
বৈশ্বিক ষাট ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়
প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৬ মার্চ ২৩ । ০৫:৪২ | প্রিন্ট সংস্করণ
শুভ বসু

বাংলাদেশ উত্তর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দক্ষিণ এশিয়াতে একমাত্র উত্তর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ফলে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষার বন্ধনের মধ্য দিয়ে যে নতুন পরিচিতিবোধের জন্ম, তা নতুনভাবে জাতিরাষ্ট্র কল্পিত সমাজের ইঙ্গিত বহন করে। এই ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র ঔপনিবেশিকতাবাদের চিন্তা থেকে মুক্তির দিকে যাত্রা করে। সেই সঙ্গে ভারতবর্ষের ঐক্য যে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের ফল এবং ভারত যে একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র, তার উপলব্ধিও গড়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে যা মুসলিম দুনিয়ায় অন্যত্র হয়েছে– তুরস্ক, ইরান, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক রাষ্ট্র, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় তার অগ্রদূত। তাই বাংলাদেশের ধারণা একটি উত্তর ঔপনিবেশিক বিপ্লবের বহিঃপ্রকাশ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বিশ্বের বাজারে বাণিজ্যিক কৃষিপণ্যের বিক্রি হলে পূর্ববঙ্গের মুসলমান পাটচাষিরা হাতে পয়সা পেতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে মুসলমান গ্রামীণ জোতদার শ্রেণির হাতে টাকা আসে। তারাও শিক্ষায় বিনিয়োগ করে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণির সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে তারা প্রমিত বাংলা ভাষায় লেখালেখি শুরু করে। কলকাতায় তৈরি হয় নতুন সংবাদমাধ্যম মোসলেম ভারত, নবযুগ, লাঙল প্রভৃতি পত্রিকা। এখানে বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যচর্চার দুটি ধারা তৈরি হয়। একদিকে নজরুল ইসলাম এবং মুজফ্ফর আহ্মদ শ্রেণিসংগ্রামের এবং শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের কথা বলেন এবং উদার সমন্বয়বাদী সাহিত্যের সৃষ্টি করেন। নজরুল এক আপসহীন সংগ্রামী আবার প্রেমিক, ভক্ত; আবার মুক্তমনা চিন্তক ও কবি। বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে বিরল চিন্তক। বাংলা সাহিত্যে সেই যুগে যে গণতন্ত্রীকরণ হয়েছিল, সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে সাহিত্যচর্চা হয়েছিল, তাতে নতুন করে বাঙালি মুসলমান সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছিল। একই সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈতমল্ল বর্মণ পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনের ছবি তুলে ধরেন। আবার ঢাকার বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে আধুনিকতা, মুসলমান জীবন, অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরে মুসলিম জাতীয়তাবাদী লেখকরা মুসলমান বাঙালির কৃষ্টিচর্চার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন।
চল্লিশের দশকের মন্বন্তরের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মধ্যে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁস সোসাইটি। সেখানে মনে করা হয়, আয়ারল্যান্ডের মতো করে পূর্ব বাংলার পুঁথি সাহিত্য নিয়ে তাঁরা শুরু করবেন জাতীয় জীবনের নতুন যাত্রা। অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সংস্কৃতির আধুনিকায়নের মধ্যে বাংলায় মুসলমানকে বাদ দেওয়ার যে প্রয়াস ছিল, তার পরিবর্তে বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে মুসলমান সমাজকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসী হয় এই আন্দোলনে। একদিকে কৃষকের মুক্তি, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ— এই দুই ছিল পূর্ব বাংলার এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের স্বপ্নের ভিত্তি। যদিও সেদিন প্রখ্যাত পণ্ডিত আবুল হাশিম এবং শরৎ বসু, যিনি ছিলেন