জনগণই ছিল সার্বভৌম

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৬ মার্চ ২৩ । ০৬:৩১ | প্রিন্ট সংস্করণ

নাসিম আখতার হুসাইন

১৯৭১-এর মার্চে যদি ফিরে যাই, দেখতে পাই তখন জনগণই ছিল সার্বভৌম। মানে তখন সার্বভৌম বলে যদি কিছু থাকে, তা ছিল জনগণ। সেই সার্বভৌম জনগণ বলতে পেরেছে যে আমাদের অধিকার আছে এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে সেই অধিকারগুলো পাইয়ে দেওয়া। তারা চিৎকার করে বলতে পেরেছিল, এ দেশ তোমার, এ দেশ আমার– এ দেশ সকলের। যে কারণে দেশটির নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হতে পেরেছে। জনগণই এই রাষ্ট্রে সর্বভৌম হওয়ার কথা, মালিকানা তাদেরই থাকার কথা।

সেই জায়গা থেকে ২০২৩ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত এটি একটি জার্নি। এখানে এসে আমি দেখতে পাই রাজনৈতিক মঞ্চে আর জনগণ নেই, তাদের কথা নেই। সেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে ক্ষমতা, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো তাদের স্বার্থ উদ্ধারে যা কিছু করা দরকার তা–ই করার জন্য তৈরি থাকছে। সংঘর্ষ–সহিংসতা বাড়ছে।

এখন কী নেই তাহলে? কীসের জন্য হাহাকার করবো? যা নেই তা হচ্ছে এই যে, তারা কেউ যেন ভাবতেই পারছে না যে কীভাবে সকলের কল্যাণ, সকলের ভাল থাকা কীভাবে আসতে পারে। এই প্রশ্ন উঠতেই পারছে না এবং উত্তরও খোঁজার কোনো আবশ্যকতা নেই। তখন আমি শিক্ষক হিসেবে চেষ্টা করি বুঝতে যে কী ঘটলো। ঘটলো তো এটাই যে যেখানে জনগণ ছিল সার্বভৌম, সেখানে তারা হয়ে গেল প্রান্তিক। ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে গেল রাজনীতি, জনগণকেন্দ্রিক নয়। আমরা বলি যে রাজনীতি হয়ে গেছে ক্রিমিনাল এক্টিভিটি, ক্রিমিনালাইজেশন ইত্যাদি। একটা শূণ্যতা তৈরি হয়ে গেছে, রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের বিপুল দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। এই শূণ্যতার মধ্যেই কিন্তু স্বার্থ গোষ্ঠীগুলো তাদের কর্মকান্ড অনয়াসে চালাতে পারছে।

যদিও বলা হচ্ছে জনগনের জন্যতো উন্নয়ন হচ্ছে, শান্তি–শৃঙ্খলা রক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু মানুষের জন্য এত সামান্য উপস্থিতি তো রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না। কারা তাহলে সে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে? প্রধানত আছে ব্যবসায়ীরা, প্রধানত আছে রাজনৈতিক এলিটেরা। এবং আছে আমলাতন্ত্র। সবকিছু আছে কিন্তু জনগণের আওয়াজটাই নেই। জনগণের যদি বিকল্প চিন্তা বা বিরোধিতাও থাকে তাহলে তাকে নীরবতায় বিলীন হয়ে যেতে হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অথবা মানুষের কল্যাণের জন্য যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে সেই রাষ্ট্রের যে মূল স্পিরিটটি সেটি কিন্তু নেই। কিন্তু যাত্রাটা তো ৪টা মূল নীতি নিয়ে শুরু হয়েছিল। রাষ্ট্রের মূল নীতিতে যদি গণতন্ত্রও থাকতো তাহলে কিন্তু যারা সরকার পরিচালনা করছে তাদের সঙ্গে জনগণের যোগসূত্র থাকতো। সেটা করে নির্বাচন, সেটাই প্রক্রিয়া। সেটা কি আছে?

আসলে এ ধরনের রাষ্ট্রের রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্র হতে হবে। রাষ্ট্রের অধিবাসীরা সাংস্কৃতিকভাবে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতেই পারে। একটা কাল্পনিক কমিউনিটি তৈরি হতেই পারে। এটি হয়েছে বারবার। কিন্তু সেটি হয়েছে কারণ মানুষ অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে চেয়েছে। কারণ মানুষ একটা নিরাপদ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিসর পায়। একটা জায়গা–জমি, একটা অস্তিত্ব, একটা বসবাসযোগ্য জীবনধারা যেন পায়। কিন্তু জাতীয়তার নামে যে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে সেটা তো হওয়ার কথা ছিল না। একাত্তরেও তো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, বিভিন্ন জাতি–ধর্ম ছিল, কিন্তু সেগুলোকে মূখ্য না করে ঐক্য গড়ার প্রচেষ্টাই বড় ছিল।

কিন্তু এখন সেই বিভাজনগুলোকেই বড় করে তোলা হচ্ছে নিজেদের স্বার্থে। মানুষ এতো বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে এতো ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে যেন কোনোকিছুই আর রক্ষা করা সম্ভব নয়। ঘর যেন ভেঙে পড়বে এমন একটি অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আর সমাজতন্ত্র? আমি বলব সমাজতন্ত্রতো দূরের কথা তার উল্টোটি বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে আধিপত্যশীল একটা গোষ্ঠী এবং একটা শ্রেণী, তার সঙ্গে ঐক্য হয়েছে রাষ্ট্রের এবং সেইভাবে রাষ্ট্র একটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এখানে রাষ্ট্র ও শ্রেণী একাকার হয়ে ক্ষমতার অসাধু ঐক্য গড়ে তুলেছে।

নাসিম আখতার হুসাইন: সাবেক অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com