
সংযম
প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৪ মার্চ ২৩ । ০০:৫১ | প্রিন্ট সংস্করণ
সম্পাদকীয়
বৎসর ঘুরিয়া আসিয়াছে রমজান মাস। বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী শুরু হওয়া এই মাসকে আমরা স্বাগত জানাই। ত্যাগ ও সংযমের শাশ্বত আবাহনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা শুভেচ্ছা জানাই সমকালের পাঠক, লেখক, শুভানুধ্যায়ীদের। সংযম সাধনের মাসটি আসিবার পূর্বেই দেশে আমরা দেখিয়াছি বিপরীত চিত্র। ফি বৎসরের মতো এবারও দ্রব্যমূল্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। সরকার রমজানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি না পাইবার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাজারে উহার প্রতিফলন নাই। সমকালের বুধ ও বৃহস্পতিবার উভয় দিনের শীর্ষ প্রতিবেদনে যে বাস্তবতা প্রতিফলিত, উহা হতাশাজনক। বুধবারের প্রতিবেদন বলিতেছে, সংযমের রমজানেও ঢালাও অসংযম। একদিকে বিত্তবান ক্রেতার অতিরিক্ত বাজারের প্রবণতা, অন্যদিকে ব্যবসায়ীর বেশি মুনাফার চিন্তা– কোনোটিতেই রমজানে শিক্ষার প্রতিফলন দেখা যাইতেছে না। আমরা জানি, রোজার মানে শুধু দিনভর অনাহারে থাকা নয়। ভোগবিলাস ত্যাগ করিয়া খোদাভীতি অর্জনের মধ্যেই রমজানের সফলতা।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের উপর বিশেষ ছাড় দেওয়া হইলেও আমাদের ব্যবসায়ীরা ইহাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করিয়া থাকেন। সমকালের বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদন যথার্থই বলা হইয়াছে– রোজায় ক্রেতার হাঁসফাঁস, সংসারের ফর্দে কাটছাঁট। দীর্ঘদিন ধরিয়া বাজারে এমনিতেই সুখবর নাই। তদুপরি রমজান উপলক্ষে বাজারে সবজিসহ কয়েকটি পণ্য চড়া মূল্যে বিকাইতেছে। দীর্ঘদিন ধরিয়াই চাউলের বাজার অস্থিতিশীল। চিনি, আটা, ময়দা, খেজুর, মাছ-মাংস এবং তেলেও ক্রেতার স্বস্তি নাই। সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তেল ও চিনির পর্যাপ্ত মজুত থাকিলেও এই দুই পণ্যের মূল্য হ্রাস পাইতেছে না কেন? ব্রয়লার মুরগির মূল্য কিছুটা নাগালে থাকিবার কারণে ইহা গরিবের আমিষ বলিয়া পরিগণিত। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, সেই মুরগিও এখন নাগালের বাহিরে। স্বস্তির বিষয়, বৃহস্পতিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর পোলট্রি খাতের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলির শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠক করিবার পর কোম্পানিগুলি মুরগির মূল্য হ্রাস করিবার ঘোষণা দিয়াছে। শুধু ঘোষণা নহে; বাজারে উহার প্রতিফলন দেখিতে প্রত্যাশী। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হইতে রমজান মাস জুড়িয়া সুলভ মূল্যে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় দুধ, ডিম ও মাংস বিক্রয়ের যে উদ্যোগ লওয়া হইয়াছে, তাহা ধন্যবাদার্হ। এত দিন ট্রাক-সেলে সুলভ মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয় করা হইলেও বর্তমানে বন্ধ; যাহার সুবিধা শুধু ফ্যামিলি কার্ডধারীরাই পাইতেছেন। আমরা মনে করি, ট্রাক-সেলের প্রয়োজনীয়তা এখনও নিঃশেষ হয় নাই।
অস্বীকার করা যাইবে না– বৈশ্বিক সংকটের প্রভাবও বাজারের উপর পড়িয়াছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানির যে সংকট, তাহা হইতে উত্তরণ এখনও পুরাপুরি হয় নাই। গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে ৫০ সহস্রাধিক মানুষ নিহত হইয়াছে। আমাদের প্রত্যাশা, এই রমজান তথাকার বাস্তুচ্যুত এবং যুদ্ধপীড়িত ইউক্রেন, ইয়েমেন, ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতার বাতাবরণ তৈরি করিবে।
আমাদের প্রত্যাশা, রমজানে ত্যাগ ও সংযমের চর্চায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই ভূখণ্ডের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনও আলোকিত হোক। শুধু ব্যক্তিগত ত্যাগ ও সংযম নহে; রমজানের অবশ্য কর্তব্যগুলো পালনের মধ্য দিয়া বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী বিশ্বের অন্যান্য মুসলমানের সঙ্গে যেরূপ যোগসূত্র নবায়ন করিয়া লয়, তাহার সামষ্টিক তাৎপর্যও ব্যাপক। রোজা অনুভব করায় ক্ষুধার্ত ও বঞ্চিত মানুষের কষ্ট। শিক্ষা দেয় ভোগ না করিয়া বিলাইয়া দিবার আদর্শ। বিত্ত-বৈভবের গরিমার বদলে স্রষ্টার দরবারে আনুগত্য প্রকাশ করিবার মহিমাও শিক্ষা দেয় রমজান। দুঃখজনক হইলেও সত্য, রমজানের ত্যাগ ও সংযমের শিক্ষা অনেকের জীবনেই প্রতিভাত হয় না। সহনশীলতা, সৌহার্দ্যের পরিবর্তে অসহিষ্ণুতা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়।
সর্বশেষ, এই আত্মোপলদ্ধি দরকার, রমজান মাস আসিলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা কেন বাড়াইব? বাজারের চাপে রোজাদার কেন অস্বস্তিতে পতিত হইবে? প্রতি বৎসর এইভাবে চলিতে পারে না। রোজার শিক্ষা সামষ্টিকভাবে আমাদের জীবনে প্রতিফলিত না হইলে বাজার কিংবা সমাজে তাহার ইতিবাচক ফল দেখিব না। সত্যিকার অর্থে সর্বত্র আমাদের সংযমের বোধ জাগ্রত হোক– ইহাই প্রত্যাশা।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com