
প্রচ্ছদ
জ্বর ও প্রলাপের মতো কিছু
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২৩ । ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রিমঝিম আহমেদ

প্রথম প্রলাপ:
জ্বরের ঘোরে মাথা ও শরীর দুলে ওঠে, শুয়ে থাকি। আসলেই কি শুয়ে থাকি? চরে বেড়াই। অতীত থেকে বর্তমানে, বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে। উড়ে বেড়াই সপ্ত আসমান। মাঠঘাট, প্রান্তরের ধোঁয়াটে রেখা অবধি। মগজেরও ডানা গজায়। সে এক অদ্ভুত সবুজ ফড়িং হয়ে কখন কার গায়ে বসে ঠিক নেই।
জ্বর আমাকে নিয়ে যায় শৈশবের এক শান্ত পুকুরের কাছে। পুকুরপাড়ের ঘাসে বসিয়ে দেয়, একা। আর সামনে ঝরাপাতার স্তূপ দিয়ে বলে– ছেঁড়ো! আমি ছিঁড়তে থাকি একমনে। ছিঁড়তে ছিঁড়তে দেখি পাখিগুলো খালি আকাশের তল দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে গ্রাম। তারও পরে নলুয়া বিল, টেবটেবি বুড়ির পাহাড়, যেখানে অতিথি পাখিরা পাহাড়ের গায়ে গর্ত করে আবাস গড়েছে। আর সেই বনমোরগের ডাকের কাছে, যেখানে ভিন গ্রাম থেকে আসা অচেনা এক রাখাল বাঁশের বাঁশিতে জাগিয়ে তুলেছিল আদিম নিঃসঙ্গ কিশোরীকে। যে জল আনতে দূর পাড়ায় যায়, আর ফেরে আঁচলে বিকেল নিয়ে। পাতার বাঁশি আমাকেও উচাটন করে। আমার অন্যমনস্কতা থেকে ঝরে পড়ে একেকটা পথ, একেকটা মানুষ। ঝরতে থাকে বৃষ্টিমুখর দিন, লন্ডভন্ড ঝড়ের আঘাতে কাঁচা-পাকা আমের গায়ে নিদানের দাগ। জানালা পেরিয়ে চোখ উড়ে বসে নারকেল গাছে। সারি বেঁধে লোলুপ পিঁপড়ে সেনারা যায় কোথাও। খাবারের খোঁজে! কে তবে প্রথম সন্ধান দিয়েছিল? কে তাদের নেতা? এইসব ভাবতে ভাবতে কানামাছি খেলি জানালা পেরিয়ে যাওয়া মেঘের সাথে। মেঘ আমার চোখ বাঁধে, তো আমি মেঘের। এমন খেলা ফুরালে আবার অন্য খেলা। দূরের পাহাড়ের সাথে খেলি ইকরিমিকরি। আঙুল বেঁকে আসে।
জ্বরতপ্ত ঠোঁট জোড়া নড়ে ওঠে। কাউকে ডাকে। কিন্তু অস্ফুটে। স্মৃতির দখলদারি বাড়ে। জ্বরবেলা মানে বুকের ভিতরে জেগে থাকে একটা মা। মনে পড়ে সাহা পাড়া থেকে হেঁটে আসা মুড়িকাকা। চার সেরি টিনের পেটরায় মুড়ি মেপে দিয়ে হেসে চলে যায় অন্য বাড়ির দিকে। আচ্ছা, মুড়িকাকার কি ভুঁড়ি ছিল? আবার এক খটাখট শব্দ। যেন বিয়ের প্যান্ডেল টানানো হচ্ছে। উঠানেই কি? কার বিয়ে তবে? আমার ঘুম পায়। তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করে গভীর ঘুমে…
জ্বর হলে মা রং চা করে দিত, লেবুপাতা দিয়ে। সাথে মুড়ি। তারপর কাজে যেত। দুপুরের রান্নাঘরের সার্বিক আওয়াজ থেমে গেলে মাথায় গামছা জড়িয়ে মা আসে স্নান সেরে। তাঁর গায়ে কুরচি ফুলের ঘ্রাণ। জ্বর তীব্র হলে আমি সে ঘ্রাণ পাই। না-থাকা মা আমার শিথানে এসে বসে। চুলে বিলি কাটে। বিড়বিড় করে মা পড়তে থাকে– ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা, সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’
মা নেই। মা তবু থাকে মা-মা গন্ধের ভিতর। মা ভাবাপন্ন মানুষের সাথে মা ঘুরে বেড়ায় আমার চারপাশে, আলো-বাতাসে।
