝখানে কিছু নেই, শোনা যাচ্ছে, দিলারা ছেলেকে ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে লিটল প্রিন্স গল্প বলছে, খাওয়ার টেবিলে কী হচ্ছে সেদিকে মন নেই তাদের।

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com