প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী বীর সুভাষ বসুর অগ্রজ, তাঁরা অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন; কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। তবুও বলা যায়, দেশভাগের বেদনা সত্ত্বেও ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পূর্বশর্ত। চল্লিশের দশক একদিকে ছিল বাঙালির জীবনে অভিশপ্ত দশক, আরেকদিকে ছিল মুক্তির সংকেত। স্বাধীনতা নিকটে কিন্তু দুর্ভিক্ষ ও দাঙ্গায় বিধ্বস্ত দেশ। পূর্ব পাকিস্তান স্থাপনে বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের কাছে মনে হয়েছিল পাকিস্তান হবে শাশ্বত ঈদের দেশ।
কিন্তু পাকিস্তান গঠনের ফলে একদিকে শুরু হলো বাংলাভাগের যে আর্থিক বিপর্যয় তার সূচনা। নতুন সীমান্ত দিয়ে টাকার মূল্যমান নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের বিবাদের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। পূর্ব বাংলার ঘনবসতির যে জীবন, তার থেকে মুক্তির খোঁজে মানুষ আসাম চলে যেত, তাও বন্ধ হয়ে যায়। হিন্দু জমিদাররা পূর্ব বাংলা থেকে পুঁজি নিয়ে বন্ধুদেশ ভারতে চলে আসেন। আবার শুরু হয় খাদ্য পাচার আন্তর্জাতিক সীমানা দিয়ে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সালে এই খাদ্য সংকট এত তীব্র আকার ধারণ করে যে তা প্রায় দুর্ভিক্ষের পর্যায়ে চলে যায়। অন্যদিকে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক, আন্দোলন এবং প্রতিবাদ। ঔপনিবেশিক আমলে বাঙালি মুসলমানকে বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বিদায় দেওয়ার প্রয়াস পাকিস্তান আমলেও মুসলমানের সংস্কৃতি উত্তর ভারতের আশরাফ সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করা হয়। সর্বোপরি পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিণত হয় প্রশাসনিক রাষ্ট্রে, যার মধ্যে সামরিক বাহিনী এবং আমলাতন্ত্রের প্রভাব থাকলেও সাধারণ মানুষের উপস্থিতি কম ছিল। তার ওপরে ছিল সাম্প্রদায়িক প্রচার এবং বিভিন্ন ধরনের সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ। এবং পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু বাংলাভাষী জনগণকেও এই সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক জোট সংখ্যালঘুতে পরিণত করে।
প্রশাসনিক রাষ্ট্রের এই আর্থিক ও সামাজিক শোষণের ফলে বাংলাদেশে সেসময়ে কোনো পুঁজিপতি শ্রেণি গড়ে ওঠেনি এবং কোনো সামরিক বা আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়নি। সবই জায়মান অবস্থায় থেকে যায়।
পাকিস্তানের সামরিক অভ্যুত্থানের আবার একটি বৈশ্বিক রূপ ছিল। বিশ্বের ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সামনে দুটি আশু কর্তব্য ছিল– ক্রমবর্ধমান সমাজতান্ত্রিক জগৎকে ঠেকিয়ে রাখা এবং বিশ্বে নতুন যে উত্তর ঔপনিবেশিক জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে, তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়ে তার মধ্যে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটানো। সেই বিকাশের সঙ্গে সম্পত্তির পুনর্বণ্টনের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রবৃদ্ধির হার হলো আর্থিক উন্নতির লক্ষণ। এই ধারণার ফলে শ্রেণি ও আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস করার কোনো চাপ নেই। আইয়ুব খানের সামরিক জোট বুনিয়াদি গণতন্ত্রের নামে যে শ্রেণিগত সামাজিক ঐক্য স্থাপন করেছিল, তার মধ্যে ছিল উদ্ভিন্ন একচেটিয়া পুঁজিবাদী এবং ধনী কৃষক। কিন্তু ছিল না উদ্ভিন্ন মধ্যবিত্ত বা শ্রমিক শ্রেণি বা গরিব এবং মধ্যম কৃষক। তাই তাদের প্রতিবাদই হয়ে ওঠে নতুন গণতান্ত্রিক সমাজ স্থাপনের অঙ্গীকার।
