
সাক্ষাৎকার: ড. এভার্ট ডেলবানকো
প্যাকেজিং সুরক্ষা ছাড়া নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হয় না
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | আপডেট: ৩১ মার্চ ২৩ । ০১:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: শেখ রোকন ও মাহফুজুর রহমান মানিক

ড. এভার্ট ডেলবানকো জার্মান কেমিক্যাল কোম্পানি সিজওয়ার্কের খাদ্য নিরাপাত্তা ও টক্সিকলজির পরিচালক। তিনি ইইউপিআইএ নিয়াস রিস্ক ম্যানেজমেন্ট টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি রাসায়নিক-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ইউ রিচ, কে-রিচ এবং জিএইচএস ওয়ার্ল্ডওয়াইডে কাজ করেন। তিনি জার্মানির ডর্টমুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সিজওয়ার্কে কর্মসূত্রে তিনি কালি, প্যাকেটজাতকরণ আইন বিষয়ে বৈশ্বিক দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়।
সমকাল: নিরাপদ ও টেকসই খাদ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নিরাপদ প্যাকেজিং কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
এভার্ট ডেলবানকো: খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে প্যাকেজিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানিতে আমি শৈশবে মাছের বাজারে যেতাম। সে সময় মাছ পত্রিকা দিয়ে মোড়ানো বা প্যাক করা হতো। এর মাধ্যমে পুরোনো সংবাদপত্র চমৎকারভাবে কাজে লাগানো হতো। তবে সেটা যে গুণগত মানসম্পন্ন প্যাকিং ছিল, তা বলা যাবে না। খাবার ভালোভাবে প্যাকেট করতে না পারলে তা ভয়ংকর হতে পারে। রাসায়নিকের সংবেদনশীলতার দিক থেকে বিশ্বের সব মানুষ সমান। সুতরাং প্যাকেজিং সুরক্ষা ছাড়া নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হতে পারে না।
সমকাল: প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রূপান্তর কেমন দেখছেন?
এভার্ট ডেলবানকো: আমার পর্যবেক্ষণে প্যাকেজিং সম্পর্কে বেশ কিছু নতুন আইন হওয়ার কারণে অনেক দেশই বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। এমনকি বিদ্যমান আইনেও প্যাকেজিংয়ের গুরুত্ব উঠে এসেছে। সে জন্য এর একটি ভালো প্রবণতা স্পষ্ট। এ ধারাকে আমি বলব চেষ্টারত নয়, বরং আবেদনময়ী। বৈশ্বিক পর্যায়ে প্যাকেজিংয়ে আমাদের কিছু বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন, যারা কমপ্লায়েন্সে কাজ করতে পারে।
সমকাল: এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্র কেমন দেখছেন? আমাদের বিএসটিআই রয়েছে।
এভার্ট ডেলবানকো: বিএসটিআই বাংলাদেশের পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে। তারা এ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু তাদের আরও কিছু করার আছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে শুধু খাদ্য উপাদানের গুণগত মান নয়; কীভাবে পরিবেশিত হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
সমকাল: প্যাকেজিং বিষয়ে কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি জনসচেতনতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
এভার্ট ডেলবানকো: জনসচেতনতা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আমি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছি; জানি না– বিষয়টি নিয়ে এখানকার মানুষ কতটা সচেতন।
সমকাল: আমরা যদি গুণগত মানসম্পন্ন প্যাকেট নিশ্চিত করি, তবে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে না?
এভার্ট ডেলবানকো: আপনাকে পুরো বিষয়টি একটি প্যাকেজ হিসেবে দেখতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা প্রথম জরুরি। সেখানে ঘাটতি থাকলে সংকট আরও বাড়বে এবং কোম্পানিও তার সুনাম হারাবে। হ্যাঁ, কিছু দাম হয়তো বাড়বে। তবে মনে রাখতে হবে, নিরাপদ খাদ্যের জন্যই তা জরুরি। প্যাকেজিংয়ে হয়তো অল্প অর্থই যাবে। তারপরও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা চাই। আর তা নিশ্চিত করে প্যাকেজিং অনিরাপদ রাখার অর্থ, ইংরেজি সেই প্রবাদের মতো– এক পাত্র দুধে এক ফোঁটা বিষ মেশানো।
সমকাল: আপনি খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলছেন, কিন্তু প্যাকেটের ভেতরের খাবার যে নিরাপদ– সেটা কীভাবে নিশ্চিত হবে? কীভাবে গ্রাহক তার ওপর আস্থা রাখবেন?
এভার্ট ডেলবানকো: গ্রাহকের আস্থা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা প্রশংসনীয়। এখানে প্রতিষ্ঠিত খাদ্য কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষকে ঘন ঘন ও আকস্মিক পরীক্ষা চালাতে হবে। গ্রাহকের আস্থা ও নিরাপত্তাবিনাশী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না।
সমকাল: খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশে কাদের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন? শিল্প মালিক; বিএসটিআই; নাকি সরকার?
এভার্ট ডেলবানকো: এখানে সবার ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি চেইনের মতো। সরবরাহকারী, উৎপাদনকারী, বিতরণকারী– সবারই দায়িত্ব রয়েছে এবং সবাইকে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। সমানভাবে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে।
সমকাল: ইউরোপ কিংবা উন্নত দেশগুলোতে প্যাকেট দেখেই গ্রাহক বুঝতে পারেন খাবার কতটা নিরাপদ; যেহেতু প্যাকেটের নানা চিহ্নের তাৎপর্য তাঁরা বোঝেন। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রাহক যেহেতু এসব বুঝতে পারেন নাৃ; তাঁদের জন্য করণীয়...