মনে পড়ে, পাকা ডালিমের মতো ফেটে পড়ছিল দুপুর সেদিন। আমার শরীর বেয়ে উঠছে-নামছে বেদম উত্তাপ। চোখ ছোট হয়ে আসছিল। দুপুর রোদেও পৃথিবীটা কেমন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল। কোথা থেকে হেঁটে এসে যেন মাটির পইঠায় ধড়াম করে পড়ে গেলাম। শরীরে খই ফোটানো জ্বর। তারপর আবছা, ভাঙা ভাঙা শুনতে পাচ্ছিলাম চাচির কণ্ঠস্বর– ‘আহা রে! কী বেতাপ জ্বর মেয়েটার!’ তারপর আমিও জানি না কী হয়েছিল! তন্দ্রার ভিতর মা এলো, সরসর করে জলের শব্দ। বন্ধ চোখ। টের পাচ্ছিলাম, জলের ধারা কপাল থেকে চুলে, চুল থেকে চুইয়ে পড়ছে বালতিতে। বৃষ্টিবাহিত ঝরনাধারার মতো। আমার ঘুম পাচ্ছিল। সহস্র বছরের না-ঘুমানো ঘুম চোখে পাখির মতো এসে বসে। ভীষণ আকুল, ভীষণ ছটফট!
দেখি, একটা ছবি। দেয়ালে টানানো। দেখি ছবি থেকে নাকটা সরে গেল। তারপর একে একে কান, চোখ সরে সরে ঘরের বাতাসে উড়ছে। ছবির মানুষটি কেমন অদ্ভুত আর অস্পষ্ট হয়ে গেল নিমেষেই। তারপর ছবি থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসে অস্পষ্ট মানুষটি। এলোমেলো হাঁটে ঘরের ভিতরে। গোঙানির মতো শব্দ বেরিয়ে আসে কণ্ঠস্বর ছিঁড়ে। মা! মা তো এমন নয়। এমন প্রেতাত্মার মতো কেন আমার মা হতে যাবে?
আবার সেই জলের ধারা কপাল বেয়ে নামছে চুলের দিকে, কানের ভিতরও কয়েক ফোঁটা ঢুকে পড়েছে বোধহয়! মিষ্টি এক শব্দ। বৃষ্টিমুখর দিনে যেমন নারকেলের পাতা বেয়ে জল নামে, তেমন মৃদু শব্দ করে নামছিল। জল। আমরা বলি পানি।
এমন নরম হাতের, আদুরে স্পর্শ মা ছাড়া আর কে হতে পারে! মা-ই কি তবে এসেছিল? এত সময় নিয়ে জলপট্টি দিল। মা! মা! অস্ফুটে ডাকটা বের হয়ে এসেছিল আমার। তারপর তন্দ্রা কেটে গেল, চোখ খুলে আবছা হয়ে আসা দৃশ্যের ভিতর দেখি, আমার শিয়রে বসে আছে বিন্নি আপা। আমার চাচাতো বোন। জ্বরের ঘোরে আমার মা হয়ে গিয়েছিল সে।
মা, যার মৃত্যু হয়েছিল আমার ফ্রক পরা দিনে। কিন্তু জ্বর হলেই এভাবে মা আসে। জলপট্টি দেয়। জ্বরের সাথে কি তবে মা মিশে থাকে? মা আর জ্বর, যেন এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে বাঁধা। বিনিসুতার মালার মতো। দেখি না, বুঝতে পারি, আপ্রাণ।
তারপর আরও কত জ্বরের দিন এলো-গেলো। রাতভরে জ্বরোবৃষ্টি হলো। এর-ওর শরীরে ভর করে মা-ই আসে। অথচ মা নেই এই বিশ্ব চরাচরে, কেবল থাকে মায়ের অপূর্ব এক ছবি। জল পড়ার শব্দ, স্পর্শ আর বৃষ্টিমুখর ঝাপসা মাঠের মতো মায়ের মুখ। আমাদের ইচ্ছে রঙে রাঙানো একটা মা। সে মা থাকে সকলের কল্পনায়। সকলের জ্বর ও জরায়। থাকে এমন জ্বরতপ্ততায়, বুকের ভিতর এক নরম কোমল অনুভবে।
জ্বর মানে ফটিকদের ছুটি হওয়া, জ্বর মানে ফটিকদের মায়ের কাছে ফেরা। যাদের মা আছে তারা যেমন যায়, যাদের নেই, যা তারাও। কেউ বাস্তবে আর কেউ কল্পনায়।
দ্বিতীয় প্রলাপ:
এক একটা দিন আসে, এমন– নিজেই নিজের দিকে ছুড়ে দেয় স্মৃতিখণ্ড। পাথরের মতো– ভাঙা ইটের মতো– আঁচড়াখাঁচড়া, ধারালো আর রক্তপাতপ্রবণ। একেকটা রাত যেন মহিষের পিঠে করে নিয়ে আসে তাবৎ অন্ধকার। নিজেকে লুকানোর। রাত কি নিজেই তাগড়া এক কালো মহিষ নয়!
