সমকালীন প্রসঙ্গ

বগুড়া অঘটন: শাস্তি নয়, কাউন্সেলিং

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ২৮ মার্চ ২৩ । ০১:০৮ | প্রিন্ট সংস্করণ

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

যে কোনো সমাজে বিচারককে সর্বোচ্চ আসন দেওয়া হয়। কেননা, বিচারকরা দেওয়ানি, ফৌজদারি, বাণিজ্যিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক আইনের ব্যাখ্যা ও সমস্যায় দুই পক্ষের সাক্ষ্যপ্রমাণ ও যুক্তিতর্ক শুনে যে রায় দেন, তাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে সর্বক্ষেত্রে যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, তা বলছি না। কেননা, কোনো কোনো বিচারক তাঁদের শ্রেণি-পক্ষপাত, অভিজাতপ্রীতি, রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি আনুগত্য, ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না। আমেরিকান লিগ্যাল রিয়ালিজমের তাত্ত্বিকরা এমন কথা বলে থাকেন। এ বাস্তবতা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের সমাজে বিচারক বলতে সাধারণ মানুষ এমন ব্যক্তিকে বোঝেন, যাঁরা ন্যায়দণ্ড হাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেন।

ব্যক্তিগতভাবে আমি দেশের নিম্ন ও উচ্চ আদালতের অনেক বিচারককে চিনি, যাঁরা প্রকৃত অর্থেই ন্যায়ের দণ্ড হাতে বিচার করতেন এবং এখনও করছেন। আমার বিরুদ্ধে করা একটি মামলায় জামিন নিতে গিয়ে একজন বিচারকের যে প্রজ্ঞা ও বিনয় আমি দেখেছি, তা অতুলনীয়।

সারাদেশে কর্মরত বিচারকের মধ্যে কয়েকশ বিচারক আছেন– তাঁরা হয় আমার বন্ধু, নয় আমার সরাসরি ছাত্রছাত্রী অথবা আমার অগ্রজপ্রতিম। তাঁদের মধ্যে অনেকে খুবই শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল ও মানবিক মূল্যবোধে উচ্চকিত। সম্প্রতি বগুড়ার এক নারী বিচারক যে কাণ্ড করেছেন, তাতে সাধারণ মানুষ তো বটেই; বিচারক, আইনজীবী, আইনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক– মানে আমরা যাঁরা আইন অধ্যয়ন ও তার বাস্তব প্রয়োগের সঙ্গে জড়িত, খুবই লজ্জিত ও মর্মাহত।         

বগুড়ায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটি এ রকম– বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ রুবাইয়া ইয়াসমিনের কন্যা বগুড়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। বিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা ছোট দলে বিভক্ত হয়ে শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে থাকে। ২০ মার্চ যখন বিচারকের কন্যার দলের শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেওয়ার কথা; মায়ের অবস্থানের পরিচয় দিয়ে সে দলবদ্ধ দায়িত্বটি পালনে অস্বীকার করে। এ নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা শেষে সে ফেসবুক মেসেঞ্জারে তার সহপাঠীদের ‘বস্তির মেয়ে’ আখ্যা দেয়। তার চার সহপাঠীও পাল্টা উত্তর দেয়।

এ নিয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুনকে তাঁদের অভিভাবকদের ডাকতে বলেন বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিন। ২১ মার্চ বেলা ১১টার দিকে প্রধান শিক্ষকের ডাকে ওই চার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক বিদ্যালয়ে আসেন। ওই সময় সেই বিচারক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় তাঁদের জেলে পাঠানোর ভয় দেখান। এ সময় দুই অভিভাবককে ওই বিচারকের পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। খবরটি জানাজানি হলে প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা ক্লাস বর্জন করে রাস্তা ও স্কুলের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে।

ঘটনাটি দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। এ ঘটনায় চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে মানবিক মর্যাদা। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুযায়ী আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি সব মানুষের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য।