এভার্ট ডেলবানকো: আপনি ইউরোপের কথা বলেছেন। সেখানে স্টোরগুলোর প্যাকেট দেখলেই বোঝা যায়, খাবার কতটা স্বাস্থ্যসম্মত। তবে সব জায়গায় এ ব্যবস্থা নেই। এখানে ভোক্তা যদি প্যাকেটের নির্দেশনা না দেখেন, তাতে কিছু করার নেই। প্যাকেটে থাকার কারণে খাবারের স্বাদ তাঁদের দেখার সুযোগ নেই। ভোক্তা এখানে একেবারে অসহায়। এ কারণেই হয়তো কয়েক বছর পর তাঁর ক্যান্সার হতে পারে। কিন্তু এখনই কিছু করার নেই। এটা লুক্কায়িত ঝুঁকি। এখানে উচ্চ নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
সমকাল: বাংলাদেশের বাজারের যে আকার, সেখানে প্যাকেজিং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কতটা সহজ?
এভার্ট ডেলবানকো: বাংলাদেশ বিকাশমান অর্থনীতির দেশ। এর প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু বৈশ্বিক বাজার আরও বড়। বাংলাদেশ অন্য দেশে বড় আকারের রপ্তানি করছে। বিশ্ববাসী বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি পণ্য পাচ্ছে। সে জন্য বাংলাদেশেও প্যাকেটের সুরক্ষা ও ভোক্তার নিরাপত্তা উভয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুরক্ষা সবসময়ই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। আমরা যদি বৈশ্বিক পর্যায়ে এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি, তবে দেশও উপকৃত হবে। অভ্যন্তরেও সেই মান বজায় রাখতে হবে।
সমকাল: আপনি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পুরো প্যাকেজের কথা বলছেন। কিন্তু সূচনাটা কীভাবে হবে?
এভার্ট ডেলবানকো: হ্যাঁ, আমি পুরো প্যাকেজের কথা বলেছি। বলেছি কাঁচামাল সরবরাহকারীর কথা। উৎপাদনের আগে শুরুতে কাঁচামাল থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে। এর পর প্যাকেটের বিষয়টি। প্যাকেট কীসের তৈরি এবং কীভাবে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এর পর উৎপাদনসহ পুরো প্রক্রিয়ায়ই সুরক্ষার বিষয়টি দেখতে হবে। বস্তুত এখানে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নেই। পুরো প্যাকেজে নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই কেবল ভোক্তার পুরোপুরি সুরক্ষা নিশ্চিত হতে পারে।
সমকাল: এদিক থেকে বাংলাদেশের যে অবস্থান, তার অনুরূপ অন্য কোনো দেশের উদাহরণ বা অভিজ্ঞতা আমাদের জানাতে পারেন?
এভার্ট ডেলবানকো: আমি মনে করি, দুটি উদাহরণ হতে পারে– ভারত ও ইন্দোনেশিয়া। যদিও ভারত সম্ভবত কিছুটা এগিয়ে।
সমকাল: এ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কিংবা এক দেশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য দেশের প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা বিনিময় হতে পারে?
এভার্ট ডেলবানকো: আমি ভারতে কিছু কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ভারতের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা খুব ভালো। যদিও সেই অর্থে ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। তবে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতাও ভালো।
সমকাল: বাংলাদেশ সরকার খাদ্য নিরাপত্তা আইনের খসড়া তৈরি করে তা মানুষের মতামতের জন্য উন্মুক্ত করেছে। আপনি সেটা দেখেছেন। সেখানে কি কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন?
এভার্ট ডেলবানকো: সরকার যেভাবে আইনের খসড়া তৈরি করে মতামতের ব্যবস্থা করছে, তা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। এটা ভালো সূচনা নিঃসন্দেহে। আমাদের প্রত্যাশা, মতামতের ভিত্তিতে উন্নয়নের সুযোগ রাখা হবে। প্রশ্ন হলো, এটি কীভাবে বৈশ্বিক পর্যায়ে বাস্তবায়ন করবে। এখানে নেতিবাচক ও ইতিবাচক দুই মতামতই আসবে। যেখানে প্রয়োজন সংশোধনী আনতে হবে।
সমকাল: বাংলাদেশের জন্য এটি নতুন ধারণা বলা চলে। কিছু আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্যাকেজিং সুরক্ষা নিয়ে কাজ করছে। সমকালের সঙ্গেও তারা গোলটেবিল করেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের চ্যালেঞ্জ কী কী?
এভার্ট ডেলবানকো: এ বিষয়ে কাজ হয়েছে, হচ্ছে– এটা ভালো বিষয়। আইনের কথা আগেও বলেছি। খসড়া বেশ ভালো মনে হয়েছে। আইন সবসময়ই ভালো সেই অর্থে। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হলো, সেটা কতখানি বাস্তবায়ন হবে। বাস্তবায়নের মধ্যেই সফলতা। আমি বলেছি, এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় তালিকাই করতে হবে। নেতিবাচক তালিকা নিয়ে কাজ করা খুব সহজ। ইতিবাচক বিষয়গুলো বেশি চ্যালেঞ্জিং।
সমকাল: প্যাকেজিংয়ে টলুইন ক্ষতিকারক একটি বিষয়। আপনার কী মত?
এভার্ট ডেলবানকো: টলুইন শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এর প্রভাব শিশুদের ওপর ব্যাপকভাবে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য এই টলুইন খুব ক্ষতিকর। এটি ব্যবহারে নির্দিষ্ট মাত্রা অবশ্যই অনুসরণ করেত হবে। তার বেশি হওয়া যাবে না। এটি খাবারের সব পর্যায়কেই দূষিত করতে পারে। সুতরাং এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি।
সমকাল: সাক্ষাৎকারের জন্য ধন্যবাদ।
এভার্ট ডেলবানকো: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com