এমন দিনগুলোতে জ্বর আসে। নেশামাতাল ঘোরগ্রস্ত জ্বর। হঠাৎ একটা রাত সরতে সরতে দুই ভাগ হয়ে যায়। মাঝে বয়ে যায় এক কল্পনদী। সে নদীতে থাকে রঙিন মাছেরা, তারা উড়তে পারে, তারা কথা বলতে পারে। কোনো কোনো মাছ হয় মানুষের মতো দেখতে মুখ, কোনোটা গাছের মতো পাতাঅলা। কোনোটা গান গায়, আর কোনোটা ঝগড়াঝাঁটির পর থম মেরে বসে থাকে। তখন কবি গৌতম চৌধুরীর ‘শপ্ত’ কবিতাটি মনে পড়ে—
‘আসছে রক্তাভ দিন লাল জ্বোরো প্রশ্বাসের ঝলক
আসছে লণ্ঠন হাতে ঝোড়ো গির্জা পুড়ে-যাওয়া আরাবল্লি ইট আসছে ডালপালা পাতা কালো শুয়া, ঘেন্নায় কোনোদিন যারা প্রজাপতি হবে না
আসছে চুল্লির ধোঁয়া পাক-খেয়ে মন্থর ডাস্টবিন…’
বুঝি, চোখের পাতায় দুধের সরের মতো ঘন হয়ে আসে ঘোর। তখন কাঞ্চন পিয়নের মুখ মনে পড়ে।
কাঞ্চন পিয়ন প্রতিদিন তার খাকি পোশাক দেখিয়ে চলে যায় একঝলক রোদের মতো, আমার খিদে লাগে, অথচ আঙুলের ভারে নড়তে পারি না। তাকিয়ে থাকে উনুনমুখী পোকা। ঠাডা লাগা চোখ স্থির হয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে; ঘুম পায়, রাত ভোর হলে স্বপ্নের ভেতর ঘুমিয়ে পড়ি। চিঠি এলো তো! নাকি আজও, অন্ধ হয়ে গেছে চিঠিদের পথ! তাই আমার বাড়ির পথ চিনে আসতে পারে না আর।
অসুখ সময়ের যাপন ঘিরে আছে। উঠানে ছড়ানো শুকিয়ে আসা শাড়ির মতো পতপত করে ওড়ে। মন ও শরীরের তখন বোঝাবুঝি শেষে বন্ধুতা চলে। ঝুল জমা জানালায় আঙুল দিয়ে আমি হিসেব রাখি। কতবার আড়ি দেওয়ার পর ফের ভাব হলো! মনে মনে চিঠি লিখি। আঙুলে চেপে হলুদ খামে আঠা লাগাই। ঠিকানা লিখি, পোস্ট করি। তারপর অপেক্ষা…
লিখি, কল্পনার গোলাপি জলছাপ কাগজের বুকে। জ্বরে-ডোবা প্রলাপের মতো–
সু, এই যে জীবনটা দেখছ, শাদা-কালো, লাল-নীল, বেলুনের মতো উড়ুউড়ু! তার কিছুটা আমার। বাকিটা অনেকের। তোমারও কিঞ্চিৎ।
জ্বর আসে, ধরে নিচ্ছি কেউ নেই বলে জ্বর থাকে কয়েকদিন তুমুল জড়িয়ে ধরে, চুমুয় ভরিয়ে দিয়ে সারা শরীর আমাকে কাহিল করে চলে যায়। জ্বরের কামুক জিহ্বা থেকে তোমার গায়ের ঘ্রাণ আসে। যেন জ্বররূপ তুমি এসে কাতর করে যাও ভেতর-বাহির। মনে পড়ে যাচ্ছে তোমার না পাওয়া চিঠিপত্র, কাঞ্চন পিয়নের পুরু ঠোঁট, ঝোলার ভেতরকার ঠিকানাহীন হলুদ চিঠি...