এই সময় আবার বাংলায় বিকাশ হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির, সাহিত্যের, কবিতার সংস্কৃতি আন্দোলনের। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লাল সালু’ এবং পরে ‘চাঁদের অমাবস্যা’, আবু ইসহাকের ‘সূর্য্য দীঘল বাড়ি’ বা শহীদুল্লাহ কায়সারের ছোটগল্প ‘সারেং বৌ’ এবং সত্যেন সেনের ‘পদচিহ্ন’ বাংলা গদ্য সাহিত্যের মাত্রা পরিবর্তন করে দেয়। কবিতার ক্ষেত্রে শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদ থেকে শুরু করে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এক বিরাট সৃষ্টির জোয়ার আসে। বাংলা ছায়াছবির জগতে ‘রূপবান’-এর বাণিজ্যিক সাফল্যের পরে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ নিয়ে আসে বাণিজ্যিক সাফল্য। লোকগাথা থেকে জহির রায়হানের হাত ধরে ছায়াছবি হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতীক। সেই সঙ্গে জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছবি, তাঁর ফিলিস্তিনের উদ্বাস্তুদের জীবনের স্কেচ বা নবান্ন বা ’৭০ সালের বিধ্বংসী ঝড়ের পরে মনপুরা হয়ে ওঠে শিল্পের এক অপূর্ব সম্ভার।
সেই সঙ্গে সামরিক আমলাতান্ত্রিক জোট যে রকমভাবে বিশ্বের ঠান্ডা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ইঙ্গ-মার্কিন প্রতীচ্যের শক্তির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে, সে রকমভাবে পূর্ব বাংলায় ষাটের দশকের বৈশ্বিক প্রতিবাদী ঘরানার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে দেখা যায়। প্যাট্রিস লুলুম্বা থেকে আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধ, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব– সবেরই অনুরণন শোনা যায় বাংলার সাহিত্য-শিল্প-রাজনীতিতে। ভিয়েতনামের যুদ্ধের প্রতিবাদে সংঘটিত হয় মিছিল। ১৯৫৭-এর কাগমারী সম্মেলন থেকে শুরু করে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন এবং ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুথান, তার আগে মওলানা ভাসানীর হাভানা ভ্রমণ এবং ত্রিমহাদেশীয় সম্মেলনে যোগদান– সবেতেই ষাটের দশকের বিপ্লবের ছায়া পাওয়া যায়। ১৯৬৮ ও ১৯৬৯-এর প্যারিস, প্রাগ, মেক্সিকো শহরে দ্রোহের সঙ্গে ইসলামাবাদ, ঢাকা এবং কলকাতায় ছাত্র ও শ্রমিকদের বিপ্লবের ছোঁয়া থাকে। ১৯৬৯ সালে গ্রামাঞ্চলে কৃষক সভার মধ্য দিয়ে মওলানা ভাসানী সেই বিপ্লব ছড়িয়ে দেন গরু চুরির বিরুদ্ধে আন্দোলনে। তবে বিশ্বের ঠান্ডা যুদ্ধের ছায়াও বাংলার প্রতিবাদী আন্দোলনে এসে পড়ে। চীন-সোভিয়েতের দ্বন্দ্ব বাংলার অভ্যন্তরে বামপন্থিদের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের সূচনা করে। চীনের বিশ্বনীতির প্রশ্নে চীনপন্থি বাম গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নানা ভাঙনের সৃষ্টি করে। মওলানা ভাসানীর ইসলামী সমাজতন্ত্রও বামপন্থিদের সমর্থন পায় না। ফলে প্রতিবাদী আন্দোলনের মধ্যে পরিবর্তন আসে।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নে ১৯৬৬ থেকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যে ছয় দফা দাবির আন্দোলন তোলে, পূর্ব বাংলার স্বাধিকারের প্রশ্নে তা জনপ্রিয় হয়। ১৯৬৯ সালের গণবিক্ষোভের ফলে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন পূর্ব বাংলার গণ-আন্দোলনের কণ্ঠস্বর। তাঁর প্রতীকী উপস্থিতি এবং ভাসানীপন্থি ন্যাপের নির্বাচন বয়কটের ফলে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জনসাধারণের আস্থা অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের ছয় দফা ছিল ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের বাঁচার উপায়, যাতে ছাত্রদের ১১ দফা আরও বলিষ্ঠতা দেয়। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সমর্থনপুষ্ট ইয়াহিয়া খান নামিয়ে আনেন এক বীভৎস অত্যাচার। পূর্ব বাংলার ভেতরে ও বাইরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে যে শ্রমিক, কৃষক, সৈনিক এবং ছাত্ররা গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলে, তার ফলেই মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রশক্তির জয় সম্ভব হয়। ষাটের দশক তাই বাংলাদেশের মুক্তির দশক। বৈশ্বিক বিপ্লবের পদধ্বনির ফল।
শুভ বসু: কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। তাঁর সাম্প্রতিক বই হলো, ইনটিমেশন অব রেভ্যুলুশন: গ্লোবাল সিক্সটি’জ অ্যান্ড দি মেকিং অব বাংলাদেশ।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com