উল্লেখ্য, ১৭৭৬ সালে ‘আমেরিকান ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’; ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবীদের দ্বারা প্রণীত ‘ফ্রেঞ্চ ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস অব দ্য ম্যান অ্যান্ড অব দ্য সিটিজেন’ এবং ১৯১৭ সালে বলশেভিক রেভল্যুশন বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলো হচ্ছে– মানুষের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, সব মানুষের সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ সনদ এবং ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মানুষের মানবিক মর্যাদাকে। শত শত বছর ধরে দাস প্রথা, জাতপাতের বিভেদ, সামন্তবাদ, রাজা-রানীদের স্বৈরাচার, কালো ও দলিতদের নিয়ে যে ভয়াবহ বর্ণবাদী চর্চা হয়েছে; সে কারণে সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় মানুষের মানবিক মর্যাদা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে।

প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, বিদেশি মুসলিম শাসক ও হিন্দু শাসকদের কাছে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলার ব্রাত্য জনগণ অর্থাৎ সাধারণ হিন্দু-মুসলমান ছিল অবহেলিত ও অবমানিত। ব্রিটিশরা বাঙালিকে মানবিক মর্যাদা দেয়নি; আর পাকিস্তানিরা তো বাঙালির মানবিক মর্যাদাকে ধুলাতেই মিশিয়ে দিয়েছিল! সে কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, বাংলাদেশের সংবিধানের মুখবন্ধ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বাঙালির মৌলিক মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদাকে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মানুষের মানবিক মর্যাদায় বিশ্বাস করতেন। বঙ্গবন্ধু, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, স্বামী বিবেকানন্দ ও জীবনানন্দ দাশ বাঙালি জাতিকে বৈশ্বিকভাবে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। 

এত সংখ্যক মানবিক মূল্যবোধে উচ্চকিত কবি, নেতা, সাহিত্যিক, সুফি-দরবেশ, মুনি-ঋষি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেই বাংলাদেশে একজন বিচারক যেভাবে দু’জন অভিভাবকের মানবিক মর্যাদাকে ধুলায় মিশিয়ে দিলেন, সেটি অমানবিক ও মর্মান্তিক।

বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিন নিশ্চয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে সম্মান ও মাস্টার্স উত্তীর্ণ হয়েছেন। সেই সূত্রে তিনি আমার বয়সী শিক্ষকদের ছাত্রী বা ছাত্রীতুল্য হবেন। কষ্ট লাগছে– তাঁর স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, সামাজিকীকরণ, পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা মনোজগতে বাস করা জাতপাতের বিভেদ ও সামন্তবাদী মনোভাবকে উপড়ে ফেলতে পারেনি। এর চেয়ে দুঃখজনক– তিনি জাতপাত ও ধনী-গরিবের বিভেদের ভাইরাসটি কন্যার মধ্যেও সংক্রমিত করেছেন। তাঁর কন্যা যদি তার পুত্র-কন্যাদের মধ্যে এই ভাইরাস সংক্রমিত করে, তাহলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র এবং সমাজের শিক্ষা- সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধ অর্জন ও চর্চার সব আয়োজন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে আমি ক্রিমিনোলজি, ক্রিমিনাল ল, সাংবিধানিক আইন ও মানবাধিকার পড়ছি ও পড়াচ্ছি। আমার একান্ত অনুরোধ, প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তি ও সামাজিক মাধ্যমের প্রবল সমালোচনা দিয়ে বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিন ও তাঁর পরিবারকে আমরা যেন দূরে সরিয়ে না দিই। আমরা যেন তাঁকে একঘরে করে না ফেলি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাঁরা বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিনের ঊর্ধ্বতন; ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব; তাঁরা যেন তাঁকে ‘কাউন্সেলিং’ করেন। রুবাইয়া ইয়াসমিন ও তাঁর কন্যাকে তাঁদের ভুল থেকে সরিয়ে আনতে হবে। তাঁদের মধ্যে যেন সুস্থ-স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবিক বোধ গড়ে ওঠে, সবাই মিলে সেই চেষ্টা করতে হবে।

শুধু শাস্তি দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হয়নি, হবেও না। সারাবিশ্বে সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থা ও কিশোর ন্যায়বিচার ব্যবস্থার দর্শন হচ্ছে– ভুল বা অপরাধ সম্পর্কে উপলব্ধি ও তার সংশোধন। ভুল সম্পর্কে যথাযথ উপলব্ধি এবং তার সংশোধনই প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে; দণ্ড বা শাস্তি নয়।

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩

সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ

টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com