সফেদ পর্দা গলে আলো আসে, ঋতুবদলের দিনে। কিছু আলো তোমাকেও ছুঁয়ে দিয়ে এসেছে। জন্মগত অমাবস্যাপ্রীতি গিলে খেয়েছে তোমার আধেক। মর্ম-গ্রহণ লেগে তুমি স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে শুয়ে কাঁপছ, আসন্ন জ্বরে। তোমার জ্বর দূর থেকে কিছুটা আমাকেও পেয়ে বসে। প্লাস্টিকের বাক্সে রাখা প্যারাসিটামল ঢোক গিলে খেতে গিয়ে সহমরণ পেয়ে বসে। এই মখমল পাখিবাগানে তোমার জন্য রাখা ছিল গান।
‘তোমার কথার শব্দদূষণ
তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি
আমার দারুণ জ্বর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর।’
সুরবধির তুমি। কাঠের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার কৌশল ব্যতীত শেখোনি আর কিছু, শেখোনি পাতার বাঁশিটিও কেমন ডেকে ওঠে একলা রোদ্দুরে। ঐ দেখো! সাঁতারের ছলে তোমার পায়ের কাছে ছুটে যায় জল। তার কিছু আমাকেও ছুঁয়ে গেছে বিগত সন্ধ্যায়। আমার পিতামাতা নেই। মাটির সন্তান আমি। সন্তাপে পুড়ে ফিনিক্স হই; ফের জন্ম আসে। কে তুমি নাম করো আমার পরিচয়?
এই জল, নদী সহোদর তাদের রক্তে আমি বেঁচে উঠি। তোমার পরমায়ু প্রাপ্তির দিনে ক্ষয়ে যাচ্ছে স্মৃতিস্নাত স্কুলঘর, পোকায় খাওয়া ব্ল্যাকবোর্ড। কেবল শনশন নীরবতা। তারও আছে নখ, আঁচড়ের কারবার।
তুমি তো কবেই ছুটি পেয়ে গেছ! আজ কার কাছে বার্তা পাঠাও পাপমাখা আঙুলে! মস্তিষ্ক সঙ্গমে কে তোমায় সঙ্গ দেয়, কোন তারকা সুহাসিনী?
আমিও একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছি অন্ধকারে, জ্বরে। কোথাও একটা ভুল তারে আঙুল পড়েছে। বেসুরো বাজছে জীবন। জীবন ক্রমশ জটিল হয়ে উঠলে মানুষ কোনো সহজ পথের সন্ধান আর পায় না। পথের ধূলিকণাও তখন বেঁচে থাকাকে তামাশা করতে শুরু করে।
তখন কানের কাছে এসে কেউ কি বলে– সকল অপমানের মুখ হাসি ঘষে দাও! বাঁচো তুমুল!
হাসিই আমার অস্ত্র। বেদনাকে তুমি ছোঁয়ার আগেই এমন হেসে দেব যে, তুমিই গুঁড়ো হয়ে যাবে। ইতি, ছিল, নেই…
কী লিখি আর? প্রলাপের অর্থহীনতা থেকে কে নেবে অর্থ খুঁজে? আমি তো জানিই, কেউ কেউ জীবনে আসে। দেয় না কিছু, নেয়ও না। কেবল কেড়ে নেয়। এবং কেড়ে যে নেয়, সেটা নিজেও জানে না। কিছুই থাকে না চিরকাল। না থাকাকেই থাকা করে নিতে হয় শুধু। সমস্ত ক্লেদ মুছে বাঁচার জয়গান গাইতে হয়। কিন্তু সব দাগ কি মোছে? ছুড়ে ফেলার পর যতই তুলে নিক কিছু না কিছু ধুলোবালি তো লেগে থাকবেই। মানুষ বিকল্পে বাঁচতে চায়। কী জানি, এক মানুষের বিকল্প আরেক মানুষ হয় কিনা!
তৃতীয় প্রলাপ:
কবি অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—
‘তোমার মাথায় কেউ হাত রেখেছিল
ভোররাতে, জ্বর ছেড়ে এসেছে যখন
পাখি ডাকছে একটা কী দুটো; এসেছিল-
কুয়াশায় ছোট্ট একটা ছেলের মতন।
জানতেও পারনি তুমি। কাঁঠালচাঁপার
আবছা গন্ধটি খালি চুলের ভেতর
পেয়েছিলে পরদিন। এর বেশি আর
কিছু নেই, শেষ এই গল্প তারপর।’
ভিতরে অনেক বড় হচ্ছি, বয়স বাড়ছে, কাশি, জ্বর দানা বাঁধছে। জ্বরের সাথে মাইগ্রেনের ব্যথাটা ধেয়ে আসে ইদানীং। বিষণ্ণতার নাম করে মন কেমন-করা ভাবটাও যেন এবার পাশে এসে বসে। নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসে। এত এত মানুষ উত্তর-দক্ষিণে, তবু যেন একা ও একলা বসে আছি নিজস্ব নদীর পাড়ে। হু হু করে হাওয়া বইছে, শাড়ির আঁচল আর চুল বশে আসে না। ছেঁড়া পাল উড়িয়ে দিয়ে নিঃশব্দে ও শব্দের মাঝামাঝি গোঙানি তুলে ডিঙি ভেসে যায় হাটবারের কোলাহলের দিকে। আজও কোথাও হাট বসবে, পসরা সাজাবে ঠিকে ব্যবসায়ীরা আনাজপাতি দিয়ে। আজ কেউ ঘরের জন্য সদাই কিনবে। দিন শেষে মাটির চুলোয় ছাই ছড়িয়ে রান্না করবে বাটা মরিচ দিয়ে। জ্বর এভাবেই নিজের ভিতর থাকা একলা পাখিটাকে ডেকে তোলে।
আমার ভিতর ঘর। মানুষ যাকে বলে ‘মন’! সে-ই ভিতর ঘরটাকে মাঝে মাঝে মনে লাগে ধূ-ধূসর মাঠ। সবটা ভুল। সবটা বিভ্রম। সবটা মায়া ও মরীচিকার মধ্যকার দোলাচল।
ইচ্ছে করে কোথাও যাই, কারও কাছে যাই, কারও নিঃশ্বাসের পাশে বসি। ইচ্ছে করে চিৎকার করি। মাঝে মাঝে নিতে হয় শ্বাস, কারও কারও কাছে পেতে হাত...। আমার কোথাও আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও সে ‘তুমি’টাকে পাই না। আছে, নেই।
মা মানে কেবল নারীকেই বুঝি না আমি। সকল মানুষের মধ্যে একটা মাতৃমন থাকে। জলে ডোবা চারার মতো। ধীরে ধীরে উঁকি দেয়। সম্পর্কভেদে তার ভূমিকা পাল্টে পাল্টে যায়। আর তাই জ্বরের ঘোরে চুম্বন প্রার্থনীয়। একটা মায়ের মতো প্রেমিক বা প্রেমিকা যেন চোখ বুজলেই বুকে হাত রাখে। থরে থরে সাগুদানা, জাউ রেখে সে পাতলা ন্যাকড়া ভিজিয়ে কপালে রাখে।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন–
‘শ্রাবণের মেঘ কি মন্থর!
তোমার সর্বাঙ্গ জুড়ে জ্বর
ছলোছলো
যে কথা বলোনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো।’
জ্বর হলে যে মুখটা মনে পড়ে, আমি তাকে কখনও দেখিনি। সে যেন মানুষের কল্পিত স্বর্গ থেকে নেমে আসে শুশ্রূষা নিয়ে। প্রেমিকের মতো তার চোখ, ঘুরে তাকানো। আর তার হাসিটি। যেন ঝড়ের পর শান্ত হওয়া পৃথিবীর নরম হাওয়া। এই প্রেমিক মানুষের মনে ঘুমিয়ে থাকে। জ্বর হলেই কেবল জাগে। আর মন বলে– জ্বর হলে আলিঙ্গন সুন্দর, মাথায় হাত রাখা সুন্দর, ঈষদুষ্ণ প্রেম সুন্দর। ‘শরীর ঠিক আছে?’ এমন সহজ প্রশ্নেও তখন বুকজুড়ে গোলাপ ফোটায়।
© সমকাল ২০০৫ - ২০২৩
সম্পাদক : আলমগীর হোসেন । প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ
টাইমস মিডিয়া ভবন (৫ম তলা) | ৩৮৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা - ১২০৮ । ফোন : ৫৫০২৯৮৩২-৩৮ | বিজ্ঞাপন : +৮৮০১৭১৪০৮০৩৭৮ | ই-মেইল: samakalad@gmail.com